বঙ্গভবনের পথে ২০ তম রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥  জাতীয় সংসদের সঙ্গে দীর্ঘ ২২ বছরের সম্পর্কের ইতি টেনে ‘বঙ্গভবনের’ পথে রেকর্ড সংখ্যক সাতবার নির্বাচিত সংসদ সদস্য, দু’বারের স্পীকার ও পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট। রবিবার আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংসদীয় দলের বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে মাটি ও মানুষের নেতা প্রবীণ রাজনীতিক ৬৯ বছর বয়সী আবদুল হামিদকে পরবর্তী পাঁচ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। অন্য কোন প্রার্থী না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হামিদই হতে যাচ্ছেন দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি। এখন শুধু কেবল বাকি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের শপথ গ্রহণ।
সংসদীয় দলের মনোনয়ন শেষে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে নিয়ে স্পীকারের কক্ষে সাক্ষাত করেন ভাবী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ভাবী রাষ্ট্রপতিকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি কুশল বিনিময় করেন। বৈঠক সূত্র জানায়, রাষ্ট্রপতি পদে দলীয়ভাবে তাঁকে মনোনয়ন দেয়ায় অত্যন্ত উৎফুল্ল হাস্যোজ্জ্বল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ‘আমি আপনিসহ সবার সহযোগিতা চাই। এটি অত্যন্ত বড় ও পবিত্র দায়িত্ব। আল্লাহর কাছে দোয়া চাই, আমি যেন অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে আমার ওপর অর্পিত এই গুরু ও পবিত্র দায়িত্ব পালন করতে পারি।’ এ সময় প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে আবদুল হামিদকে সর্বাত্মক সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেন।
এদিকে নির্বাচন কমিশনার মোঃ আবদুল মোবারক রবিবার সাংবাদিকদের জানান, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন ১৯৯১-এর ৭ ধারা অনুযায়ী আজ মনোনয়নপত্র বাছাই শেষে মনোনয়নপত্র বৈধ হলে একক প্রার্থী হিসেবে আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেটকে আজই রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করা হবে।
স্পীকারর কক্ষে কুশল বিনিময়ের পর দুপুর আড়াইটার দিকে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতেই রাষ্ট্রপতি পদের মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করেন আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট। পরে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমদের হাতে আবদুল হামিদের তিনটি মনোনয়নপত্র জমা দেন। এর মধ্যে একটিতে প্রস্তাবক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও সমর্থনকারী হিসেবে তোফায়েল আহমেদের নাম রয়েছে। এছাড়া চীফ হুইপ উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ ও হুইপ আ স ম ফিরোজ প্রস্তাবক হয়ে বাকি দুটি মনোনয়নপত্র জমা দেন, যাতে সমর্থনকারী হিসেবে সাবেক আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ও হুইপ সেগুফতা ইয়াসমিন এমিলির নাম রয়েছে।
সংসদীয় দলের সভায় রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেয়া হলেও শূন্য হওয়া জাতীয় সংসদের স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার পদে কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়নি। এ প্রসঙ্গে কথা উঠলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এ বিষয়টি আজকের বৈঠকে নয়। আমাদের সংবিধান অনুযায়ী সব কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রপতি পদে শপথ গ্রহণ না করা পর্যন্ত আবদুল হামিদ জাতীয় স্পীকারের পদে বহাল থাকবেন। একজন স্পীকার বহাল থাকতে অন্য কাউকে স্পীকার পদে মনোনয়ন দেয়া যায় না। তাই স্পীকারের পদ শূন্য ঘোষিত হলে পুনরায় বসে এ পদে মনোনয়ন দেয়া হবে।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনে রবিবার প্রবীণ রাজনীতিক ও বর্তমানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদে থাকা আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট ছাড়া আর কেউ মনোনয়নপত্র দাখিল করেননি। তাই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিনি রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন এটা এখন সময়ের ব্যাপার। তবে নিয়ম রক্ষার্থে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আজ সোমবার মনোনয়নপত্র বাছাই করবে নির্বাচন কমিশন।
আগামী ২৪ এপ্রিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দিষ্ট সময়সীমা শেষে অন্য কোন প্রার্থী না থাকায় রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবদুল হামিদের নির্বাচিত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী ২৯ এপ্রিল জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকলেও একক প্রার্থী হিসেবে আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার কারণে ওইদিন সংসদে কোন ভোট গ্রহণ বা নির্বাচনের কোন প্রয়োজন পড়বে না বলে ইসি ও নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
১৯৯০ সালে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা পুনর্প্রবর্তনের পর ষষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে আগামী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৯ মেয়াদে ১৬ জন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। নবম সংসদের শেষ দিকে নির্বাচিত হতে যাওয়া আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট হবেন ১৭তম ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি।
বর্ষীয়ান রাজনীতিক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর জাতীয় সংসদের স্পীকার হিসেবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট। নির্বাচন কমিশন থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সিনিয়র ক’জন নেতা আবদুল হামিদের বাসায় গিয়ে বৈঠকের পর পরই নিশ্চিত হয় আবদুল হামিদই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন। ’৯০ ও ’৯৬ সালে অরাজনৈতিক দু’জনকে রাষ্ট্রপতি করার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের বৈঠকে আওয়ামী লীগের ভেতর থেকেই একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক ও দলের ত্যাগী নেতাকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নের জোর দাবি ওঠে।
এমন জোরালো দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের বেশ ক’জন নীতিনির্ধারক নেতার সঙ্গে কয়েকদফা বৈঠকও করেন। আর ওই বৈঠক থেকেই আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ ত্যাগী নেতা ও প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান আবদুল হামিদকেই রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। আর এবার অন্য কোন দলের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেয়ার সম্ভাবনা না থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবদুল হামিদ নির্বাচিত হবেন এটাও ছিল প্রায় নিশ্চিত। তাছাড়া অন্য কোন দল এ নির্বাচনে অংশ নিলেও হিসাব নিকাশে আবদুল হামিদই রাষ্ট্রপতি হবেন। কারণ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জাতীয় সংসদে তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। ফলে ভোট হলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নির্বাচিত হবেনÑ এটাও নিশ্চিত। এ কারণে বিরোধী দল সংসদেও আসেনি, রাষ্ট্রপতি পদে কোন প্রার্থীও দেয়নি।
শেষ দিন রবিবার বিকাল ৪টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় নির্ধারণ করা ছিল। সে সময় পর্যন্ত কেউ এ পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য মনোনয়নপত্র সংগ্রহ বা জমা না দেয়ায় আবদুল হামিদ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি হওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করবে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ২৪ এপ্রিল।
কমিশন সূত্র জানায়, নিয়ম রক্ষার্থেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। নিয়ম অনুযায়ী, প্রার্থী একজন থাকলে নির্বাচন কমিশন তাঁকে বিজয়ী ঘোষণা করবে। তবে একাধিক প্রার্থী হলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রধান রিটার্নিং অফিসার হিসেবে সংসদে বসে নির্বাচন পরিচালনা করেন। ভোটার হিসেবে সংসদ সদস্যরা প্রকাশ্যে প্রার্থীদের নামের পাশে স্বাক্ষর করে তাঁদের সমর্থন জানান। নির্বাচনে ব্যালট পেপারে কোন প্রতীক থাকে না, কেবল প্রার্থীর নাম লেখা থাকে। তবে একক প্রার্থী হওয়ায় ২৪ এপ্রিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের সময় শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেটকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করবে। এরপরই প্রধান বিচারপতির কাছে শপথ গ্রহণ শেষে ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করবেন আবদুল হামিদ।
কমিশন জানিয়েছে, সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের পর ১৯৯১ সালে একবারই সংসদ সদস্যদের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার নজির আছে। বিএনপির মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ওই নির্বাচনে আবদুর রহমান বিশ্বাস বিজয়ী হন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরুল হায়দার চৌধুরী নির্বাচনে পরাজিত হন। এরপর আর কখনও কেউ ভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হননি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর প্রথম দফায় অধ্যাপক ডা. একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী এবং পরে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ এবং সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ১২ জানুয়ারি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন প্রয়াত জিল্লুর রহমান।
যেভাবে রাষ্ট্রপতির মনোনয়ন পেলেন আবদুল হামিদ ॥ রবিবার বিকেল সাড়ে পাঁচটায় শুরু হয় নবম জাতীয় সংসদের ১৭তম অধিবেশন। এর আগে রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সকাল সাড়ে ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনের নবম তলার সরকারী দলের সভাকক্ষে শুরু হয় আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের বৈঠক। বৈঠকের শুরুতেই সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিলের মৃত্যুতে শোক প্রস্তাব উত্থাপন এবং এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সংক্ষিপ্ত সূচনা বক্তব্য শেষেই শুরু হয় রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন প্রক্রিয়া। তবে সংসদীয় বৈঠক চলার সময়ই পৌনে একটার দিকে স্পীকারের কার্যালয়ে আসেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
বৈঠক সূত্র জানায়, শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা একজন গ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি মনোনয়নে দলের সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে নাম প্রস্তাব আহ্বান করেন। এ সময় সংসদীয় দলের সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাষ্ট্রের প্রধান হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। তাই সবার কাছে গ্রহণযোগ্য দলের একক কোন নেতার নাম প্রস্তাব করুন, যিনি দল ও রাজনীতিতে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। এ ক্ষেত্রে বিভক্ত কোন প্রস্তাব আওয়ামী লীগের মতো প্রাচীন দলের কাছ থেকে কেউ আশা করে না।
এ সময় প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা ও উপদেষ্টাম-লীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ রাষ্ট্রপতি পদে আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেটের নাম প্রস্তাব করেন। এ সময় তিনি বলেন, আবদুল হামিদ দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন মাঠ পর্যায় থেকে উঠে আসা ত্যাগী ও পরীক্ষিত রাজনীতিক। তিনি রেকর্ড সংখ্যক সাতবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য, দু’বার স্পীকারসহ যখন তাঁকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, সেই দায়িত্বই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করেছেন।
তোফায়েল আহমেদের প্রস্তাবে সমর্থন করে আবদুল হামিদের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ও শাজাহান খান। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে উপস্থিত দলের সকল সংসদ সদস্যের মতামত জানতে চাইলে সবাই একযোগে হাত তুলে এবং মুখে ‘হ্যাঁ’ ধ্বনি তুলে আবদুল হামিদের প্রতি সমর্থন জানান। এ সময় আবদুল হামিদকে দলের রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়নের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।
বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে সব সিনিয়র নেতাই আবদুল হামিদের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানালেও কিছুটা অভিমানের সুরে কথা বলেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। পরে অবশ্য তিনিও আবদুল হামিদের রাষ্ট্রপতির প্রস্তাবে সমর্থন জানান।
সর্বসম্মতিক্রমে আবদুল হামিদকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়নের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর পরই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আওয়ামী লীগের চার নেতা আবদুল মতিন খসরু, এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বি মিয়া, হুইপ আ স ম ফিরোজ ও সেগুফতা ইয়াসমীন এমিলি বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান নির্বাচন কমিশনে। সেখানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিব উদ্দিন আহমদের সঙ্গে দেখা করেন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য চারটি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে পুনরায় ফিরে আসেন জাতীয় সংসদে।
সংসদীয় দলের বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সংসদ ভবনের কার্যালয়ে দলের বেশ ক’জন সিনিয়র নেতার সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বসেন। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশন থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন ওই চার নেতা। এরপর প্রধানমন্ত্রী দলের অন্যান্য নেতাকে সঙ্গে নিয়ে স্পীকারের কক্ষে অবস্থানরত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেটের সঙ্গে সাক্ষাত করেন এবং তাঁর উপস্থিতিতেই মনোনয়নপত্রে স্বাক্ষর করেন ভাবী এই রাষ্ট্রপতি। এরপর তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল নির্বাচন কমিশনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি পদের জন্য আবদুল হামিদের তিনটি মনোনয়নপত্র দাখিল করেন।
দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান গত ২০ মার্চ সিঙ্গাপুরে একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এরপর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ গত ৯ এপ্রিল এই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। সে অনুযায়ী ২৯ এপ্রিল নির্বাচনের ভোট হবে। রবিবার ছিল মনোনয়ন দাখিলের শেষ দিন। আজ সোমবার মনোনয়নপত্র বাছাই এবং ২৪ এপ্রিল মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন। অন্য কেউ মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ না করায় রবিবার বিকেলেই আবদুল হামিদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। ২৪ এপ্রিল মনোননয়পত্র প্রত্যাহারের সময় শেষ হওয়া মাত্রই নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদের নাম ঘোষণার পর তা গেজেট আকারে প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন। সব প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচন কমিশনের ধারণা, আগামী ২৫ কিংবা ২৬ এপ্রিলই বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেটকে শপথ বাক্য পাঠ করাবেন প্রধান বিচারপতি মোঃ মোজাম্মেল হোসেন।
পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ হামিদ ॥ আপাদমস্তক পরিচ্ছন্ন রাজনীতিক আবদুল হামিদ এ্যাডভোকেট। জাতীয় সংসদের স্পীকার ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকে রাষ্ট্রপতি মনোনয়ন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের রাজনীতিতেই জড়িয়ে ছিলেন তিনি।
১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আবদুল হামিদ। হাজী মোঃ তায়েব উদ্দিন ও তমিজা বেগমের সন্তান আবদুল হামিদের শিক্ষাজীবন শুরু কামালপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত ভৈরব কেবি স্কুল এবং নিকলী জেসি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, গুরুদয়াল কলেজ থেকে মানবিকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্মাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগের মাধ্যমে রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় তাঁর। ১৯৬১ সালে কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই যোগ দেন আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে। এক পর্যায়ে তাঁকে গ্রেফতার হয়ে কারাগারেও যেতে হয়।
গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) ও সহ-সভাপতির (ভিপি) দায়িত্ব পালনের পর ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ সাবডিভিশন ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতির দায়িত্ব নেন আবদুল হামিদ। ঢাকাল সেন্ট্রাল ল’ কলেজ থেকে এলএলবি পাস করার পর কিশোরগঞ্জ বারে আইন পেশায় যোগ দেন তিনি। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাঁচবার জেলা বার সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৬৬-৬৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। এরপর ১৯৬৯ সালে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে ময়মনসিংহ-১৮ আসন থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য নির্বাচিত হন আবদুল হামিদ। এরপর দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে তাতে যোগ দেন তিনি। তিনি ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং ভারতের মেঘালয় রিক্রুটিং ক্যাম্পের চেয়ারম্যান এবং তৎকালীন সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলার বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (মুজিব বাহিনী) সাব-সেক্টর কমান্ডার পদসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে চলতি বছর আবদুল হামিদকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করা হয়।
১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হন এবং ১৯৭৮ থেকে ২০০৯-এর ২৫ জানুয়ারি স্পীকার নির্বাচিত হবার পূর্ব পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা-ের পর তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময় দীর্ঘদিন কারাভোগ করতে হয় আবদুল হামিদকে। এরপর ১৯৮৬, ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন কিশোরগঞ্জের অভূতপূর্ব জনপ্রিয় নেতা আবদুল হামিদ।
আবদুল হামিদ সপ্তম জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন এবং ১৩ জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১০ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত এ পদে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি স্পীকার নির্বাচিত হন এবং ১১ জুলাই ২০০১ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০০১ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। ৮ম জাতীয় সংসদে তিনি ২০০১ সালের ১ নবেম্বর থেকে ২৭ অক্টোবর ২০০৬ পর্যন্ত বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবদুল হামিদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০০৯ সালের ২৫ জানুয়ারি সর্বসম্মতিক্রমে দ্বিতীয়বারের মতো স্পীকার নির্বাচিত হন।
একজন সমাজ সেবক ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসেবে স্বনামখ্যাত আবদুল হামিদ তাঁর নির্বাচনী এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন একাধিক স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা। জেলার সর্বত্র রয়েছে তাঁর উন্নয়নমূলক অনেক কর্মকা-। এছাড়া তিনি কিশোরগঞ্জ প্রেসক্লাবের সম্মানিত সদস্য। তাঁর রাষ্ট্রপতি হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়তেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়েছে গোটা কিশোরগঞ্জ।