ইন্টারনেটের ফাঁদে চলছে প্রতারণা, বিকৃতি- ওয়াচডগ

মহসিন বলেন, কেন আমি চিকিৎসার জন্য বাইরে যাবো আর তোমাকে জানাবো না তা কি করে হয়। তাছাড়া তোমার ভাবী তো আছে ঘরে। তার কাছ থেকে তো তুমি খোঁজ নিতে পারতে। তবে ভাবীর নাম্বারটা হারিয়ে গেছে। দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব তাদের দু’জনের। চাকরি সূত্রে দূরত্ব বেড়েছে। তবে নিয়মিত মোবাইল ফোন ও মেইলে যোগাযোগ ছিল। হঠাৎ ফোনটা পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভুতুড়ে ঘটনার কোন কারণ খুঁজে পায় না দু’বন্ধু। তবে টিনা নামে মেয়েটির ঘটনাটা ভিন্ন। বাপ নেই। মা-মেয়ে দু’জনে থাকে উত্তরার একটি ফ্ল্যাটে। বড় ভাই আমেরিকায় থাকে। বড় ভাইয়ের পাঠানো টাকাতেই মা-মেয়ের সংসার চলে। এভাবে ভালই চলছিল। ভাইয়ের পাঠানো টাকায় জীবনে ছন্দ ফিরে আসছে। বাপ মারা যাওয়ার পর অভাব অনটন। সেসব তিক্ততা যখন স্মৃতির পাতা থেকে মুছে যাচ্ছে তখনই ঘটে নতুন বিপত্তি। অনার্স পড়ুয়া মেয়েটির বন্ধুত্ব তো থাকতেই পারে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে। মেয়ে বন্ধু তো আছেই। বাসায় কম্পিউটার, ইন্টারনেট। এই সূত্রে দেশ-বিদেশে অনলাইনে বন্ধুত্ব। কত বন্ধু। স্রেফ আনন্দে মেতে থাকা। সময় কাটানো। অনেকের সঙ্গে ছবির লেনদেন ঘটে অনলাইনে। তবে সামাজিক নেটওয়ার্কের নামে এসব ঘটনাই তার জীবনে হঠাৎ কাল হয়ে দেখা দেয়। তার আপন ভাই তাকে চিনতে পারে না। ওয়েবসাইটের কয়েকটি পর্নো ভিডিওতে তার বোন। নানা পর্নো ছবিতেও। অবিশ্বাস্য ঘটনাই। প্রথমে ভাইয়ের চোখ তো ছানাবড়া। তারপর বোনের ছবি মিলিয়ে দেখে। একই নাড়িছেঁড়া দুই ভাই বোনের চেহারাটি তো আর কেউ কারও অচেনা নয়। তারপর মাকে ফোন করে আনিস। জানতে চাই তার আদরের বোন কোথায় যায়, কি করে। মাকে বোঝানোর চেষ্টা করে এসব কাহিনী। মা সবকিছু বোঝে না। তারপর মা-মেয়ে আলাপ হয়। মেয়েটি মায়ের মুখে শুনে পাত্তাই দেয়নি। মার কথায় অন্যদিনের চেয়ে একটু তাড়াতাড়ি কাজ সেরে নেটে বসে। তারপর দেখে বিভিন্ন পর্নোসাইট। আগে কখনও যেখানে ক্লিক করার আগ্রহও ছিল না। তবু দেখে। পায় না। তার বান্ধবীদের ফোন করে। তবে যাদের ফোন করে তাদের অনেকের এসব নেটওয়ার্ক সম্পর্কে কোন খোঁজখবর নেই। এক বান্ধবী জানায়, আমি তোকে কিছুৰণের মধ্যে যোগাড় করে দিচ্ছি। যোগার হয়েও যায়। তারপর এসব ঠিকানায় ক্লিক করে মেয়েটি। এর মধ্যে তার বান্ধবীর কৌতূহলও আর থামে না। বান্ধবীও ক্লিক করে। একজন দেখে নিজের দুর্গতি। আর অন্যজন বান্ধবীর এসব দেখে থ বনে যায়। তবে বান্ধবীর তো বিশ্বাস হয় না। মেয়ে তো পারলে মাটি দু’ভাগ করতে চায়। মা তো বোঝে না। কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ওয়েবসাইট নিয়ে মায়ের কোন আগ্রহ নেই। তবে ছেলেটি ছাড়ছে না মাকে। এদিকে মেয়ের আত্মহত্যার চেষ্টা। এর মধ্যে মা ভাইবোন দু’জনকে ফোনে আলাপ করতে জানায়। মেয়ে কি বলবে ভাষা পায় না। কোন জবাব দিতে পারে না। গগনবিদারী কান্না। পৃথিবীর একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বোনের অসহায় কান্নার শব্দে ভাইটিও নির্বাক হয়ে পড়ে। তবে আর কিছু করার ছিল না। তখন অনেকে জেনে গেছে। বান্ধবীর কাছ থেকে। যার কাছ থেকে ওয়েবসাইটের ঠিকানা নিয়েছিল। বান্ধবী বাড়তি ইচ্ছা নিয়ে কাউকে জানায়নি। সাবধান করার জন্য অন্য বন্ধুদের বলতে গিয়ে তাদের আকর্ষণ বেড়েছে। তারপর ঢিঢি পড়ে গেল। তবে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া এক মেয়ের ঘটনা অন্য। ঢাকার এক কলেজে পড়ে সে। সহপাঠী এক ছাত্রের সঙ্গে প্রেম করে। প্রেম করার পর সম্পর্ক শারীরিক পর্যায়েও গড়ায়। এই করতে গিয়ে বন্ধুটি ঘটায় অন্য ঘটনা। তার ওই সময়ের ঘটনাগুলো সে মোবাইলে ভিডিও করে। একপর্যায়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটে পাঠিয়ে দেয়। তারপর গোটা কলেজে এ ঘটনা জানাজানি হয়ে যায়। দেখাদেখিও। কলেজ কর্তৃপৰের কানে যায়। কলেজ কর্তৃপৰ মেয়েটিকে ডাকে। কোন অনুশোচনা কিংবা অনুতাপ ছাড়াই সে জবাব দিয়েছিল- সরি, স্যার আমার ভুল হয়ে গেছে। পরে মেয়েটিকে টিসি দিয়ে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয়। আর ছেলেটি লাপাত্তা।

 

সাকিব নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে সেনেগাল থেকে একটি ই-মেইল অসে। অফিস থেকে ফেরার পর কম্পিউটার আর ইন্টারনেট ছাড়া অন্য কোন বিনোদন নেই। সারাদিন পার করে দেয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে সার্চ করে। হঠাৎ তিনি দেখেন একদিন তার ই-মেইল বঙে নতুন একটা ই-মেইল ঠিকানা। সুদানের একটি মেয়ে ই-মেইল করেছে। লিখেছে তোমার ছবি ও বায়োডাটা দেখে আমার ভাল লেগেছে। তোমার পছন্দ-অপছন্দের কথা জানাও, আমি জানাবো। তোমার ছবি পাঠাও, আমার ছবিও পাঠাব। সাকিব কোন ছবি দেয় না। তবে ছোট একটা ই-মেইল করে বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখে। এরপরই মেয়েটি ঝড়ের মতো ছবি পাঠায়। কাটছাঁট পোশাকের। ছবি দেখে ই-মেইল পড়ে তার একটু কৌতূহল বাড়ে। তিনি দু’চার শব্দ লিখে আবার মেইল করেন। এর মধ্যে মেয়েটি একটা বিশাল কাহিনী লিখে পাঠায়। কাহিনী এরকম- সে সুদানি নাগরিক। পশ্চিম সুদানে তার বাবা ব্যবসা করতো। সেখানে বিদ্রোহীরা তার মা ও বাবাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। তবে সে পালিয়ে বেঁচে যায়। এখন সেনেগালের একটা মিশনারি রিফিউজি সেন্টারে সে থাকে। যেখানে আছে সেটাও অপরাধপ্রবণ এলাকা। খাবার নেই, পানি নেই। এই পরিবেশে থাকলে সে যে কোন সময় মারা যেতে পারে। কারণ, বিদ্রোহীরা তাকেও খুঁজছে। এছাড়া লন্ডনের স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে তার বাবার বিশাল টাকা আছে। টাকা উদ্ধার এবং তার বাঁচা দু’টোই জর্বরি। এজন্য সাকিবের কাছে আবেদন করে মেয়েটি। সে এ-ও জানায়, দ্র্বত এখান থেকে সরতে না পারলে সে বাঁচবে না। সুদানে ফিরে যাওয়ার সুযোগও তার নেই। এ সময় সে ব্যাংকের টাকা তোলার আইনি সহায়তার জন্য উকিলের সঙ্গে যোগাযোগ করতে একটা ই-মেইল ঠিকানা দেয়। তার বাবার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার জানায়। ব্যাংক কর্মকর্তার ই-মেইল ঠিকানা দেয়। এ সময় উকিল ব্যাংক থেকে টাকা ওঠানোর আইনি সহায়তার খরচ উলেৱখ করে সাকিবের কাছে দু’হাজার ডলার চায়। এরপর সাকিব বিভিন্ন ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখে এসব অসংখ্য কাণ্ডকীর্তি। অসংখ্য মেয়ে এভাবে প্রতারণা করছে সারা দুনিয়ায়। তবে সাকিব জানায়, আমি আর অগ্রসর হইনি। তবে সারোয়ার নামে এক এনজিও কর্মকর্তার কাছে ই-মেইল আসে ৫ লাখ ডলারের একটি লটারির পুরস্কার বিজয়ের ঘোষণা। লটারির পুরস্কারটা পেতে হলে তাকে ১টি ফরম পূরণ করে ৩শ’ ডলার পাঠাতে হবে। সারোয়ার তাই করে। তবে নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার পর তাদের খোঁজ করে। কিন্তু তারা আবার নতুন অফার দেয়। তবে সারোয়ার এখানেই থেমে যায়। বোকা ও লোভী বলে ধরা খাবে- এজন্য কারও কাছে আলাপটি উত্থাপন করেনি। তবে ধরা খাওয়ার পর বিভিন্ন বন্ধুকে জানায়।

এভাবে এক বোন ও তার ভাইয়ের সম্পর্ক, মহসিন ও হাবিবের বন্ধুত্ব, কলেজ পড়ুয়া মেয়েটি, মিজানের টাকা লটারির নামে টাকা বৱ্যাকিং, রিফিউজি নামে কথিত সুদানির ফাঁদপাতা- এমন অসংখ্য মেয়ে, সারোয়ার, কলেজ পড়ুয়া মেয়ে ওয়েবসাইট, ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হচ্ছে। শুধু আর্থিক প্রতারণাই নয়, বাঙালির যে সামাজিক পরিণতি তাতে এসব মেয়ের জন্য অপেৰা করছে এক ভয়াবহ বিপর্যয়। অন্যদিকে সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামোতে আঘাত হানা হচ্ছে। আর অহরহ এভাবে ফাঁদ পাতায় দেশের তথ্য প্রযুক্তি ব্যবস্থার দুর্বলতা ভারি হয়ে উঠছে।

সূত্রঃ দৈনিক মানবজমিন, Thursday, 10 December 2009
http://www.mzamin.com/index.php?option=com_content&task=view&id=1854&Ite…