বৌ-শ্বাশুড়ি একই ক্লাশের ছাত্রী – ব্যাপক সাড়া পেলো বয়স্ক নারী স্কুল

নিজস্ব সংবাদদাতা ॥ “লেখা পড়ায় বয়স নাই-চলো মোরা স্কুলে যাই”। এ কথার প্রমান মিলেছে বরিশালের গৌরনদী পৌর এলাকার গেরাকুল মহল্লার বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্রে। এ স্কুলে একসাথে পড়ালেখা করছেন মা-মেয়ে ও বৌ-শাশুড়ি। তারা সমাজের কু-সংস্কার থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য প্রমান করেছেন লেখা পড়ার জন্য নির্দিষ্ট কোন বয়সের প্রয়োজন হয়না।

গেরাকুল মহল্লার মোল্ল¬াবাড়ি ওই স্কুলে গিয়ে দেখা গেছে, স্থানীয় মোসলেম উদ্দিন মোল্ল¬ার স্ত্রী মিনু বেগম (৬০), তার পুত্রবধু রেনু বেগম (৩৩) পড়াশোনা করছেন। একইভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী করিম মোল্ল¬ার স্ত্রী তাছলিমা বেগম (৪১), তার দু’কন্যা সুমাইয়া (১৬), ফাহিমা (১৫) একসাথে লেখাপড়া করছেন। বৃদ্ধা মিনু বেগম বলেন, বাবা লেহা পড়ার মর্ম মুই আগে বুঝি নাই। অহন দেখছি মূর্খ্য মানুষের কোন দাম নাই। হেইডা বুইজা (বুঝে) এই স্কুলে মুই পোলার বৌরে লইয়া ভর্তি হইছি। তার পুত্রবধু রেনু বেগম বলেন, আমার স্বামী রিকসা চালাইয়া সংসার চালায়। হে লেহাপড়া শেখতে পারে নাই। ঘরের দু’জনের একজনেও লেখাপড়া না জানলে মহাবিপদ। হেইডা ভাইবা মুই এই স্কুলে ভর্তি হইছি।

বৌ-শ্বাশুড়ি একই ক্লাশের ছাত্রী - ব্যাপক সাড়া পেলো বয়স্ক নারী স্কুলওই স্কুলের ছাত্রী তাছলিমা বেগম বলেন, বাপের সোংসারে অভাবের তাড়নায় নিজে লেহাপড়া করতে পারি নাই। এ্যাহন স্বামীর ঘরে আইয়াও দেহি একই অবস্থা। দুইডা মাইয়ারে পড়াইতে পারিনাই। হগলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কইরা মাইয়াগো লইয়া পড়ালেখা শিখছি। মিনু ও তাসলিমাই নয় তাদের ন্যায় ওই বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে লেখাপড়া শিখছেন রওশনারা বেগম (৫৫), মেহেরোজ বেগম (৬০), নুরজাহান বেগম (৪৫), খাদিজা আক্তার (১৫), ইতি খানম (১৬) সহ ১৫ থেকে ৬০ বছর বয়সের ২০ জন নারী।

জানা গেছে, গত এক বছর থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বরিশাল কর্তৃক ওই কেন্দ্রটি চালু করা হয়। এক বছরের কোর্সে এখানে শিক্ষা দেয়া হয় বাংলা, অংক, আরবী ও ইংরেজী। এছাড়া ওই স্কুলে শিখানো হয় ব্যবহারিক বিষয়। যেমন-হাঁস-মুরগী, মৎস্যচাষ, পশু পালন ও কৃষি কাজ। সংসারের কাজের ফাঁকে বয়স্ক নারীরা দৈনিক তিন ঘন্টা করে ওই স্কুলে লেখাপড়া শিখছেন। নুতন বছরের প্রথম দিনই তারা হাতে পেয়েছেন নুতন বই ও অন্যান্য শিক্ষা উপকরন। বিগত বছরে ওই এলাকার ময়না বেগম (৬০), শহরভানু বিবি (৫৮), সালেহা বেগম (৫০), মালেকা বেগম (৪৫) সহ ২০ জন বয়স্ক নারী শিক্ষা গ্রহন করেছেন। তারা এখন বাংলা লিখতে ও পড়তে পারেন। সেই সাথে শিখেছেন সুরা, কালিমা ও নামাজের বিভিন্ন মাসাআলা। এরা এখন নিজেদের ধন্য মনে করেন। বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে বয়স্ক নারীদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন সরকারি গৌরনদী কলেজের ছাত্রী রাবেয়া খানম (২১)। সে এখানে কাজ করছেন

মাসিক মাত্র ১৮’শ টাকা বেতনে। শিক্ষিকা রাবেয়া বলেন, আমি সমাজের অবহেলিত বয়স্কদের লেখাপড়া শেখাই। এখানে কষ্টের চাইতে আনন্দ বেশি। যারা লেখাপড়া কিছুই জানতেন না, তারা এখন লিখতে ও পড়তে পারেন। এতেই আমি তৃপ্তি পাই। রাবেয়া আরো বলেন, এই স্কুলে শুক্রবার ব্যতিত প্রতিদিন বিকেল তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত ক্লাশ করানো হয়। এছাড়াও বছরে একবার স্কুলের শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাইয়ের লক্ষ্যে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় আগ্রহ বাড়াতে ওই পরীক্ষায় মেধা তালিকায় উন্নীতদের পুরস্কার প্রদান করা হয়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত ফিল্ড সুপার ভাইজার মোঃ তাওহীদুল ইসলাম জানান, গৌরনদীতে একটি নারী ও একটি পুরুষ বয়স্ক কেন্দ্র চালু ছিলো। কিন্তু পুরুষ কেন্দ্রটি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের অধীনে বর্তমানে এ অঞ্চলে ৩১টি প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্রে ৯’শ ৩০ জন শিশু, একটি বয়স্ক শিক্ষা কেন্দ্রে ২০ জন বয়স্ক নারী ও ৩১টি সহজ কুরআন শিক্ষা কেন্দ্রে ১ হাজার ৮৫ জন শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহন করছেন।