ইন্টারনেট ও মুঠোফোনের অপব্যবহার : প্রতিরোধে চাই সম্মিলিত প্রয়াস

মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন, শাবিঃ তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে ইচ্ছে করলেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খুব সহজে যোগাযোগ করা যায়। প্রযু্িক্তর উন্নতির ফলে এমনটাই সম্ভব হয়েছে। সব প্রযুক্তির সুফলের পাশাপাশি খারাপের দিকও রয়েছে। এটা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। মোবাইল ফোন একবিংশ শতাব্দীর এমন প্রযুক্তি যা হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে পুরো দুনিয়াকে। কথা বলার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্রাউজিং, গেমসহ নানা কিছুই করা যায় ছোট এ যন্ত্রটি দিয়ে। কয়েক বছর থেকে মোবাইল ফোন সহজলভ্য হওয়ায় সবশ্রেণী পেশার মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে। মোবাইল ফোনের অপব্যবহার রোধ করতে পারলে এর সুফল নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু তা কী হচ্ছে? মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের কারণে ভয়াবহ সমস্যার নিমজ্জিত হতে চলেছে সমাজের তরুণ-তরুণীরা। তারা এ সমাজেরই কারো ভাই, কারো বোন, কারো পুত্র বা কারো কন্যা। বর্তমানে এ যন্ত্রটি বক্তি তথা সমাজ জীবনে বয়ে নিয়ে আসছে বিপজ্জনক এক অপসংস্কৃতি।

মোবাইল ফোন ও ইন্টারটের অপব্যবহারের শিকার হচ্ছে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়েরা, বিশেষ করে তরুণীরা। আর আতঙ্কের খবর হলো, মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে মেয়েরা। তাদের কেউ স্কুলে, কলেজের কিংবা উচ্চতর বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করে নিজের জীবনকে ধ্বংস করতে দ্বিধা করে না। আর অনেক সময় বাধ্য হয় আত্মহত্যার দিকে পা বাড়াতে। তথ্য প্রবাহের এ যুগে ইন্টারনেটকে অস্বীকার করার মত সুযোগ নেই। প্রয়োজনে এর ব্যবহার নিশ্চয়ই কেউ বাধা দিবে না। কিন্তু যখন একজন অপ্রাপ্ত ছাত্র কিংবা ছাত্রী এর অপব্যবহার করে তখন নিশ্চয়ই এটাকে ভালো চোখে দেখবে না। আমাদের সমাজে একটি জিনিসের প্রবণতা লক্ষ করা যায়, কোন কিছুর শুরুতে না বুঝে শেষে গিয়ে উপলদ্ধি করতে পারে। তখন সময় থাকে না সমাধানের। হোক সেটা ব্যক্তিগত কিংবা সামাজিকগত ব্যাপার। ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল ফোনের অপব্যবহারকে কোনভাবে তুচ্ছ ভাবার সুযোগ নেই। সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য এসবের অপব্যবহারকে রুখতে হবে। যথাযথ পদক্ষেপ নেয়াটা এখন সময়ের দাবি বলে মনে করছেন সমাজ সচেতন ব্যক্তিরা।

পত্রিকার মাধ্যমে জানা গেছে, বাংলাদেশের মোবাইল ফোন গ্রাহকদের মধ্যে এখন অর্ধেকেরও বেশি অপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়ে, যাদের বয়স ১২-১৬ বছরের ভেতর। দেশের মোবাইল কোম্পানিগুলোর সম্মিলিত গ্রাহক সংখ্যা আট কোটিরও উপরে। এর মধ্যে বাছ-বিচার করলে বেরিয়ে আসবে প্রায় তিন কোটিরও বেশি অপ্রাপ্ত বয়স্ক গ্রাহক যারা মোবাইল ফোন ব্যবহারের অযোগ্য।  ইদানিং ১০ বছরের ছেলেমেয়েদের হাতেও মোবাইল ফোন দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ সেটই মাল্টিমিডিয়া সিস্টেমের। সরকারের ১৮ বছরের নিচে কারো কাছে সিম বিক্রি নিষেধ থাকা একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী ভূয়া কাগজের মাধ্যমে সিম বিক্রি করছে। এখবর সচেতন নাগরিকদের আতঙ্কিত করেছে। পাশাপাশি শহরের বিভিন্ন মার্কেটে গড়ে উঠেছে সাইবার ক্যাফে ব্যবসা। এখানের অধিকাংশ গ্রাহক স্কুল, কলেজগামী শিক্ষার্থী। সহজেই অনুমেয় এরা এখানে বসে কতটুকু শেখার জন্য প্রবেশ করছে। দেশের অপরাধের ধরন যে বদলাচ্ছে তা পত্রিকার খবরেই জানা যাচ্ছে। উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েরা যেমন মোবাইল কোম্পানির গ্রাহক তেমনি কোম্পানির লোভনীয় ও চটকদার অফারও দায়ী করা যায়। ফোন কোম্পানিগুলো দিনের চেয়ে রাতে কথা বলার জন্য বিভিন্ন অফার দিয়ে থাকে। এক সময় ডিজুজ সিম দিয়েতো ফ্রিই কথা বলা যেত। ফলে তরুণ-তরুণীরা প্রয়োজনের চেয়ে প্রেমালাপের দিকেই বেশি ঝুঁকছে। সাথে সাথে টিভিতে কোম্পানির লোভনীয় বিজ্ঞাপনকেও দায়ী করা যায়। বন্ধ সিম চালু করলেই এতো মিনিট বোনাস! এটা বুঝতে কারো কষ্ট হয় না প্রয়োজনের কোন সিমই কখনো বন্ধ থাকে না। অতিরিক্তি কিংবা অপ্রয়োজনীয় সিমই বন্ধ থাকে। কিন্তু কোম্পানিগুলো চালু থাকা সিমে কোন বোনাস না দিয়ে বন্ধ সিমে বোনাস দেয়ার গোপন রহস্য কারো অজানা থাকার নয়। সরকার কিংবা নিবন্ধনকৃত প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারে কৈফিয়ত জানতে চেয়েছে কিনা সেটা জানা যায়নি। রাষ্ট্র বহুজাতিক মোবাইল কোম্পানিগুলো যেনতেনভাবে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিয়েছে। তারা দ্বিধাহীনভাবে ব্যবসা পরিচালিত করছে। আপনার-আমার পরিবারের কী ক্ষতি হলো অথবা রাষ্ট্র কী ক্ষতির সম্মুখীন হলো এটা তাদের ভাবার সময় নেই। যে সিম চালু রেখে প্রতিদিনই খরচ করছে সেসব সিমে বোনাস না দিয়ে বন্ধ সিমের প্রতি তাদের বেশি মায়াকান্না কেন। এরকম প্রশ্ন করলে সেটা আদৌ অযৌক্তিক হবে না। প্রয়োজনে তারা চালু সিমে বোনাস কিংবা কলরেট হ্রাস করা করতে পারে। কিন্তু আসল গ্রাহকদের পেছনে ব্যয় না করে বন্ধ থাকা সিম কিংবা লোভনীয় বিজ্ঞাপনের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় কাদের স্বার্থে? রাত বারোটার পর অধিকাংশ কর্মজীবী মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের দেশের ফোন কোম্পানিগুলোর কলরেট তখন পয়সার ঘরে। কিন্তু রাত বারোটার পরে যে অফার দিচ্ছে সেটা কী দিনের বেলায় দিতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। পার্শ্ববর্তী দেশে যখন পঁচিশ পয়সায় সব সময় কথা বলা যায় তখন আমাদের দেশে এরাও পারে। শুধু রাষ্ট্র কিংবা কোম্পানিগুলোকে একতরফা দায়ী করা চলে না। পরিবারেরও কিছু দায়-দায়িত্ব রয়েছে। পরিবারের অভিভাবকদের সব সময় খেয়াল রাখা প্রয়োজন সন্তান মোবাইল ফোন কিভাবে ব্যবহার করছে। যাকে মোবাইল ফোন কিনে দিচ্ছেন তার কতটুকুই বা প্রয়োজন। সে প্রয়োজন বড়দের ফোন দিয়ে মেটানো যায় কিনা। তাদের ফোনালাপ কাদের সাথে? সন্দেহ হলে তার ওপর নজরদারী এবং শাসানো যেতে পারে। এও সম্ভব না হলে তার ফোনালাপ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক রেকর্ডও করা যেতে পারে। সমাজে অপরাধ প্রবণতার দায় কিছুটা হলেও পরিবারের ওপর বর্তায়। স্বাধীনতা আর স্বেচ্ছাচারিতা সমান নয় এরকম কথা প্রত্যেক সদস্যকে বুঝতে হবে এবং বোঝাতে হবে। পরিবার থেকেই প্রথমে সন্তানের মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায় ও ভাল-মন্দের শিক্ষা দিতে হবে।

ইন্টারনেট কিংবা মোবাইল ফোনের অপব্যবহারের যে  অপসংস্কৃতি তা যেন সমাজের রন্ধে রন্ধে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি সব মহলের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। গণসচেতনতার মাধ্যমে এসবের অপব্যবহারের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরতে হবে। ঘুণেধরা সমাজকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্যে দেশের শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবীসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নতুবা নতুন প্রজন্মকে অপসংস্কৃতির রাহু থেকে রক্ষা করা যাবে না। সবার সম্মিলিত প্রয়াসই পারবে এসবের ক্ষতিকর দিক থেকে রক্ষা করতে।