এক ভুলের জন্য ৬০ কোটি টাকা!

কোম্পানির সঙ্গে একশ’ কোটি টাকার কম্পিউটার কেনার চুক্তি বাতিল করায় এ জরিমানা দিতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে দায়ের করা মামলায় বাংলাদেশ হেরে গেছে। এখন কম্পিউটার ছাড়াই বিপুল অংকের এ টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দিতে হচ্ছে। সরকারের এ আর্থিক ক্ষতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে গঠিত তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিয়েছে। শিগগির জরিমানা পরিশোধের পর দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানায়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার আগের মেয়াদে ক্ষমতায় থাকাকালে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার সরবরাহ করার জন্য একটি কর্মসূচি হাতে নেয়। ক্ষমতা ছাড়ার শেষ বছরে ২০০১ সালের ৩০ জুন এ বিষয়ে নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী সে সময় চালু থাকা নেদারল্যান্ডস সরকারের ওরাড কর্মসূচির আওতায় ৯৯ কোটি ৯০ লাখ টাকার কম্পিউটার কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ টাকার মধ্যে ৫০% ছিল নেদারল্যান্ডস সরকারের এবং বাকি অর্থ সরকারের জিওবি ফান্ড বা নিজস্ব তহবিল থেকে দেয়ার কথা ছিল। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কম্পিউটার সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে নেদারল্যান্ডসের বেসরকারি কোম্পানি মেসার্স টিউলিপ কম্পিউটার্সের সঙ্গে সরকারের পৃথক একটি চুক্তিও সম্পাদিত হয়। কিন্তু বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০০২ সালের ২ এপ্রিল নেদারল্যান্ডস সরকারের সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের সম্পাদিত এ চুক্তি বাতিল করে দেয়। কারণ হিসেবে বলা হয়, বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দামে কম্পিউটার কেনার চুক্তি করা হয়েছে। বাংলাদেশের এ সিদ্ধান্তে সংক্ষুব্ধ হয়ে টিউলিপ কোম্পানি ক্ষতিপূরণের দাবিতে ডাচ আদালতে মামলা দায়ের করে। ২০০৩ সালের ১৪ মে একতরফা রায়ে বাংলাদেশ হেরে যায় এবং ক্ষতিপূরণ দেয়ার রায় হয়। পরবর্তী সময়ে সরকার আপিল মামলা দায়ের করলে সেখানেও রায় বিপক্ষে যায়। ২০০৯ সালের ২ অক্টোবর আদালতের চূড়ান্ত রায়ের ফলে ক্ষতিপূরণ প্রদান অনিবার্য হয়ে ওঠে। এর মধ্যে আদালতের রায়কে উদ্ধৃত করে মামলার খরচসহ প্রায় ৫৭ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করে টিউলিপ কোম্পানি গত ৭ এপ্রিল সরকারের কাছে চিঠি পাঠায়। এ অবস্থায় সরকার আলোচনার মাধ্যমে জরিমানার টাকা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু এ ধরনের প্রস্তাবে কোম্পানিটি সাড়া দেয়নি। একপর্যায়ে টিউলিপ কোম্পানির প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বনিু জরিমানা প্রদানের প্রতিশ্র“তি দেয়ার পর গত মাসে নেদারল্যান্ডসে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের ৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলে নেতৃত্ব দেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। অন্যান্যের মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ সিরাজুল ইসলাম, নেদারল্যান্ডসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত, অর্থ বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তিনজন পদস্থ কর্মকর্তা প্রতিনিধি হিসেবে সফরসঙ্গী ছিলেন।

সূত্র জানিয়েছে, জরিমানার টাকা কিছু কমিয়ে এনে টিউলিপ কোম্পানির সঙ্গে সম্মানজনক একটি সমঝোতা হয়েছে। তবে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, অহেতুক সরকারের এ অর্থ অপচয়ের বিষয়ে দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে রিপোর্ট দিয়েছে। রিপোর্টে এ ভুলের জন্য বিগত বিএনপি সরকার ও সংশি¬ষ্ট কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়েছে। বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. এসএ সামাদকে প্রধান করে প্রায় এক বছর আগে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, দুটি সরকারের মধ্যে কোন চুক্তি হলে তা কখনও বাতিল করা যায় না। অথচ বিগত বিএনপি সরকার ও তাদের অনুসারী সে সময়কার কিছু কর্মকর্তা এমন আÍঘাতী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এ বিষয়ে সে সময় ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য গোপন করে সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করা হয়েছিল। তাদের ভুলের কারণে সরকারকে আজ এ ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় কথা, কর্মসূচি অনুযায়ী সে সময় ৩ হাজার ৩৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১০ হাজার ৩৮৮টি কম্পিউটার দেয়া সম্ভব হলে গত ১০ বছরে হাজার হাজার শিক্ষক ও শিক্ষার্থী কম্পিউটার জ্ঞানে পারদর্শী হয়ে উঠতে পারত। এ ক্ষতি অপূরণীয়। তারা জানান, আন্তর্জাতিক আদালতের এ মামলা মোকাবেলা করতে গিয়ে এ পর্যন্ত সরকারি তহবিল থেকে প্রায় ৬ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। একাধিক টিমকে নেদারল্যান্ডস যেতে হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট সরকারি কাজের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
তথ্য সুত্রঃ যুগান্তর