শেয়ারবাজার ছিল বলেই ব্যাংক কম্পানির ডিরেক্টররা এত ধনী হতে পেরেছেন

আবু আহমেদঃ আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাংক স্থাপনের জন্য অনেক চাহিদা। তবে ব্যাংক ব্যবসা যে কেউ শুরু করতে পারে না। ব্যাংকের সাইনবোর্ডটি ঝোলাতে হলে নিয়ন্ত্রক বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সতর্ক হতে হয়।

কারণ ব্যাংকের পুঁজি কম থাকলে এবং ব্যাংক ব্যবসা ঠিকমতো রেগুলেট না হলে যেকোনো সময় ব্যাংক তথা কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংকের ব্যবসা ফেল করতে পারে। তখন যাঁরা ব্যাংকে অর্থ রেখেছেন বা আমানতকারীদের মাথায় হাত পড়বে। আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাংক আমানতের ইনস্যুরেন্স কাভারেজ নেই। থাকলেও যৎসামান্য। ফলে এই অর্থনীতিতে ব্যাংক ফেল করলে আমানতকারীরাই সবচেয়ে বড় লোকসানের সম্মুখীন হন। কিন্তু বেঁচে যান ব্যাংক মালিকরা। তাঁরা তো ৫০০ কোটি টাকার পুঁজি দিয়ে আমানতকারীদের থেকে নিয়েছেন এর ২০ গুণ টাকা। অন্যদিকে ব্যাংক কয়েক বছর ব্যবসা করতে পারলে ব্যাংক উদ্যোক্তারা বড় ধরনের মুনাফা ঘরে তুলতে পারেন।

তাঁরা সমাজেও নাম কুড়ান। তাঁদের ছবি অহরহ সংবাদমাধ্যমেও আসে। তাঁরা তাঁদের ভিজিটিং কার্ডে লেখেন অমুক ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ডিরেক্টর। অতি সহজ ব্যবসা, পুঁজি কম, লাভ বেশি।

প্রথমদিকে ব্যক্তি খাতে ব্যাংক স্থাপন করার জন্য জনপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা হলেই চলত। সেই প্রথম দিক হলো ১৯৮৪-৮৫-এর সময়, যখন আমাদের প্রাইভেট সেক্টরে ব্যাংক স্থাপনের সুযোগটাকে খুলে দেওয়া হলো। আর সেই সময়েই প্রথম জেনারেশনের বাণিজ্যিক ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক এবং আরব-বাংলাদেশ ব্যাংক বা এবি ব্যাংক স্থাপিত হলো। এগুলোর ইক্যুইটি ক্যাপিটাল তথা কোর ক্যাপিটাল ছিল মাত্র পাঁচ কোটি টাকা বা এর কাছাকাছি কোনো অঙ্ক। তখন ২০ জনে মিলে একটি ব্যাংক স্থাপন করলে জনপ্রতি পড়ত গড়ে ২০-২৫ লাখ টাকা করে। কোনো উদ্যোক্তা বেশি পুঁজির জোগান দিলে অন্যরা কম দিলেও চলত। তবে তখন ব্যাংক স্থাপন করার জন্য ব্যবসায়ীদের অত আগ্রহ ছিল না। দুই-তিনজনে উদ্যোগ নিয়ে অন্যদের বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করাতেন। ওই সময় ইসলামী ধাঁচেও দুটি ব্যাংক স্থাপিত হয়। প্রথমটি হলো, আজকের ব্যক্তি খাতের বৃহত্তম ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং কিছুদিন পর আল বারাকা ব্যাংক লিমিটেড। পরের ব্যাংকটি কয়েকবার নাম পরিবর্তন করেও ব্যবসায় সফল হতে পারেনি। সর্বশেষ এই ব্যাংকের নাম হলো আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে এই ব্যাংকের শেয়ারের বেশির ভাগ মালিক বিদেশিরা_মালয়েশিয়ার কিছু লোক। তাঁরাও ব্যাংকটিকে ভালো করতে ব্যর্থ হয়েছেন। শুনেছি তাঁরা ব্যাংকটি ছেড়ে দিতে চাচ্ছেন। এই ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকায় প্রবলেম ব্যাংক হিসেবে চিহ্নিত আছে।

বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এমনিতেই অনেক ব্যাংক হয়ে গেছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোসমেত ৫২ কি ৫৫টি ব্যাংক। এত ছোট অর্থনীতিতে এত ব্যাংকের প্রয়োজন আছে বলে কোনো অর্থনীতিবিদ এবং ব্যাংকবিশ্লেষকই মনে করেন না। তবুও সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকার 'রাজনৈতিক বিবেচনায়' আরো কয়েকটি ব্যাংকের অনুমতি দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেওয়া বিপজ্জনক। এটা ভবিষ্যতের জন্যও একটা খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। অন্য দেশে সরকার ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি দেয় না, দেয় রেগুলেটর, যেমন আমাদের দেশে বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু আমাদের অর্থনীতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীন হলেও সেটা অনেকটা কাগজে-কলমে। সরকারের কোনো নীতির তীব্র বিরোধিতা করেছে এমনটি আমরা শুনতে পাই না। যেমন সরকার আজকে বড় ঋণ করে চলেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ব্যাংকিং বাজার থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক বাধা দিতে পারে। কিন্তু সেই বাধাটা সরকারি ঋণের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয় না। যা হোক, নতুন ব্যাংক স্থাপনের অনুমতি 'নিজদের' কিছু লোক পাবে। তবে দরখাস্ত পড়ে আছে ডজনে ডজনে। কেন ব্যাংক স্থাপনের জন্য এত আগ্রহ? সেই একটাই কারণ পুঁজি কম, লাভ বেশি।

১৯৯৩ পর্যন্ত ব্যাংক উদ্যোক্তারা এই ব্যবসা থেকে অত লাভ করতে পারেননি। লাভটা শুরু হয়েছে ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে। আমাদের মনে আছে আমরা শেয়ারবাজার থেকে ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ার কিনেছি ১০০ টাকার অভিহিত মূল্যের শেয়ারকে ৬৫ টাকায়। প্রায় একই মূল্য ছিল উত্তরা ব্যাংকের ও অন্যান্য প্রথম জেনারেশনের ব্যাংকের শেয়ারের বাজার মূল্য। তখন ব্যাংক এত লাভ করতে শেখেনি। তখন ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হওয়ার জন্য এত প্রতিযোগিতাও ছিল না। আজকে ব্যাংক বিভিন্নভাবে লাভ করা শিখে গেছে। যতই বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের হাত-পা বাঁধতে চেষ্টা করছে তার পরও তারা নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করছে ব্যাংকের লাভ বাড়ানোর জন্য। ব্যক্তি খাতের ব্যাংকগুলো ১০-১২ লাখ টাকা মাসে বেতন দিয়ে 'উপযুক্ত' এমডি হায়ার করছে। বোর্ড সদস্যদের একটাই কথা, ব্যাংকের জন্য বেশি লাভ করতে হবে। তাই ব্যাংককে সাজানো হচ্ছে দর্শনীয়ভাবে। অর্থের অভাব নেই। উদ্যোক্তা ডিরেক্টররা ইতিমধ্যে পাঁচ লাখ টাকার শেয়ারকে ১০ কোটি টাকা বেচেছে। তাঁরা পুঁজির জোগান দিচ্ছেন। তাঁদের সঙ্গে আছে শেয়ারবাজারের ৩৩ লাখ ক্ষুদে বিনিয়োগকারী, যাঁদের কাছে ব্যাংক উদ্যোক্তারা আবার অতি চড়া মূল্যে শেয়ার বিক্রি করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও খুশি। কারণ ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারের অতি রমরমা অবস্থার কারণে অতি বড় পুঁজির জোগান দিতে সক্ষম হয়েছে। লাভ দুই দিকেই; এক, উদ্যোক্তারা শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন কালো টাকা বিনিয়োগ করে। দুই, বাসেল-২-এর শর্তানুযায়ী ব্যাংক অতি তাড়াতাড়ি বড় ইক্যুইটি ক্যাপিটাল তথা শেয়ার ক্যাপিটালের জোগান দিতে পেরেছে। হায়রে শেয়ারবাজার! তুমি অতি তুঙ্গে বলে তোমাকে ব্যবহার করে কিছু লোক কিভাবে অত তাড়াতাড়ি ধনী হলো, আর ব্যাংক ব্যবসাও অত বড় পুঁজি সংগ্রহ করতে পারল! তুমি না থাকলে ব্যাংক স্থাপনের কারো আগ্রহ থাকত না। তুমি না থাকলে ব্যাংকিং গ্রুপের এত উজ্জ্বলতাও চোখে পড়ত না। সেই শেয়ারবাজারকে অবশ্য বাংলাদেশ ব্যাংক তার কিছু পলিসি পরিবর্তনের মাধ্যমে চাঙ্গা করতে চাইছে। আইএমএফ বলেছে, শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগ তুলে নাও। অমনি বাংলাদেশ ব্যাংক রেগুলেটরি অর্ডারকে কড়াকড়ি করল। অথচ এই ব্যাংকগুলোই ২০০৯ এবং ২০১০-এ শেয়ারবাজারকে ব্যবহার করে লাভের ৫০-৬০ শতাংশ অর্জন করেছে। যা-ই হোক, আমরাও চাইনি ব্যাংক অত জোরালোভাবে শেয়ারবাজারে জড়িত হোক। কিন্তু সমস্যাটা হলো এমন অতিমূল্যে বিক্রি শেয়ারগুলো ৩৩ লাখ ক্ষুদে বিনিয়োগকারীদের হাতে। অনেকে আবার ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছেন। সত্য হলো, তাঁরা ছিলেন বলেই শেয়ারবাজার অতি চাঙ্গা ছিল। তাঁরা ছিলেন বলে ১৯৯৭-১৯৯৮ ব্যাংক ব্যবসা শুরু করেও অনেক ব্যাংক উদ্যোক্তা এত ধনী হতে সক্ষম হয়েছেন। এসব আয়ের ওপর আবার ট্যাঙ্ কনশেসনও ছিল। বড়লোক ট্যাঙ্ কনশেসন পান, কর ফাঁকি দিতে পারেন, আবার কালো টাকাকেও সাদা করতে পারেন। তা হলে অর্থনীতির গরিবদের অবস্থা কী? বাংলাদেশে এত তাড়াতাড়ি এত লোক যে কোটিপতি হলেন এর একটি অন্যতম উর্বর ক্ষেত্র হলো ব্যাংক ব্যবসা।