বাদশাহ আবদুল্লাহর পর কি ঘটবে দেশটিতে?

আরবের শাসনভার এবং দেশটিতে কী ঘটবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার অন্ত নেই। সৌদি যুবরাজ ৮৪ বছর বয়সী যুবরাজ সুলতান বিন আবদুল আজিজ গত বছর থেকে অনেকটা অন্তরালে দিন কাটাচ্ছেন। তিনি স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমের সাথে কথা বলতে রাজি হননি। যাহোক, বর্তমান সৌদি বাদশাহর কিছু হলে ঐহিত্যবাহী দেশটির নানা গোষ্ঠির মধ্যে সংঘাত-সংঘর্ষের সূচনা হতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক আশংকা করছেন। রাজতান্ত্রিক সৌদি আরবের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে রয়েছেন আল সৌদ রাজ পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত গোত্রের সদস্যরা। এ অবস্থায় বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যু হলে এ জাতির মধ্যে প্রচণ্ড রাজনৈতিক বিশৃংখলা দেখা দিতে পারে বলে আশংকা করা হচ্ছে। সৌদি আরবের নিরাপত্তা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষমতা যথাক্রমে আশ শাম্মার, সুদাইরি, বানি খালিদ, বানি তামিন, আনজা এবং আল-আজমানের হাতে রয়েছে। তবে ধর্মীয়, নিরাপত্তা এবং রয়্যাল গার্ডের ক্ষমতার বড় অংশই রয়েছে সুদাইরি গোত্রের হাতে। আশ-শাম্মার গোত্রের হাতে রয়েছে পররাষ্ট্রনীতি ও তেল সম্পদের দায়িত্ব। অন্যান্য গোত্রের হাতের রয়েছে অর্থনীতি ও স্টক এক্সচেঞ্জের মতো বিষয়।

সৌদি আরবের বেশির ভাগ ওয়াহাবির উদ্ভব ঘটেছে সুদাইরি গোত্র থেকে। অন্যদিকে, আশ-শাশ্মার গোত্রের অপেক্ষাকৃত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে শিয়া মুসলমানদের সঙ্গে। এ গোত্রের সঙ্গে সুদাইরি গোত্রের ব্যাপক মতপার্থক্য রয়েছে।

বাদশাহ আবদুল্লাহর মা ফাহদা নিজেই প্রভাবশালী আশ-শাম্মার গোত্রের মেয়ে এবং সাবেক গোত্র প্রধান আসি সুরাইম তার বাবা। সাবেক সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজ এ গোত্রে চারটি বিয়ে করেছিলেন যা এ গোত্রের জন্য একটি বড় সুবিধা হয়ে উঠেছে। সৌদি গোষ্ঠিগুলোর ক্ষমতার দাপট নির্ভর করে বাদশাহ ও রাজ পরিবারের কত কাছে রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে কতটা ঘনিষ্ঠতা রয়েছে তার ওপর। ২০০৫ সালে সৌদি আরবের সিংহাসনে আসীন হন বাদশাহ আবদুল্লাহ। আর এ কারণে সে সময় থেকেই আশ-শাম্মার গোত্র সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

আশ-শাম্মার গোত্রের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলো সুদাইরি গোত্র। এ গোত্রের সঙ্গে অসুস্থ যুবরাজ সুলতান বিন আবদুল আজিজের রয়েছে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। তবে, সুদাইরি গোত্রের অনেকেই আশংকা করেন, ভ্গ্ন স্বাস্থ্যের কারণে সিংহাসনে বসার আগেই মারা যেতে পারেন যুবরাজ সুলতান। যুবরাজ সুলতান বিন আবদুল আজিজের মা হেসসা বিনতে আহমাদ আল সুদাইর হলেন বাদশাহ আবদুল আজিজের অন্যতম প্রভাবশালী স্ত্রী। তিনি একাধারে বাদশাহ ফাহদ ও যুবরাজ আবদুর রহমান, নায়েফ, তুর্কি, সালমান এবং আহমাদেরও মা। সাবেক সৌদি বাদশাহ আবদুল আজিজের ৩২ জন স্ত্রী ছিলেন। তাদের ঘরে বাদশাহর ৭০ জন সন্তান হয়েছে। ১৯৮২ সালের জুন মাসে আস সৌদ পরিবারের পঞ্চম শাসক হিসেবে বাদশাহ ফাহদ সৌদি আরবের সিংহাসনে বসেন। সে সময় আল সুদাইরি গোত্র বিশেষ করে ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলোতে নিজেদের ক্ষমতার উৎস পাকাপোক্ত করে নেয়। সেই থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, রয়্যাল গার্ড রেজিমেন্ট, সৌদি নিরাপত্তা সংস্থা ও দূতাবাসগুলোর বেশিরভাগ পদ সুদাইরি গোত্রের সদস্যদের মধ্যে বণ্টন করা হতে থাকে। ২০০৫ সালে সাবেক বাদশাহ ফাহদ বিন আবদুল আজিজ ইন্তেকাল করেন। সে সময় তার সৎ ভাই বাদশাহ আবদুল্লাহ ক্ষমতায় আসেন। আর এ সময় আশ-শাম্মার গোত্রের সদস্যরা সৌদি আরবের ক্ষমতার উৎসগুলো নিজেদের দখলে নিতে থাকে। ইসলাম পূর্ব সৌদি আরবে কোনো গোত্রের ক্ষমতা বিচার করা হতো সে গোত্রের লোকসংখ্যা এবং কোন কোন গোত্রের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে তার ওপর। সে মাপকাঠি এখনো অনেকটা কার্যকর রয়েছে। আর সে কারণে আশ-শাম্মার ও সুদাইরি গোত্র অনায়াসে গর্ব করে বলতে পারে- সাবেক সৌদি বাদশাহ তাদের গোত্র থেকেই বেশিরভাগ স্ত্রী পছন্দ করেছিলেন।

ওয়াশিংটনে নিযুক্ত সৌদি রাষ্ট্রদূত যুবরাজ বান্দার বিন সুলতান অপ্রত্যাশিতভাবে রিয়াদে ফিরে এসেছেন। সৌদি আরবের সব বিশ্ববিদ্যালয় হঠাৎ করে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এ সব ঘটনায় মনে হচ্ছে- দিন দিন বাদশাহ আবদুল্লাহর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে।

যুবরাজ বান্দার ২০০৫ সাল থেকে সৌদি আরবের শক্তিশালী সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি গত ২২ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বও পালন করছেন। তাকে আল সৌদ বংশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের একজন মনে করা হয়। যুবরাজ বান্দারের মা সৌদি রাজবংশের আফ্রিকান দাসি ছিলেন। যুবরাজ বান্দারের সঙ্গে মার্কিন রিপাবলিকানদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সিনিয়র ও জর্জ ডাব্লিউ বুশের শাসনামলে তিনি অত্যাধুনিক অস্ত্র-শস্ত্র সরবরাহের জন্য মার্কিন কংগ্রেসকে সম্মত করাতে পেরেছিলেন। টেক্সাসে যুবরাজ বান্দার ও বুশ পরিবারের তেল ক্ষেত্র ড্রিলিংয়ের ৫০ কোটি ডলারের ব্যবসা রয়েছে। কাজেই ৯/১১’র ঘটনাবলী নিয়ে তদন্তের অনেক আলামত নষ্ট করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন যুবরাজ বান্দার। ২০০১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংঘটিত ওই হামলায় যে ১৮ জন জড়িত ছিল তার মধ্যে ১৭ জনই সৌদি নাগরিক বলে এর আগে জানানো হয়েছে। এমন কথা শোনা যায়, জর্জ ডব্লিউ বুশের দু’দফা নির্বাচনে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করেছেন যুবরাজ বান্দার। আর এ কারণে সৌদি রাজপরিবারের প্রতি বুশ নিজেকে ঋণী বলে মনে করেন। ২০০১ সালের সন্ত্রাসী হামলার পর বুশ মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশকে সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ তোলেন। তবে, লক্ষণীয় বিষয় হলো- এ সব হামলাকারীদের নাম বা পরিচয় প্রকাশ করা থেকে বিরত ছিলেন তিনি।

সৌদি রাজবংশের ছয় হাজারের বেশি সদস্যকে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় বাদশাহ আবদুল্লাহ ইন্তেকাল করলে সৌদি আরবে প্রচণ্ড ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দেবে বলে অনেকেই আশংকা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রও বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যু সংবাদ শোনার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। একই সঙ্গে মার্কিন প্রশাসন বাদশাহ আবদুল আজিজের বংশধরদের সঙ্গে গভীর শলা-পরামর্শ করেছে। ইরাকে মার্কিন কমান্ডার জেনারেল ডেভিড পেট্রাউস এবং রিয়াদে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিয়ান ক্রোকারের ঘন ঘন সফর ও সৌদি রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তাদের শলা-পরামর্শ থেকে বোঝা যাচ্ছে- বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর বিষয় নিয়ে খুবই চিন্তিত যুক্তরাষ্ট্র। জেনারেল পেট্রাউস সৌদি জেনারেলদের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বৈঠক করেছেন। এ সব বৈঠকে পেট্রাউস সৌদি বাদশাহর মৃত্যুর পর যে কোনো ধরনের সামরিক অভ্যুত্থান করার বিষয়ে সৌদি জেনারেলদের নিরুৎসাহিত করেছেন। এদিকে, সৌদি আরবের দ্বিতীয় উপ প্রধানমন্ত্রী এবং দীর্ঘদিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৭৭ বছর বয়সী যুবরাজ নায়েফকে বাদশাহ আবদুল্লাহর উত্তরাধিকার ঘোষণার আহবান জানিয়েছেন রিয়ান ক্রোকার।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী সৌদ আল-ফয়সাল পার্কিনসন্স অসুখে ভুগছেন। অন্যদিকে, যুবরাজ বান্দার ভুগছেন লিম্ফেটিক ক্যান্সারে। এ অবস্থায় সৌদি রাজপরিবারের তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি যুবরাজ নায়েফকে পরবর্তী বাদশাহ হিসেবে দেখতে চাইছে হোয়াইট হাউস। তিনি বাদশাহ আবদুল আজিজের ১১তম সন্তান ও আল কায়েদার বিরুদ্ধে অভিযানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এ সব কারণে যুবরাজ নায়েফকে পরবর্তী বাদশাহ হিসেবে দেখতে চাইছে যুক্তরাষ্ট্র। আল সৌদ বংশের গোত্রীয় কাঠামো ও ক্ষমতা, অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে গোষ্ঠিগত প্রত্যাশা, বাদশাহর মৃত্যুতে সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা ও দেশটির যুবরাজের তৎপরতা থেকে মনে হয় সৌদি আরবে একটি রাজনৈতিক সুনামি ঘটতে যাচ্ছে যার ঢেউ মধ্যপ্রাচ্যের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়বে।

শুধু তাই নয়, সৌদি আরবে গোত্রীয় সংঘাতের কারণে দেশটি দ্বিধা-বিভক্ত হতে পারে। পূর্বাঞ্চলের অংশগুলো চলে যেতে পারে সুদাইরি গোত্রের কাছে আর পশ্চিমাঞ্চল চলে যেতে পারে আশ-শাম্মার গোত্রের কাছে। বাদশাহ আবদুল আজিজের বংশধরদের ব্যাপক দুর্নীতি ও ক্ষমতাসীন অভিজাত শ্রেণীর সঙ্গে সৌদি জনগণের দিন দিন দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে এমন ঘটনা ঘটলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।#

সূত্র : http://bangla.irib.ir/index.php/2010-04-21-08-15-03/67-2010-05-05-07-20-49/22929-2010-11-20-13-41-17.html