গুড বাই

মোহাম্মদ গোলাম নবী ॥ দেশের প্রায় ৭০ ভাগ মানুষ আওয়ামী লীগ সরকারের গুড বাই দেখতে চায়। ঘটনার শুরু শেয়ার বাজারে ব্যাপক দরপতনের মধ্য দিয়ে। শেয়ার বাজারের রমরমা ব্যবসায় যেদিন ধ্বস নামল সেদিনই আওয়ামী লীগের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেলো। আওয়ামী লীগের নেতারা জেনে গেলো তাদেরকে বিদায় নিতে হবে। দলটির জনপ্রিয়তার সূচক প্রায় নব্বইয়ের ঘর থেকে এক ধাক্কায় ৫০ এর নিচে নেমে গেল। পথে-ঘাটে, চায়ের টেবিলে, হাটে-বাজারে সবজায়গায় একই আলোচনা। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলেই শেয়ার বাজারে ধ্বস নামে। মানুষের পকেট খালি হয়। শেয়ার বাজারের কারণে ৫০০ পরিবার লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হলো প্রায় দুই কোটি মানুষ।

শেয়ার বাজারের ক্ষত শুকাতে না শুকাতে বাজারের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে নাভিশ্বাস উঠে গেলো সাধারণ মানুষের। তার সঙ্গে যুক্ত হলো দফায় দফায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি এবং জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি। বেড়ে গেল বাস ভাড়া। লঞ্চ ভাড়া। পণ্য পরিবহনের খরচ বাড়ায় সবাই বুঝে গেলো দ্রব্যমূল্যের দাম আর কমবে না। ফলে আওয়ামী লীগ তাদের জনপ্রিয়তা আরেকটু হারাল।

দেশের মানুষ যখন আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছে সেসময়ে পত্রিকার পাতায় দেখা গেলো কোন এক অখ্যাত হলমার্ক রাষ্ট্রয়াত্ত ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়েছে। মানুষ অবাক হয়ে দেখল এই ঘটনাকে অর্থমন্ত্রী স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখছেন। সেখানেই শেষ নয়। এরপর একের পর এক আর্থিক কেলেঙ্কারির সংবাদ প্রকাশিত হতে লাগল।

গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো আওয়ামী লীগের জন্য বিষফোঁড়া হিসেবে আর্বিভূত হলো ছাত্রলীগ। এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই তারা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগের শাসনামলের আয়ু যতো কমতে থাকল সেটি যেন দিনে দিনে আরো বাড়ল। প্রকাশ্য দিবালোকে বিশ্বজিৎকে হত্যার মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক থেকে আরো কিছু ভোট কেড়ে নিল।

এদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণে ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের আনা অভিযোগ অস্বীকার এবং সেটি সত্য বলে প্রমাণিত হওয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ আরেক দফা ভোট হারাল।

এই ধরনের বড় বড় ঘটনার মধ্যে ভোট হারানোর মতো অনেক গুলো ছোট ছোট ঘটনাও ঘটেছে। যেমন, সুরঞ্জিতের বাড়িতে টাকা নিয়ে গাড়ি যাওয়া, হত্যা, গুম, বিরোধী দলীয় নেতাদের আটক, বিডিআর বিদ্রোহ ইত্যাদি।

ক্ষমতাসীন দলটির ক্ষমতায় থাকা নেতারা দলের চেয়ে নিজেকে বড় করে দেখতে শুরু করায় পরিস্থিতি আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। তাদেরই বা দোষ কি। এবারের মন্ত্রীসভায় বেশিরভাগ নবীন মন্ত্রী। আবার কবে কখন মন্ত্রী হতে পারবে কি পারবে না সেই বিবেচনায় তারা নিজেদের আখের গোছাচ্ছে। কিন্তু জনগণ তো আর বোকা নয় তারা শুধু তাদের ভোটটা আওয়ামী লীগের উপর থেকে তুলে নিচ্ছে।

এই যখন অবস্থা। তখন আওয়ামী লীগ ট্রাম্প কার্ডটাই খেলেছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগের বিজয়ে দু’টি বিষয় আবেগপ্রবণ বাংলাদেশী ভোটারদের ভোট পেতে সহায়তা করেছিল। এক. ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার। দুই. যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। অনেকেই মনে করেন আওয়ামী লীগ ইচ্ছে করলে অনেক আগেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করতে পারত। কিন্তু সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগ সেটি করেনি। কারণ গত চার বছরের দেশ শাসনের দুর্বলতা কাটানোর জন্য এবং ভোটের রাজনীতিতে যুদ্ধাপরাধীরা ছিল তুরুপের তাস। সেই তাস তারা এই বছর খেলল।

ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ যে কতোটা দক্ষ সেটি দেশের মানুষ আবার দেখতে পেল। এক গণজাগরণ মঞ্চ আওয়ামী লীগের শাসনামলের চার বছরের বড় বড় ব্যর্থতাগুলোকে মিডিয়ার আড়ালে নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখল। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ তার এক দাবী থেকে যখন ছয় দফা দাবীতে চলে গেলো তখন ক্রমশ তাদের ক্রেডিবিলিটি হারাতে লাগল। এর মধ্যেই পানি ঘোলা করতে আস্তিক নাস্তিক ইস্যু চলে এলো। ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে আগ্রহী হয়ে উঠল অনেকে। এরই ধারাবাহিকতায় হেফাজতে ইসলামীও মাঠে নামল।

দেশের মানুষ এতোদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুই দলে বিভক্ত ছিল। এখন নতুন আরো কয়েকটি দল যেন বের হয়ে আসতে লেগেছে। দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সন্দেহ আর অবিশ্বাস আগের চেয়ে বেড়েছে। সরকারি দল মনে করছে এই ধরনের পরিস্থিতির ফায়দা তারা তুলবে। বিরোধী দল মনে করছে তারা তুলবে ফায়দা। আর দুই দলের দায়িত্বশীল আচরণের অনুপস্থিতির সুযোগে তৃতীয় শক্তি হিসেবে বের হয়ে আসা হেফাজতে িইসলাম জানিয়ে দিয়েছে যারা ক্ষমতায় থাকতে চায় কিংবা যেতে চায় তাদের সবাইকে তাদের ১৩ দফা মানতে হবে।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে এতো বড় সঙ্কট আগে কখনো তৈরি হয়নি। তবে সেটা স্বাভাবিকও বটে। দেশের বয়স বেড়েছে সঙ্কটের মাত্রাও বেড়েছে। এখন সঙ্কট উত্তরণের উপায় কি? অনেকেই মনে করছেন নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনই এখন সমাধান। সেভাবে নির্বাচন যদি হয় তবে আওয়ামী লীগের জন্য দু’টি শব্দই বাকি থাকে- গুড বাই। সেটি কেন আওয়ামী লীগ মেনে নেবে?

পূর্ব প্রকাশ : mgnabi.wordpress.com/2013/04/21