মাননীয় প্রধানম্ন্ত্রী’র কাছে একজন প্রতিবন্ধী মানুষের খোলা চিঠি

কদিন আগেই গেলো প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতি বৎসর এদিনে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে অনেক সভা-সেমিনার হয়। অনেক আলোচনাও হয়। তাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন বা আরো ভালো কিছু করার অঙ্গিকার করেন সবাই-ই। কিন্তু সত্যিকারের কাজ খুব কম মানুষই করেন। আমাদের দেশে পনেরো কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় দেড় কোটি শুধুমাত্র প্রতিবন্ধী। গড়ে আড়াই লক্ষ প্রতিবন্ধী প্রতিবৎসর বাড়ছে এবং তারা আমার মতোই চারদেয়ালের আবদ্ধ ঘরে বেড়ে উঠছে। তাদের নেই আর দশজন সুস্থ ছেলেমেয়ের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশ গড়ার স্বাভাবিক পরিবেশ। অথচ বাইরের দেশগুলোতে দেখুন, প্রতিবন্ধীরা পরিবার থেকে অনেক সাপোর্ট পায়। সেখানকার পরিবেশটাই এমন সুস্থ সুন্দরভাবে বাঁচার জন্যে কিংবা প্রতিবন্ধীদের ভবিষ্যৎ মজবুত করার লক্ষে্য প্রতিবন্ধীদের পরিবার এবং সেখানকার মানুষেরা অনেক বেশি সচেতন।
Singapore Muscular Dystrophy Association এর ম্যানেজার পদে কর্মরত সেরিনা রো ছোটবেলা থেকেই এরোগে আক্রান্ত। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর বয়স্ক সেরিনা ইলেকট্রিক হুইল চেয়ারে বসে সংসার ও কর্মস্থল দুটোই সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বামী অফিস যাওয়ার পথে সেরিনাকে তার কর্মস্থলে নামিয়ে দেন। ঘরে ফেরার পথে তুলে নেন। বাজার সদাই করা বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া তার জন্য আর দশজন মানুষের মতোই স্বাভাবিক ব্যাপার। তিরিশ বৎসর বয়সী হ্যারির অবস্থা আরো করুণ। ইলেকট্রিক হুইল চেয়ারে পরে আছে তার শরীরটা যেনো একদলা মাংসপিণ্ড। শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে বুকের পাজর ওঠানামা করছে। কথা বলার সময় শ্বাসকষ্ট আরো বেড়ে যায়। কেজি স্কুলে পড়া অবস্থাতেই তার রোগটি ধরা পড়ে। কখনো তাদের ছেলে সুস্থ হয়ে উঠবে না জেনেও মা-বাবা ধৈর্যহারা হননি। কখনো শিক্ষক, কখনো ক্লাসমেট কখনো বা বন্ধুর মতো পাশে থেকে প্রতি পদে সাহায্য করেছেন মা, হ্যারির কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার শখ পূরণ করতে সিঙ্গাপুর থেকে সুদূর আমেরিকা পর্যন্ত যেতে হয়েছে তার মাকে। আমি নিজে অনেকদিন মালয়েশিয়া ছিলাম। দেখেছি সেখানকার পরিবেশ। অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি। কেউ আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি। যেই দেশের মাটিতে পা দিয়েছি আবার পড়তে হয়েছে মানুষের তীর্যক চাহনির মুখে।

বাবা-মা ভাইবোনেরা যার যার কাজে ব্যস্ত। সারাটা দিন একটা আবদ্ধ রুমে একটা চেয়ারে বসে থাকা কী-যে যন্ত্রণাদায়ক! টিভির রিমোট চেপে চ্যানেল ঘোরানো বা বই ……… এক সময় দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। এমনি সময় আমার অন্ধকার জীবন আলোকিত করে একজন এল। সে মানুষটির প্রাণ উজার করা ভালোবাসা আমার হতাশাগ্রস্ত জীবনকে লক্ষ দিলো। তার উৎসাহে আমি নতুন জীবন শুরু করতে চাইলাম। কিন্তু সেখানেও বাঁধ সাধলো আমাদের অশিক্ষিত-অসচেতন সমাজ। কারুরই একটিবারের তরেও মনে হলো না আমার জীবনে যদি কেউ আনন্দের বন্যা বইয়ে দিতে চায় তাতে তো আমারি ভালো। হোক না সে আনন্দ দু-চার বৎসর কিংবা সারা জীবনের জন্য। তাতে কিইবা আসে যায়! কিন্তু যে হাঁটতে চলতে পারে না সে কীভাবে বিয়ের স্বপ্ন দেখে? নানাজনের নানা কথার মধ্যে দিয়ে শুরু হলো আমার ওপর একধরনের মানসিক নির্যাতন। তাদেরোবা কি দোষ দেবো, আমাদের সমাজব্যবস্থাই যে এমন! তবুও, আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব দেখে আমার নানাভাই এগিয়ে এলেন আমাদের ভালোবাসাকে এক করতে। দীর্ঘ পাঁচমাস সংগ্রামের পর আমাদের বিয়ে হলো তাও আমার বাবার অমতে। তিনি তখনো মেনে নিতে পারেননি তার পঙ্গু মেয়ে সংসারি হতে পারে কিংবা তারও অধিকার আছে আর দশজনের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপনের। আমার জানা মতে, বাংলাদেশে এটি প্রথম বিয়ে যা কোন মেয়ে প্রতিবন্ধী অবস্থায় করলো। শুরু হলো আমাদের নতুন জীবন। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি নিতান্তই ভালো মানুষ। তারা আমাকে সাদরে পুত্রবধূ হিসেবে গ্রহণ করে নিতে এতটুকু দ্বিধা করেননি। আমার স্বামী যখনি আমাকে কোথাও ঘুরে বেড়াতে নিয়ে যেতো মানুষের চাহনি আমাদের বিব্রত করতো। বিয়ের পর জীবনে প্রথমবারের মতো ঈদের মার্কেট দেখতে গেলাম। হুইলচেয়ারে যেনোবা আমি মানুষ নই এক আজব চিড়িয়া। এরপর ইচ্ছে থাকলেও মার্কেট বা কোথাও বেড়াতে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি।

আমি আবারও বন্দি হয়ে পড়লাম চারদেয়ালের কালকুঠুরিতে। তবে চার বৎসরের বিবাহিত জীবনে আমার স্বামীর ভালোবাসার এতটুকু কমতি হয়নি। আমার প্রতি যথেষ্ট কেয়ারিং সে। কিন্তু আদর যত্ন ভালোবাসা দিয়ে তো আর জীবনের বাস্তবতাকে ঢেকে রাখা যায় না। আমি ছিলাম কল্পনার রঙিন জগতে। আমার ভেতরে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে পড়েছিলো নতুন জীবনে প্রবেশ করে আমি একেবারেই স্বাভাবিক একটা জীবন যাপন করতে যাচ্ছি আর সবার মতোই ভালো থাকবো। অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়বো। হতাশায় ভুগতে হবে না। হয়তোবা আমি অনেকটাই সুস্থ হয়ে ওঠবো। সেরিনা বা হ্যারির মতো পুরোপুরি না হোক, তাদের জীবনযাত্রার স্বাভাবিক পরিবেশ কিছুটা হলেও আমার জীবনকে রাঙিয়ে দেবে। চারদেয়াল থেকে বেরিয়ে যখন সত্যিকার পৃথিবীর রূপ দেখলাম তাকে অনেক নির্মম মনে হলো। ধীরে ধীরে অনুভব করতে পারলাম স্বপ্ন দেখতে চাওয়াটাই প্রতিবন্ধীদের জন্য গুরুতর অপরাধ। তাদের কোন ইচ্ছে থাকতে নেই। আশা আকাঙ্কখার জাল বুনতে নেই। আমার স্বামীর একার পক্ষে সম্ভব হয়নি সমাজের এই কঠিন দেয়াল ভেদ করা। হয়তোবা সেও আমার মতোই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এরি মধ্যে আমার ছোটবোনেরও একই রোগ ধরা পড়লো। আমি আরো হতাশ হয়ে পড়লাম। আমার মাকে প্রাণপণ বোঝাতে চেষ্টা করে যাচ্ছি যাতে আমার মতো তার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে না যায়। আমার মাও চেষ্টা করতে চান। কিন্তু আবার বলে ওঠেন খুব বেশি হলে এসএসসি পর্যন্ত পড়াতে পারবো। ততদিনে ওর শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হবে। সবার সামনে দিয়ে ওকে কোলে করে আনা নেওয়া….. ইত্যাদি- ইত্যাদি হাজারো সমস্যা। পড়ালেখা চালিয়ে নিতে গিয়ে স্কুলে এবং আসা যাওয়ার পথে সবার এই তাকিয়ে থাকাকে কেন্দ্র করে সংকোচবোধ করে আমার বোন। মানুষের বিভিন্ন বাজে মন্তব্য তাকে কাঁদায়। যা অনেক বৎসর আগে আমাকেও সহ্য করতে হয়েছে। যদিও তার স্কুলের প্রিন্সিপাল অনেকখানি সহযোগিতা করছেন আমার মাকে, তবুও একজনের সহযোগিতাই যথেষ্ট নয়। সে পরিবেশটাও দরকার।

এতো গেলো আমার নিজের কথা। এবার বাংলাদেশেরই অবহেলিত অন্য দ’ুপ্রতিবন্ধীর কথা আপনাকে জানাতে চাই। চাঁদপুরের আবু তাহের প্যারালাইসিসে আক্রান্ত। তার ভাই তাকে চট্টগ্রামে প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসনের জন্য গঠিত চিকিৎসালয় নার্চারে নিয়ে যান পাঁচ বৎসর আগে। নার্চারের কাছেই থাকতেন তার এক নিকটাত্মীয়। এ পাঁচ বৎসরে আবু তাহেরের পরিবার ও স্বজনেরা তার খোঁজ নেবার কোন প্রয়োজন মনে করেননি। এবং প্রচুর সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তার চিকিৎসা খরচ চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। হৃদয়ের কথা-ই বলা যায়। ৭/৮ বছরের শারীরিক প্রতিবন্ধী এ শিশুকে কোন স্কুলেই ভর্তি করাচ্ছিলেন না শিক্ষকরা, যদিও সে খুউবই মেধাবী। শেষ পর্যন্ত তার ঠাঁই জুটে চট্টগ্রামের হালিশহরে অবস্থিত দুঃস্থশিশু শিক্ষা কেন্দ্রে। অথচ তাকে ভাল স্কুলে দেবার ইচ্ছে এবং সামর্থ্য রয়েছে তার বাবা-মার। এমন তরো আরো অনেক প্রতিবন্ধী আছে বাংলাদেশে যাদের কথা লিখে শেষ করা যাবে না।

আমার বর্তমান শারীরিক অবস্থা প্রচণ্ডরকম খারাপ। তবুুও আপনাকে জানাবার ভীষণরকম তাগিদ থেকেই শরীরের ওপর জোর খাটিয়ে লিখতে বসেছি। সারাদিন শুয়ে বসে থাকা এবং নিজের ভবিষ্যৎ চিন্তা শরীরকে দ্রুত খারাপের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বেশিদূর পড়ালেখা না করার ফলে প্রায়-ই নানা বিড়ম্বনায় ভুগতে হয় আমাকে। প্রচুর মানুষের ভীড়ে সহজ হতে পারি না, এখন বুঝতে পারি পড়ালেখা না করে কত বড় ভুল করেছিলাম!
ইদানিং টিভিতে প্রায়ই এইডস সচেতনমূলক বিজ্ঞাপনগুলো দেখে একদিন আচমকাই মনে হলো, প্রতিবন্ধীদের জন্যে কি এমন কিছু করা যায় না, যাতে করে বাইরের দেশগুলোর মতো আমাদের দেশের মানুষও সচেতন হয়ে ওঠবে? এইডস নিয়ে এতো প্রচার! প্রতিবন্ধীদের জন্যেও কী এভাবেই আমাদের শক্তিশালী গণমাধ্যমগুলোতে নাটক-বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এমন কিছু প্রচার করা যায় না? যা দেখেশুনে আমাদের দেশের প্রতিটি মানুষই ভাবতে বাধ্য হতেন, তাদের ঘরেও একজন প্রতিবন্ধী থাকতে পারতো। আর যদিবা থাকতো তাদের সাথে কেমন ব্যবহার করা উচিৎ। কেমন করে কথা বলা উচিৎ। তাদের ভবিষ্যৎ মজবুত করার জন্য যা কিছুই প্রয়োজনীয় তা তাদের মানবিক অধিকার।

আপনি আমাদের অর্থাৎ জনগণের ভালোমন্দ দেখার কঠিন দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি আমার মায়ের মতোনই। তাই আপনার কাছে আমার কিছু প্রশ্ন, আমি যদি আপনার মেয়ে হতাম সমাজের চোখ থেকে আমাকে এভাবে আড়াল করে রাখতে পারতেন? আপনি পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর সম্পরকে আমারচে’ ভালো জানেন। আপনিই বলুন, আমার সুস্থ ভাইয়েরা যদি পড়ালেখা করে নিজের মজবুত ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন দেখে তাহলে আমরা কেনো পারবো না? শুধুমাত্র অসুস্থ বলে! এটা কি আমাদের অপরাধ? আমাদের পড়ালেখার স্বাভাবিক পরিবেশ কেনো নেই? কেনো আমরা সবার মতোন থিয়েটারে গিয়ে সিনেমা-নাটক দেখতে পারি না? কিম্বা চাচা-মামা ঘনিষ্ঠ স্বজনের বিয়ের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পারি না? কেনোইবা আমরা স্বামী-স্বজন নিয়ে হই-হুল্লোর করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারবো না? আর কত পিছিয়ে থাকবো আমরা???

আপনার কাছে আমার আকুল আবেদন, আমাদের জন্য এমন কিছু করুন যাতে আমার মতো প্রতিবন্ধীরা আবারো স্বপ্ন দেখার সাহস অর্জন করে। কিছু একটা অবলম্বন করে বাঁচার সুযোগ পায়। যে ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে এখন আমাকে দিন যাপন করতে হয় আমি চাই না আর কোন প্রতিবন্ধী মানুষ বা তার পরিবার সে যন্ত্রণা ভোগ করুক। আর যারা আমার ছোটবোনের মতো সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছে তারা যেনো মানুষের মতোন মানুষ হয়ে গড়ে ওঠতে পারে এবং তাদের উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থার সে পরিবেশ আমাদের দেশেই গড়ে তোলা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। আমাদেরও স্বপ্ন দেখার অধিকার আছে। আছে আর দশজন মানুষের মতোন সুন্দরভাবে বাঁচার অধিকার। এটুকু যদি দেশের সাধারণ মানুষ অনুভব করতে পারে এবং সচেতন হয়ে ওঠে তাতেই হয়তো প্রতিবন্ধীরা স্বাভাবিক জীবন যাপনের প্রয়োজনীয় পরিবেশটুকু পাবে।

আপনার অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করলাম। আমি আপনাকে লিখে জানাবার সুযোগ অন্তত পেয়েছি। আমার চেয়েও করুণ অবস্থায় আরো অনেকেই আছেন যারা তাদের বঞ্চনার কথা কারুর সাথে ভাগ করে নিতে পারছেন না। অনেকের হয়তোবা লিখার মতো শারীরিক শক্তিটুকুও নেই। আমি নিজেও গত চার পাঁচদিনের চেষ্টায় একটু একটু করে লেখাটি শেষ করেছি। প্রচণ্ড হাত ব্যথা করছে। যদিও অনেক কষ্ট হয়েছে তারপরও লেখাটি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হলে আমার কষ্টকে সার্থক মনে করবো। আরো অনেক- অনেক কিছুই জানবার ইচ্ছে অব্যক্ত রয়ে গেলো। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে অবশ্যই তা পূরণের ইচ্ছে রইলো। আপনার ভালো এবং সুস্থতাই কাম্য। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার সমৃদ্ধি কামনায়।

সাবরিনা চৌধুরী
চট্টগ্রাম।