মেধাবী কমলেশ তবুও হতাশাগ্রস্থ

প্রেমানন্দ ঘরামী ॥  সহপাঠীরা যখন পরীক্ষার ফলাফল জানার জন্য অধীর আগ্রহ নিয়ে স্কুলে ছুটছেন কিংবা ফলাফল জেনে আনন্দ উল্লাসে মিষ্টি বিতরণে মেতে আছে। ঠিক তখন গত বৃহস্পতিবার (৯ মে) দুপুরে বাবার সাথে পাশ্ববর্তী বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার রাজিহার গ্রামের এক গৃহস্তের বাড়িতে কাঠ মিস্ত্রীর কাজ করছিলো এবারের এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়া মেধাবী ছাত্র কমলেশ বালা। ওইদিন বিকেলে সহপাঠীরা কমলেশের খোঁজ নেয়ার জন্য তাদের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে অতীতের ন্যায় কমলেশ কামলা দিতে রাজিহারে গেছে। পরবর্তীতে সহপাঠীরা রাজিহারে গিয়ে কমলেশের কাছে জানায় তার অভাবনীয় সাফল্যের খবর। ওইসময় আনন্দে আত্মহারা হয়ে পিতা-পুত্র একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। এ সাফল্যের পরেও হতাশ হয়ে পরেছেন মেধাবী ছাত্র কমলেশের দিনমজুর পিতা কেশব বালা। ছেলের ইচ্ছা থাকা সত্বেও আর্থিক অভাব অনটনের কারনে সে ও তার মেধাবী পুত্র কমলেশ অনেকটাই উচ্চ শিক্ষার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। বরিশালের গৌরনদী উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত ইছাগুড়ি বাকাই গ্রামের কাঠ মিস্ত্রী কেশব বালার পুত্র কমলেশ বালা।

 

স্থানীয় লোকজন ও স্কুল শিক্ষকেরা জানান, কেশব বালার নেই কোন জমাজমি। নিজে পেশায় একজন কাঠ মিস্ত্রী। তার স্ত্রী গীতা রানী বালা অভাবের সংসারে স্বামীর পাশাপাশি অন্যের জমিতে কৃষানের কাজ করছেন। তাদের এ অভাবের সংসারে যেন ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের হাঁসি নিয়ে জন্মগ্রহন করেছেন পুত্র কমলেশ বালা ও সুবল বালা। মেধাবী কমলেশ বাকাই নিরাঞ্জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে বাবার সাথে কাঠ মিস্ত্রীর কাজ করে মাঝে মধ্যে স্কুলের ক্লাস করতেন। সুবল বালা একই স্কুলের সপ্তম শ্রেনীতে অধ্যায়নরত।

 

কমলেশ বালা জানায়, সে বাবার সাথে হাতুরি পেটানোর মাঝেই স্বপ্ন দেখতো নিজে পড়া লেখা করে অনেক বড় হবে। ছোট ভাই সুবলকেও লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মত মানুষ করবেন। তাই দৃঢ় প্রত্যয় ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে কাজের ফাঁকে সে নিয়মিত লেখা পড়া চালিয়ে যেতো। তার এ আত্মবিশ্বাসের ফলেই এবারের এসএসসি পরীক্ষায় কমলেশ বালা বাকাই নিরাঞ্জন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। কমলেশ বালার অভাবনীয় সাফল্যের খবর পেয়ে আজ শনিবার সরেজমিনে ওই বাড়িতে গেলে স্থানীয় সমাজ সেবক মোঃ শাহজাহান, জাকির  হোসেন, হরিপদ বালাসহ অনেকেই জানান, ঘর নেই (জরাজীর্ন বসত ঘর), পড়ার টেবিল নেই, বাড়িতে নেই বিদ্যুৎ, প্রাইভেট পড়াতো ভাগ্যেই জোটেনি, নিয়মিত ক্লাস করতে না পারার মধ্যেও নিজের অদম্য চেষ্টা ও স্কুল শিক্ষকদের সহায়তায় অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে কাঠমিস্ত্রি কমলেশ বালা পুরো গ্রামটিকে আলোকিত করেছে।

 

বাকাই নিরাঞ্জন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অখিল চন্দ্র দাস জানান, কমলেশ পেশাগভাবে একজন কাঠ মিস্ত্রী। ছোট বেলা থেকেই তার মেধাশক্তি খুবই ভালো। প্রাথমিক ও জুনিয়র বৃত্তি পাওয়ার পর কমলেশ স্কুলের শিক্ষক ও স্থানীয়দের নজর কাড়ে। স্কুল পরিচালনা কমটির সভাপতি মোঃ শাহজাহান মিয়া জানান, কমলেশ মেধাবী হওয়ায় স্কুল থেকে তার বেতন মওকুফসহ মাঝে মধ্যে খাতা কলম সরবরাহ করা হতো। এছাড়া স্কুলের শিক্ষকেরা তাকে পড়াশোনায় উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান করেছেন। আনন্দে আবেগ আপ্লুত হয়ে কমলেশ বালা বলে, দিনের বেলা কাঠ মিস্ত্রির কাজ শেষে বাড়িতে ফিরতাম। রাতে কুপির আলোর দিয়ে দু’তিন ঘন্টা করে পড়াশুনা করতাম। সহপাঠীদের কাছ থেকে ক্লাসের পাঠদানের খবরা খবর জেনে নিতাম। কমলেশ মেদাকুল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বাসুদেব বৌসের পুত্র কলেজ ছাত্র বাপ্পী বৌসের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলে, বাপ্পী দা মোরে গণিতসহ বিজ্ঞান বিভাগের প্রায় বিষয় সম্পর্কে বুঝিয়েছেন। মেধাবী কমলেশ উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ভবিষ্যতে একজন প্রকৌশলী হতে চায়।
কমলেশের বাবা কাঠমিস্ত্রি কেশব বালা ও মা কৃষাণী গীতা রানী বালা পুত্রের সাফল্যে আনন্দিত হয়ে পুত্রের ভবিষ্যত নিয়ে হতাশ হয়ে পরেছেন। বলেন, ভগবান মোগো ভাঙ্গা ঘরে চাঁন্দের হাঁসি ফুটাইলেও এ্যাহন কি কইরা পুতেরে কলেজে ভর্তি করমু। কি কইরা কলেজের পড়ার খরচ যোগামু বলেই তারা কান্নায় ভেঙ্গে পরেন।