ঘূর্ণিঝড় মহাসেন : আতঙ্ক-উৎকন্ঠায় দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ

এম. মিরাজ হোসেন, বরিশাল থেকে ॥  ভয়াবহ সিডর ও আইলার আঘাতে বিপর্যস্ত দক্ষিণাঞ্চলবাসীর মাঝে ঘূর্নিঝড় ‘মহাসেন’ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। উপকুলীয় নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষ তীব্র আতঙ্ক নিয়ে এখন সময় কাটাচ্ছেন।  ইতোমধ্যেই কলাপাড়ার রামনাবাদ এলাকায় বেড়িবাঁধ ও ক্লোজার ভেঙ্গে কয়েক’শ একর ফসলী জমিসহ ঘরবাড়ির আঙ্গিনায় লোনা পানি প্রবেশ করছে। এখানকার বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা ৫ সহস্রাধিক পরিবার ঘুর্নিঝড় নিয়ে তীব্র উৎকন্ঠায় রয়েছেন। একই আতংকে বর্তমানে পর্যটক শূণ্য রয়েছে সমুদ্র সৈকত কুয়াকাটায়। তবে ঘুর্নিঝড় মোকাবেলায় ব্যাপক প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তর থেকে। পাশাপাশি প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বিভিন্ন সাহায্যকারী বেসরকারী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান।

ঘুর্নিঝড় ‘মহাসেন’র খবর প্রচারের পর থেকে দক্ষিণাঞ্চল জুড়ে সাধারন মানুষের মাঝে শুরু হয় শঙ্কা ও দুশ্চিন্তা। দুর্যোগ মোকাবেলায় ৪টি কমিটি গঠন করা হয়। পাশাপাশি জেলার সকল সরকারি, আধা-সরকারি ও সরকার নিয়ন্ত্রিত সকল প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। ‘মহাসেন’ মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে বরিশাল জেলা প্রশাসক মোঃ শহীদুল আলম জানান, প্রয়োজনীয় ব্যবস্তা গ্রহনের জন্য ৪ টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য, আইন শৃঙ্খলা ও কৃষি ব্যবস্থাপনা। ঘূর্নিঝড় বরিশালে আঘাত হানলে এসব কমিটি সম্মিলিতভাবে দুর্যোগ মোকাবেলায় কাজ করবে। তিনি নিজেই কমিটিগুলো মনিটরিং করবেন। জেলা প্রশাসক আরো জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় জেলার ১০ উপজেলার চেয়ারম্যান ও নির্বাহী কর্মকর্তাদের সার্বিক প্রস্তুতি নেয়ারও নিদের্শ দেয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক, মেডিকেল টিম, আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। সতর্ক সংকেত বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে উপকূলীয় এলাকার লোকজনদের নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে আনার জন্য উপজেলা, পুলিশ প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা কাজ শুরু করবে। এছাড়া প্রচার প্রচারনার জন্য মাইকিং এবং স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্যোগ মোকাবেলা সংক্রান্ত বিভিন্ন পরামর্শ দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে জিআর প্রকল্পের এক’শ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এছাড়াও দুর্যোগের খবর আদান প্রদানের জন্য ইউনিয়ন ও উপজেলা জেলা পর্যায়ে তথ্য সেল গঠন করা হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে কট্রোল রুম খোলা হয়েছে।

এদিকে, ‘মহাসেন’ মোকাবেলায় ইতিমধ্যে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে ঘূর্নিঝড় প্রস্তুত কর্মসূচী বরিশাল অঞ্চল। উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুর রশীদ জানান, ঘূর্নিঝড় প্রস্তুত কর্মসূচী বরিশাল অঞ্চলের (সিপিপি) আওতায় ৫টি উপজেলায় (শরনখোলা, মঠবাড়িয়া, দশমিনা, গলাচিপা ও বাউফল) ৫ হাজার ৩’শ স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি-সম্পাদকদের কাছে ঘূর্নিঝড়ের খবর সরবরাহ করা হচ্ছে। সকল মাছ ধরার ট্রলারকে উপকূলের কাছাকাছি আনা ও ১৫৩টি সিপিপি ইউনিটে সাংকেতিক পতাকা উত্তোলন করা হয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় জরুরী সভা করা হয়েছে। ওয়ারলেসের মাধ্যমে ঘূর্নিঝড়ের শেষ খবর উপকূলীয় এলাকায় পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। অপরদিকে, বরিশাল স্বাস্থ্য বিভাগের সবার ছুটি বাতিল ও কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশ দিয়েছে সিভিল সার্জন। সিভিল সার্জন ডাঃ এটিএম মিজানুর রহমান জানান, মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় জরুরী ওষুধও মজুদ রাখা হয়েছে। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম।

উপকুলীয় এলাকা কলাপাড়ায় ইতিমধ্যেই বেড়িবাধ ভেঙ্গে ডুবে গেছে কয়েক’শ একর জমির ফসল। নাওয়াপাড়াসহ ৪-৫টি গ্রামের উঠান-আঙ্গিনায়ও প্রবেশ করেছে লোনা পানি। ফলে তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে মানুষের মাঝে। ঘুর্নিঝড় মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসন জরুরী সভার মাধ্যমে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে। কলাপাড়া উপজেলা দপ্তর থেকে জানা গেছে, সমুদ্র থাকা ট্রলার ও মাছ ধরা নৌকাগুলি নিরাপদস্থানে আশ্রয় নেয়ার জন্য খবর পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবকের পাশাপাশি ১০৫টি আশ্রয় কেন্দ্রও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী উপজেলা পাথরঘাটায় ঝড় পুর্ববর্তী অবস্থা বিরাজ করছে বলে জানা যায়। বিভিন্ন মহল থেকে জানা গেছে, গতকাল বুধবার এ রিপোর্ট লেখার সময় (বিকেল চারটা) ওই এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। বাতাসে কোন গতিবেগ ছিল না বললেই চলে। এ অবস্থায় যে কোন সময় ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে বলে উৎকণ্ঠায় রয়েছে ওইখানকার মানুষ। নিরাপদস্থানে আশ্রয় নিতে দিনভর ব্যাপক প্রচারনা চালানো হয়েছে। এছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরনের শুকনো খাবার বিক্রয় বন্ধ করে মজুদ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সনের ১৪ নবেম্বর রাতে বয়ে যাওয়া ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় সিডরে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়। কয়েক হাজার মানুষের প্রানহানির পাশাপাশি অসংখ্য ঘরবাড়ী-গাছপালা-গবাদিপশু ও মৎস্যসহ কোটি কোটি টাকার ফসলের ক্ষতি হয়েছিলো। এরপর পরই পূর্ণরায় আইলার আঘাত হানে এসব অঞ্চলে। এখনও সিডর ও আইলায় গৃহহারা অনেকেই গড়ে তুলতে পারেননি পূর্ণাঙ্গ আবাস। ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার সম্পন্ন হয়নি। এ অবস্থায় ঘুর্নিঝড় মহাসেন’র খবরে সকলের মাঝে দুশ্চিন্তা ও আতংক তীব্রতর আকার ধারন করেছে।