রাজনৈতিক ইঁদুর বিড়াল খেলা- মাহমুদুজ্জামান

আমরা মুসলিম বাঙ্গালীর একটা বড় অংশই ধর্মভীরু। আছে খোদার প্রতি ভক্তি, ধর্মের প্রতি বিশ্বাস, আছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি আস্থা, আছে আর্থিক দীনতা, কিন্তু নেই কোন রাজনৈতিক দলের লেবাস। আলোচনার সুবিধার্থে এই অংশটির নাম দিলাম আমজনতা। আওয়ামীলীগ, এবং বিএনপির রাজনীতি মূলতঃ ঘুরপাক খায় এই বিশাল আমজনতা অংশটিকেই ঘিরে। আওয়ামীলীগের চেষ্টা থাকে বিএনপিকে স্বাধীনতাবিরোধী প্রমাণ করতে আর বিএনপি-এর চেষ্টা থাকে আওয়ামীলীগকে ইসলাম বিরোধী প্রমাণ করতে। এর সমস্ত কর্মকান্ডই আমাদের এই বিশাল ভোটারগোষ্ঠির চোখে ঠুলি পড়িয়ে সমর্থন আদায়ে প্রভাবিত করা।

এদিকে জামায়াতী ইসলামীর ভোটব্যাংকও ওই একই। ইলেকশনে জামায়াত যে পরিমাণ ভোট পায় তার সবাই যে জামায়াতী ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত তা ঠিক নয়। আমজনতার মধ্যে যারা জামায়াতকে নিছক একটা ইসলামী দল হিসেবে দেখে তারা জামায়াতকে ভোট দেয় আর যারা জামায়াতকে মৌলবাদী এবং আওয়ামীলীগকে ইসলামবিরোধী হিসেবে দেখে তারা বিএনপিকে ভোট দেয়। অন্যদিকে এই অংশের যারা বিএনপিকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে দেখে তারা আওয়ামীলীগকে ভোট দেয়। সবই নির্ভর করছে কে কিভাবে আমাদের এই আমজনতাকে মিথ্যায় ভুলাতে পারে। এখানে সত্যের কোন স্থান নেই।

এইতো গেল সাধারণভাবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর চিন্তাচেতনা, কর্মপদ্ধতি ও ভোটে তার প্রতিফলন। এখন আমরা যদি বর্তমান গভীরভাবে বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করি তাহলে বিষয়গুলো আরও পরিস্কার হবে বলে আমার ধারনা।

বিএনপি যখন মোটামুটি আন্দোলনের মাঠ গরম করে ফেলছিল, ঠিক সেইরকম এক পরিস্থিতিতে আওয়ামীলীগ সরকার নিছক অপেক্ষাকৃত দুর্বল ইস্যুতে জামায়াতী ইসলামীর চার শীর্ষ নেতাকে আটক করাতে অনেকেই মন্তব্য করছেন যে আওয়ামীলীগ সরকার এখন একটা ঝুঁকির মুখে পরে যেতে পারে। যেখানে বিএনপি মুখিয়ে আছে এই সরকারের বিরুদ্ধে মাঠ গরম করতে সেখানে আবার জামায়াতের এই শীর্ষ নেতাদের আটক যৌথভাবে আন্দোলনের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেতে পারে বৈকি। মাঝখান দিয়ে জামায়াতীরা সাধারণ জনগনের সহানুভূতি পেয়ে যেতে পারে যেক্ষেত্রে যুদ্ধাপোরাধীদের বিচারকার্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে।

আওয়ামীলীগ অত্যন্ত পুরোনো এবং অভিজ্ঞ দল। তাদের সরকার কোনরকম চিন্তাভাবনা ছাড়া হুট করে একটা অপরিপক্ক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা ভাবা নির্বুদ্ধিতারি সামিল। জামায়াত এখন আওয়ামীলীগ সরকারের হাতে তুরুপের তাস। যুদ্ধাপোরাধীদের বিচারের থেকে তাদেরকে রাজনৈতিক যুদ্ধের ময়দানে ঢাল হিসেবে ব্যাবহার করাই আওয়ামীলীগ সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। এটা ভেবে তৃপ্তির ঢেকুর তোলার কোনই কারন নেই যে যাক এবার যুদ্ধাপোরাধীদের বিচার হবে। কারন বিচারকার্য চালানো হবে অত্যন্ত ধীর গতিতে এবং টেনে নিয়ে যাওয়া হবে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত। সেক্ষেত্রে আবার যদি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে তো বিচার না হবার বিষয়টি নতুনভাবে মোকাবেলা করা যাবে আর বিএনপি ক্ষমতায় এলে তো সমস্ত দায়ভার তাদের উপর চাপানো যাচ্ছেই। সুতরাং হারাবার কিছুই নেই।

এখন আসা যাক কেন সরকার এমন করছে? যেহেতু যুদ্ধাপোরাধী হিসেবে জামায়াতী ইসলামীর একটা নেতীবাচক ভাবমূর্তি আছে আমাদের দেশে এবং তাদের সাথে যেহেতু বিএনপি-এর সখ্য তাই কোনভাবে যদি জামায়াতের আন্দোলনের মাঠে বিএনপিকে নামানো যায় তখন বিএনপিকেও একি কাতারে সামিল করা যাবে জনগনের সামনে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর একমাত্র ব্রতই হচ্ছে কিভাবে জনগণকে বোঝান যায় যে বিরোধীপক্ষ খারাপ, অক্ষম, তারা দেশ ধংসে লিপ্ত। সে মিথ্যাচার করেই হোক বা রাজনৈতিক ফাঁদে ফেলেই হোক।

সঙ্গত কারনেই শীর্ষ নেতাদের মুক্তির দাবিতে জামায়াত এখন আন্দোলনের মাঠে প্রচন্ড সক্রিয় হচ্ছে বা হবে। তারা নাশকতামূলক কাজেও লিপ্ত হতে পারে যে ইঙ্গিত আমরা বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই পেয়েছি। সুতরাং এইমুহুর্তে বিএনপি যেকোন ইস্যুতে সরকার বিরোধী আন্দোলনে নামলেই আওয়ামী সরকার সেটাকে জামায়াতের আন্দোলনের সাথে এক করে প্রচার করবে। যখনই জনগনের কাছে বোঝান যাবে যে বিএনপি এখন জামায়াতের কারনেই আন্দোলনের মাঠে ঠিক তখনি সরকার যুদ্ধাপোরাধী ইস্যুটা সামনে নিয়ে আসবে যাতে বিএনপিকেও যুদ্ধাপরাধীর মালাটা পড়িয়ে দেওয়া যায়।

যারা ভাবছেন জামায়াত ধংস হলে বিএনপি দুর্বল হবে তাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে বিএনপি প্রকারান্তরে শক্তিশালীই হবে যার ব্যাখা উপরের আলোচনা থেকেই পাওয়া যায়। সুতরাং সেই হিসাবমতে আওয়ামীলীগ কখনই চায় না যে জামায়াত ধ্বংস হউক। বরং তাদের চাওয়া শুধুমাত্র বিএনপি জামায়াতের বিভেদ সৃষ্টির মধ্যেই নিহিত।

এখন বিএনপি-এর ভাবনা এবং কর্মকান্ডের দিকে একটু চোখ বুলাই। আমজনতার যে অংশটা জামায়াতকে ভোট দেয় সেই অংশটার প্রতি বিএনপির চোখ আছে বলেই, নিজেদেরকে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার অভিপ্রায়েই বিএনপি জামায়াতকে সবসময়ই সাথে সাথে রাখে। এটা বিএনপির একটা অনেক বড় রাজনৈতিক চাল। অন্যদিকে স্বাধীনতা বিরোধীতার কারনে জামায়াত সঙ্গত কারনেই কোণঠাসা। এখন তারা বিএনপির মত একটা বড় দলের সমর্থন পেলে বীর দর্পে রাজনৈতিক মাঠে থাকতে পারে। আর তারা যেহেতু সাংগঠনিকভাবে অনেক বেশী শক্তিশালী, তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেদের ভিত শক্ত করে নিতে পারে যার সাক্ষর ইতিমধ্যেই তারা দেখিয়েছে। সেকারনে জামায়াতও বিএনপির সাথে জোটবদ্ধভাবে থাকা। A win win situation.

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি জামায়াতকে পুরোপুরি সমর্থন দিচ্ছে না বা দেবে না। কারন বিএনপি বুঝে ফেলেছে আওয়ামীলীগ সরকারের রাজনৈতিক চাল। আবার আমজনতাকেও তো বোঝাতে হবে যে বিএনপি সুবিধাবাদী দল নয়। তাইতো জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের আটকের পরপরই খালেদা জিয়া দলীয় কমিটির মিটিং-এ এটাকে বিরোধী দলের উপর সরকারের চক্রান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাদের অবিলম্বে মুক্তিরও দাবী করেছেন। এটা বিএনপি কেন করেছে? কারন যে কেস-এ আটক দেখানো হয়েছে সেটা যুদ্ধাপরাধী কেস নয়। সুতরাং বিএনপির অবস্থান এখানে পরিস্কার। অন্যদিকে জামায়াত যখন বিএনপিকে মাঠে নামতে বলছে তখন বিএনপি বলছে- আমরা মাঠে নামবো না কিন্তু তোমাদের সমর্থন দেব। এটা একটা রাজনৈতিক কৌশল। এখন বিএনপি মূলতঃ ‘ধরি মাছ না ছুই পানি’ প্রকারের আচরন করবে আর পরিস্থিতি পর্যালোচনা করবে মাত্র।

সুতরাং সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত কে কিভাবে আমাদের এই আমজনতাকে একটা ইলিউশনের মধ্যে রাখতে পারে। সেইদিনই আমাদের মুক্তি যেইদিন আমাদেরকে কেউ আর ইলিউশনের মধ্যে রাখতে পারবে না, পরাতে পারবে না চোখে ঠুলি উপোরন্তু চোখ রাঙ্গিয়ে চাইতে পারবো জবাবদিহিতা, আমাদের অধিকারটুকু।


Source : http://www.notundesh.com/motmotantor_news5.html

mmzaman@live.ca