শর্তের কঠিন বেড়াজালে বন্দী খালেদা

তিনি বৃত্তভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারছেন না। ক্রমশঃ জড়িয়ে যাচ্ছেন আরো কঠিন বন্ধনে।

২০০৭ সালের আজব অত্যাচারী সরকারের কালো থাবা থেকে দেশের রাজনীতি একটু একটুকরে বেরিয়ে আসলেও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া তাদের বেঁধে দেয়া বৃত্তের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন। সাম্প্রতিক সফরে যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির এক নেতা কাছে থেকে দেখেছেন অনেক কিছু। তার বর্ণনা থেকে পাওয়া যাচ্ছে, সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার মদদে একটি চৌকশ চক্র সার্বক্ষণিক ঘিরে থাকে এক সময়কার আপোষহীন এই নেত্রীকে। এ সব দেখে তার মন্তব্য, নিত্যদিন এখন আপোষ করে চলেছেন এই বয়োবৃদ্ধ নেত্রী। লন্ডনে অনেক সাংবাদিকের দৃষ্টিও এড়ায়নি অনেক ঘটনা।

খালেদার দুই ছেলে আটক হয় জরুরী-সেনা সরকারের হাতে। গোয়েন্দা সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে অনেক অজানা কথা। দুর্নীতি আরমানি-লন্ডারিংয়ের মামলা হয় অনেকগুলো। গোয়েন্দা হেফাজতে শারিরীক নির্যাতনে দু'পুত্রই অচল হয়ে পড়ে। দেখা দেয় জীবনাশংকা। আগে থেকেই খালেদার ওপরে চাপ ছিল দেশ ছাড়ার, ক্রমশঃ সে চাপ আরো বাড়তে থাকে। এ সময় সেনা গোয়েন্দার দ্বিতীয় প্রধান কর্তা প্রায়শই কারাবন্দী খালেদার কাছে বিভিন্নপ্রস্তাব নিয়ে যেতো। সবসময় তার সঙ্গে থাকত একজন সোর্স, যিনি বিএনপির সুবিধাভোগীকিন্তু পদবিহীন নেতা। এসব কাজের জন্য ঐ সোর্সের মাসোহারা ছিলো ত্রিশ হাজার টাকা। জনশ্রুতি আছে, তারেক রহমানের হাত ধরেই এই নেতা জোট সরকারের পূর্ন মেয়াদটি একটি সংস্থার প্রধান হয়ে কাটান। আপোষরফার এক পর্যায়ে ২০০৮সালের ১১ সেপ্টেম্বর  কারামুক্ত হয়ে খালেদাজিয়া আসেন স্বামীর মাজারে। তখন পর্যন্ত বেগম জিয়া জানতেন না তার সঙ্গে গাড়িতে কে যাবে। সাথে থাকা এজেন্সির লোকেরা তুলে দেয় পদবিহীন ঐ নেতাকে। এর পর থেকে তিনিই হবেন খালেদার নিত্যদিনের সহচর। গত তিন বছর দলীয় কর্মসূচি থেকে ব্যক্তিগত দেখভাল, এমনকি লেনদেন সবকিছুই এই ব্যক্তির কব্জাবন্দী। আর এর মাধ্যমে এখন তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন আলামত, যা খালেদা জিয়াকে নিত্য ভাবিয়ে তুলছে।

 এই চক্রের দ্বিতীয় ব্যক্তি অত্যন্ত প্রতাপশালী। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি না পেরুতে পারলেও বর্তমানে এই ব্যক্তি ঠিক করে দেন, খালেদা জিয়া কি বলবেন আর কি করবেন। তার পরামর্শেই খালেদার মুখ থেকে বের হয় "কাঁটা বিছিয়ে দিব।" গণমাধ্যমে প্রায়শই দেখা যায়, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের অগ্রে তার অবস্থান। যে কোন মানুষ সম্পর্কে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলতে তার জুড়ি মেলা ভার! বিএনপি সংশ্লিষ্ট যেকাউকে তিনি হরহামেশা স্তব্ধ করে দেন এই বলে, "আপনাদের জন্যই  তো ওয়ান ইলেভেন এসেছিলো।" অথচ ২০০৭ এর আগে ওপরে এই ব্যক্তি তার নিজ দাপ্তরিক এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ১/১১র শীর্ষ নিয়ামক বারী-মশিউরের অন্যতম সাঙ্গাত ছিলেন। এখনও তাদের মধ্যে যোগাযোগ বিদ্যমান। ধানমন্ডিতে একজন কর কর্মকর্তার বাসায় বিভিন্ন দলের দুষ্টগ্রহের আড্ডায়মশগুল থাকেন প্রায় রাতে। পারিবারিক জীবনে প্রথম স্ত্রীকে অপ্রকৃতিস্থ হিসাবে রটিয়ে কাজের বুয়াকে ঘরনী হিসাবে চালিয়ে নিচ্ছেন অনেক কাল।

তৃতীয় ব্যক্তিটি বয়েসে ‍অনেক নবীন। ১৯৮৫ সালে খুলনা থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হওয়া বানিজ্যের ছাত্রটি বর্তমানে পরিচয় দেন আইটি বিশেষজ্ঞ বলে। যদিও আমেরিকায় জেসিপেনিতে কাজ করার অভিজ্ঞতাই যে একমাত্র আইটি জ্ঞাণ, তা অনেকের কাছেই জানা। ২০০৮ সালে নানাবিধ পটপরিবর্তনেরপর এই ব্যক্তির মাতৃকূলের ভাই সেনাগোয়েন্দার ২য় ক্ষমতায় আসীন হন। এর পরে আর তাকে পিছু তাকাতে হয়নি। ভাইয়ের বদৌলতে শণৈ শণৈ উন্নতি। গত তিন বছরে দু'হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জন, খুলনা বিএনপির পদ দখল, কেন্দ্রীয় বিএনপির সম্পাদক, সর্বশেষে ২ কোটি টাকার বিনিময় ও এজেন্সি লিষ্টেড নমিনেশন প্রাপ্তি। খালেদা ও তার পুত্রের সবচে' আস্থাভাজন বিএনপির শক্তিশালী এক ভাইস চেয়ারম্যানকে মাসে২ লাখ টাকা বেতনে নিজ ফার্মে চাকরী দিয়ে কিনে নেন মাথাটি। বৃটেন ও আমেরিকা সফরের সকল ব্যয় এমনকি বার ও হোটেলের খরচ বহন করেন অফিসিয়াল টিমের মেম্বার হবার বিনিময়ে। এজেন্সির সফল মিশন শেষ করে এখন প্রচার করা হয়, তিনি নাকি খালেদা ও তারেকের যথেষ্ট আস্থাভাজন!

তাহলে কি টাকা থাকলেই সব হয় এখানে? এমন প্রশ্ন অনেকের। ছেলেদের গোপনীয়তা গোপন রাখার শর্তে প্রতিদিন তেতো ওষুধ গিলছেন খালেদা। বারমুডার ট্রায়াঙ্গলেরমত'শসত' চক্রে বেগম জিয়ার সবকিছু ক্রমশঃ হারিয়ে যায়। অবস্থা এমন যে, আজকাল তিনি নিজের গৃহভৃত্য নির্বাচনের ক্ষমতাও হারিয়েছেন। দশ বছরের পুরাতন গৃহকর্মী, যে কিনা বিনা অপরাধে বছরখানেক খালেদার সাথে জেলখেটে সেবা করেছে তাকেও সরিয়ে দিয়ে চক্রটি নিজেদের পছন্দের নতুন বিশ্বস্ত লোক বসিয়েছে। এই চক্রকে রাজী না করিয়ে দেশে বিদেশে কোথাও কেউই খালেদার দেখা পান না, একান্তে আলাপ তো দূরের কথা। সাক্ষাৎকালে কাজের উছিলায় ঘাড়ের পাশে যেকোনো একজন পালা করে থাকবেই। গুলশান অফিসে একান্তে যত আলাপ করেন খালেদা, তার সবটাই বাইরে থেকে উচ্চ প্রযুক্তির মাধ্যমে শুনে থাকে এরা এবং যথারীতি জায়গামত পৌছে যায়। গুলশানে খালেদার বাসা ও অফিসে উচ্চ প্রযুক্তি স্থাপনের প্রয়োজনীয় ওয়ারিং ও মেরামত নিজ তদারকিতে সম্পন্ন করে গ্রুপের এক নম্বর ব্যক্তিটি। সম্প্রতি গুলশান অফিসে এক ব্যক্তি বেগম জিয়ার সাথে একান্তে কথা বলে বেরিয়ে আসার সাথে সাথেই চক্রের প্রথম ব্যক্তিটি চার্জ করে বসেন, কেন এসব বলে এসেছেন। একথা শুনে সাক্ষাৎপ্রার্থীটি হতবাক হয়ে যান।

বিএনপির কেন্দ্রীয় অনেক নেতার কাছে এসব বিষয় গোলমাল ঠেকছে দীর্ঘদিন ধরে। অনেকে প্রতিবাদিও হয়েছিলেন। ঘাত-প্রতিঘাতে অবশেষে সবাই রণে ভঙ্গ দিয়েছেন- নেত্রীর কষ্ট আর বাড়াতে চান না বলে। কেউ আবার তুচ্ছ কারনে বার বার কারাবাস শেষে মুচলেকায় বেরিয়েছেন। বেশী সরব একজন তো একেবারে যুদ্ধাপরাধ মামলাবন্দি। এত কিছুর পরেও নেতাকর্মীরা দুষ্টগ্রহ ভাঙ্গার উপযুক্ত সময়ের জন্য অপেক্ষামান।

প্রশ্ন হলো, বেগম জিয়া কি আর কখনো বেরিয়ে আসতে পারবেন, সোনার শিকলের এ কারাগার থেকে?