গুপ্তহত্যায় পুলিশের চাঁদাবাজী! – কালকিনিতে ১০টি পরিবারের স্বজন হারানো কান্না থামছে না

মোঃ বিল্লাল হোসেন, কালকিনিঃ ভ্যান চালক মতু খলিফা, ইজিবাইক চালক হাসান বেপারী, ক্ষুদ্র ব্যবাসয়ী কালম সরদার, স্কুলছাত্রী চম্পা আক্তার, গৃহবধূ বাকপ্রতিবন্ধি হাওয়ারুন্নেসা, কৃষক মোসলেম আলী সরদার ও সদ্য বিবাহিত যুবক ইমাম হাসান, এরা সবাই গুপ্তহত্যা শিকার হয়েছেন গত ১০মাসে। এই হত্যাকাগুলোকে পুঁজি করে মাদারীপুরের কালকিনি থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রেপ্তার বাণিজ্য, তদন্তের নামে হয়রানি, নির্যাতন, হুমকী ও চাঁদাবাজীর অভিযোগ উঠেছে। হত্যার প্রকৃত রহস্য উৎঘাটন করতে না পারলেও পুলিশ কয়েকটি মামলায় প্রতিপক্ষকে জড়িয়ে আদালতে চার্জশিট দিয়েছে। ফলে অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা আধাঁরেই থেকে যাচ্ছে, এর ফলে ঘটছে একের পর এক গুপ্তহত্যার ঘটনা। বিষয়টি আইনশৃংখলা কমিটির সভায় উত্থাপিত হলে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করা হয়। তারপরও প্রতিদিনই খুন, সংঘর্ষ, হামলা-পাল্টা হামলা, বাড়িঘর ভাংচুর, লুটপাট, ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, বোমার বিস্ফোরণ ও প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া বেড়েই চলছে।

ভূক্তভোগী পরিবার, লিখিত অভিযোগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২৪ মার্চ এলায়েতনগর ইউপির রায়পুর গ্রামে গুপ্তহত্যার শিকার হয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কালাম সরদার (২৫)। এ ঘটনায় একই এলাকার ছোরাব বেপারীর স্ত্রী শিল্পি বেগম সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার হওয়ার ২ মাস ২৪ দিন পর জামীনে বের হয়ে প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে তার উপর নির্যাতনের করুণ কাহিনীর বর্ণানা দেন। তিনি বলেন, ‘হত্যাকান্ড সম্প্রর্কে জিজ্ঞাসা করলে কিছুই জানি না বললে অনেক মারধর করে জবানবান্ধি দিতে চাপ দেয়। আমার শরীরের এমন কোন জায়গা নেই যেখানে পুলিশ পালাক্রমে না পিটিয়েছে। পিটানোর সময় বলেছে, ছেলে সাগর (১৫) ও সাব্বির (৭) এবং মেয়ে ডালিয়া (১২) কে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে। ছেলে-মেয়ের লাশও খুজে পাবি না বলে জানায়। আমাকে পিটিয়ে অচেতন করে ফেলে রাখে। পুলিশের এক কনস্টাবল আমার মাথায় পানি দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন। এ সময় এসআই ফায়েকুজ্জামান ঐসব নামগুলো বললে ছেড়ে দিবে ও সন্তানদেরকে কিছু বলবে না বলে আল্লাহর নামে কসম কেটে কথা দেয়।’ তবে এ অভিযোগ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফায়েকুজ্জামান অস্বীকার করলেও অফিসার ইনচার্জ একেএম শাহীন মন্ডল কোন মন্তব্য করতে রাজী হননি।

১০ এপ্রিল সাহেবরামপুর এলাকায় হাকিমুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশের খাল থেকে টিপু ঘরামী (৪০) নামের এক ব্যক্তির লাশ খালের পানিতে ভাসতে দেখে উদ্ধার করে পুলিশ। ৪ মে পৌর এলাকার উত্তর রাজদী গ্রামের রশিদ খলিফার ছেলে মোতালেব ওরফে মতু খলিফা (৪৮) নামের এক ভ্যান চালককে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা খুন করে ব্রীজের নিচে ফেলে রেখে যায়। এ গুপ্তহত্যার মামলাটি নিয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহম্মেদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।

৮ জুন সন্ধ্যায় এনায়েতনগর ইউপির কালাই সরদারের চর এলাকার আপাং কাজীর ছেলে কলেজছাত্র বেল্লাল কাজী (২১) কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। গত ৯ জুন বাঁশগাড়ি ইউনিয়নের মধ্যচর এলাকার মোসলেম আলী সরদার (৭০) নামের এক বৃদ্ধের লাশ আড়িয়াল নদীর ভাদুরী নামক স্থানে ভাসমান অবস্থায় দেখে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা তার দুচোখ উৎপাটন, কান কেটে ও গলায় ফাঁস দিয়ে খুন করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়। ১৬ জুন রমজানপুর ইউনিয়নের উত্তর চরআইরকান্দি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর ছাত্রী চম্পা (১২) বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে আর ফেরেনি। তাকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। পরেরদিন সকালে পুকুরের স্থানীয়রা তার লাশ দেখে পুলিশকে খবর দেয়।

১৯ জুন চরদৌলত খাঁ ইউনিয়নের নতুন চরদৌলত খাঁ গ্রামে সারারাত প্রায় পাঁচ শতাধিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সকালে মহব্বত আলী সরদারকে (৬০) অজ্ঞাতনামা সন্ত্রাসীরা তাকে কুপিয়ে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়। গত ২৩ অক্টোবর উপজেলার সাহেবরামপুর এলাকার ক্রোকিরচর গ্রামের আজাহার বেপারীর হাসান বেপারী নামের এক ইজিবাইক চালককে খুন করে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা। বিয়ের ৪ দিন পর গত ২০ অক্টোবর রাতে পৌর এলাকার কাষ্টগর গ্রামের খালেক শরীফের ছেলে ইমাম হাসান (২২) উত্তর রাজদী শশুর বাড়িতে যাওয়ার সময় সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়। পরেরদিন পুলিশ গোপালপুর এলাকার একটি খাল থেকে ভাসমান অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে। গত ২৩ ডিসেম্বর গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন এক বাকপ্রতিবন্ধি গৃহবধূ। সে উপজেলার এনায়েতনগর ইউপির এনায়েতনগর গ্রামের আজমত আলী সরদারের স্ত্রী হাওয়ারুন্নেসা (৩২)। তাকে অজ্ঞাত দুবৃত্তরা ধর্ষণের পর হত্যা করে বাড়ির পাশে পুকুরে ফেলে রেখে যায়। পরে খবর পেয়ে পুলিশ বিবস্ত্র অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে।

এলাকাবাসী জানান, অফিসার ইনচার্জ হিসেবে একেএম শাহীন মন্ডল কালকিনি থানায় যোগদানের কয়েকদিন পর গত( ২৮ মার্চ) পৌর কাঁচা বাজারে অনুষ্ঠিত এক আইনশৃংখলা সভায় উপজেলা চেয়ারম্যান মীর গোলাম ফারুক জানিয়েছিলেন, ‘থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আমরা কেউ তৎবির করে আনিনি। যোগাযোগমন্ত্রী (বর্তমানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী) সৈয়দ আবুল হোসেন তাকে সন্ত্রাস দমনের জন্য পাঠিয়েছেন।’ অথচ তার পরে গত ১০ মাসে ২০টির উপরে খুনের ঘটনা ঘটেছে। তবুও শাহীন মন্ডল রয়েছেন বহাল তবিয়তে। মামলার ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগে তাকেসহ কয়েক পুলিশ কর্মকর্তার অপসারণের দাবীতে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ করা হয়েছে। গতমাসে জেলা পুলিশ সুপারের তদন্তে অনিয়মের অভিযোগ পাওয়ায় উপ-পরিদর্শক আজিজুর রহমানকে অপসারণ করা হয়েছে।