আইনের অভাবে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে স্বেচ্ছাচার

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। যতোটুকু আছে তারও যথাযথ প্রয়োগ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নিয়ে বেসরকারি চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো রোগীদের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারি আচরণ করছে। সুনির্দিষ্ট আইন এবং প্রয়োজনীয় জনবল না থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা প্রায় আট হাজার। দি মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স ১৯৮২ অনুযায়ী এগুলো পরিচালিত হচ্ছে।

হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনার জন্য চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ান, যন্ত্রপাতি, রি-এজেন্টসহ প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেই নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারি ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে বিপদে পড়া রোগীদের পুঁজি করে টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।

সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুরে এবং রোগী ও তাদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে নানা অভিযোগ পাওয়া গেছে।
পান্থপথে অবস্থিত মধ্যম সারির বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান শমরিতা হাসপাতাল। আহত এক রোগীকে এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হলেও তাঁর জরুরি চিকিৎসা দেননি চিকিৎসকরা। ওই রোগীর স্বজন দুলাল আহমেদ অভিযোগ করে বলেন, মাথায় এবং নাকে আঘাত পাওয়ায় আমার চাচাকে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখানে এসে নিবন্ধন থেকে শুরু করে ডাক্তার দেখানো- একটি আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এই জটিল প্রক্রিয়ার কারণে চাচার চিকিৎসা শুরু হয় আধঘন্টা বিলম্বে। এতে তাঁর রক্তক্ষরণ বেশি হয়। অথচ ঘন্টা দেড়েক পর হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার সময় ধরিয়ে দেয়া হয় তিন হাজার টাকার একটি বিল।

মহাখালী বাস টার্মিনালের বিপরীত দিকে রয়েছে মেট্রোপলিটন হাসপাতাল। এর পেছনেই রয়েছে তেজগাঁও-নাখালপাড়ার ড্রেন। হাসপাতালের সামনে গাড়ির ওয়ার্কশপ। তাই চিকিৎসার মনোরম পরিবেশ এখানে নেই। অথচ এই হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যয় অনেক বেশি বলে ভুক্তভোগীরা জানান।

মগবাজারে আদ দ্বীন হাসপাতালে নিজের স্ত্রীকে নিয়ে চেকআপ করাতে এসেছেন বশিরউদ্দিন (প্রকৃত নাম নয়)। তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগ করে বলেন, এরা রোগীদের প্রতি যতœ নেয় না। আমার স্ত্রীকে ভর্তি করাতে বললো। কিন্তু ওই হাসপাতালে তখন হাসপাতালে শয্যা খালি নেই। অথচ তাদের এখানে ভর্তি না হলে রোগীকে চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন চিকিৎসক আবুল কালাম। এছাড়া ব্যবস্থাপত্রে এমন সব ওষুধের নাম ডাক্তাররা লেখেন যেসব ওষুধ সকল ফার্মাসিতে পাওয়া যায় না। কারণ, এগুলো আদ দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যালসের ওষুধ।

এভাবে রোগীদের হয়রানির নানা অভিযোগ থাকলেও দেশের বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি করতে পারছে না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।  প্রয়োজনীয় জনবল, কঠোর আইন ও বিধিবিধানের অভাবে অধিদপ্তর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। অধিদপ্তরের মনিটরিং ও সুপারভিশনের অভাবে ফ্রি স্টাইলে পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ।
প্রখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান বলেন, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো যথাযথভাবে পরিচালনা এবং মনিটরিং ও সুপারভিশনের জন্য বেসরকারি চিকিৎসাসেবা আইন প্রণয়নের কোনো বিকল্প নেই। সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় সেবাধর্মী এ প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক এক মহা-পরিচালক বলেন, এরশাদ সরকারের আমল থেকে শুরু করে বিএনপি ও বর্তমান  আওয়ামী লীগের শাসনামলে একাধিকবার এ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও রহস্যজনক কারণে আইনটি শেষ পর্যন্ত প্রণীত হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা সাত হাজার ৬২৫টি। এর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা দুই হাজার ৮১৫ এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা চার হাজার ৮১০। রাজধানীতে ৬১০টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ৮৭২টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।
এ সংখ্যা ছাড়াও শুধু সাইনবোর্ড নিয়ে চলছে অসংখ্য বেসরকারি চিকিৎসা সেবা প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কোনো পরিসংখ্যান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে নেই।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ২৮ এপ্রিল বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা আইন-২০১০-এর প্রস্তাবিত খসড়া পর্যালোচনা ও দেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়ন করার জন্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ এফ এম সাইফুল ইসলামকে সভাপতি ও ডা. মো. মোমতাজউদ্দিন ভুঞাকে সদস্য সচিব করে ১৫ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটি পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে একটি খসড়া নীতিমালা চূড়ান্ত করলেও তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি বলে জানা যায়।
:আজকের বাংলা