সামরিক আদালতে প্রদত্ত তাহেরের জবানবন্দি

জনাব চেয়ারম্যান ও ট্রাইব্যুনালের সদস্যবৃন্দ

আপনাদের সামনে দণ্ডায়মান এই মানুষটি, যে মানুষটি আদালতে অভিযুক্ত- সেই একই মানুষ এ দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য রক্ত দিয়েছিল, শরীরের ঘাম ঝরিয়েছিল। এমনকি নিজের জীবন পর্যন্ত পণ করেছিল। এটা আজ ইতিহাসের অধ্যায়। একদিন সেই মানুষটির কর্মকাণ্ড আর কীর্তির মূল্যায়ন ইতিহাস অতি অবশ্যই করবে। আমার সকল কর্মে, সমস্ত চিন্তায় আর স্বপ্নে এই দেশের কথা যেভাবে অনুভব করেছি তা এখন বোঝানো সম্ভব নয়।  

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। এই দেশের সঙ্গে আমি রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ। আর এরা কিভাবে অস্বীকার করে এই দেশের অস্তিত্বে আমি মিশে নেই। যে সরকারকে আমিই ক্ষমতায় বসিয়েছি, যে ব্যক্তিটিকে আমিই নতুন জীবন দান করেছি, তারাই আজ এই ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আমার সামনে এসে হাজির হয়েছে। এদের ধৃষ্টটা এতো বড়ো যে তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা  মতো আরো অনেক বানানো অভিযোগ নিয়ে আমার বিরুদ্ধে বিচারের ব্যবস্থা করেছে। আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তার সবই বিদ্বেষপ্রসূত, ভিত্তিহীন, ষড়যন্ত্রমূলক, সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি সম্পূর্ণ নিরপরাধ।  

এই ট্রাইব্যুনালের রেকর্ডকৃত দলিলপত্রে দেখা যায় যে উনিশ শ’ পঁচাত্তর-এর ৬ ও ৭ নভেম্বর ঢাকা সেনানিবাসে আমার নেতৃত্বে সিপাহি অভ্যুত্থান হয়। সেদিন এভাবেই একদল বিভ্রান্তকারীর ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র নির্মূল করা হয়। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান আর দেশের সার্বভৌমত্বও থাকে অটুট। এই যদি হয় দেশদ্রোহিতার অর্থ তাহলে হ্যাঁ, আমি দোষী। আমার দোষ আমি দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছি। এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছি। সেনাবাহিনী প্রধানকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করেছি। সর্বোপরি বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রশ্নে মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছি। সেই দোষে আমি দোষী।

এর জন্য সেই ছিয়াত্তরের একুশে জুন থেকে আমাকে এভাবে ভয় দেখানো ও কষ্ট দেয়ার কোন দরকার ছিল না। পঁচাত্তরের সাতই নভেম্বর বিচারপতি সায়েমের যে সরকারকে আমরা ক্ষমতায় বসিয়েছি তারা এসব ভালভাবেই জানে। কতগুলো নীতির প্রশ্নে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছিলাম। সব রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়ার কথা ছিল। রাজনৈতিক কার্যকলাপ শুরু করতে দেয়ার কথা ছিল, আর একটা সরকার গঠনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আমার দেশবাসী এর সবই জানে। তারা তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে রেখেছে।

আমাকে এভাবে জেলের মধ্যে এমন এক নিম্ন আদালতের সামনে বিচার করার জন্য হাজির করা হয়েছে। এটা দেশ ও জাতির জন্য চরম অপমানজনক। আপনাদের কোন অধিকার নেই আমার বিচার করবার।  

আমার বিরুদ্ধে আনীত মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগগুলো খণ্ডন করার আগে আপনারদের সামনে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ সম্বন্ধে কিছু বলতে চাই, যা এখানে উল্লেখ  করা হবে খুবই প্রাসঙ্গিক।  

পঁচিশ মার্চের সেই কালরাত্রির কথা আমার মনে পড়ছে। পাকিস্তানি সেনারা বর্বর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাদের দেশবাসীর ওপর। সেদিন চাপিয়ে দেয়া এক যুদ্ধে জয়ী হওয়া ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় ছিল না। হেরে গেলে আমাদের ওপর চেপে বসতো এক জঘন্যতম দাসত্ব। পাকিস্তানি  সামরিক জান্তা তাদের পত্রপত্রিকায় তো প্রকাশ্যেই ঘোষণা দিয়েছিল, বাঙালির উচ্চশিক্ষার যোগ্য নয়। তাদের দৌড় থাকবে মাদ্রাসা পর্যন্তই। বাঙালিরা এমনকি দেশপ্রেমিকও নয়, তাদের সংস্কৃতি নীচু মানের। এদেরকে শুধুমাত্র উর্দু ভাষাতেই কথা বলতে বাধ্য করা উচিত।  

যখন থেকে আমার দেশের মানুষের অবস্থা সম্বন্ধে ভালভাবে বুঝতে শুরু করি, তখন থেকেই আমি পাকিস্তানের ধারণাটার সঙ্গেই কখনো একমত হতে পারিনি। জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন করতে বাঙালিরা নিজেদের জন্য একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে পারে না- এ ধারণাটাই আমি কখনো মেনে নিতে পারি নি। তখন থেকেই আমি সবসময় চেয়েছি আমার দেশের জনগণের মুক্তি ও বাঙালি জনসাধারণের জন্য একটা ন্যায় ভিত্তিক আবাসভূমি। আমি জানি না, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে আমার মতো আর কতজন বাঙালি অফিসার এভাবে একটা স্বাধীন বাংলাদেশের কথা চিন্তা করেছিলেন। নিজের বেলায় এতটুকু বলতে পারি.স্বাধীনতার এই স্বপ্ন এক ধ্রুবতারার মতো আমার সব কাজে পথ দেখিয়েছে।  

আমার এখনও মনে পড়ে পাকিস্তানিরা আমাদের কি পরিমাণ ঘৃণা করতো। তাদের অবজ্ঞা ও উপহাস ছিল অসহ্য। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে আমাদের শেখানো হতো বাঙালিরা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকের জাতি। তাদের জন্ম হয়েছে গোলামী করার জন্য। বাঙালিদের ‘পাক্কা মুসলমান’ ও দেশপ্রেমিক নাগরিক বানানো পাকিস্তানিদের পবিত্র দায়িত্ব।  

আমরা যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম তাদের জন্য সেই দিনগুলো ছিল চরম পরীক্ষার মতো। সেদিন আমি দেশ ও জাতির ডাকে সাড়া দিতে দ্বিধা করি নি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়ার্টার থেকে যখন নির্দেশ গেল- ‘সবকিছু পুড়িয়ে দাও, যাকে সামনে পাও তাকেই মেরে ফেল’; তখন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত কারুরই আর জানতে বাকি ছিল না সামরিক জান্তার বর্বর চক্রান্ত।  

পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিতে আমি বিন্দুমাত্র দ্বিধা করি নি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান জানেন আমি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পেছনের সারির অফিসার ছিলাম না। আমি ঐতিহ্যবাহী বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন পাই, পরে পাকবাহিনীর অভিজাত প্যারা কম্যান্ডো গ্রুপ ‘স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপ’-এ আমি যোগ দেই। দীর্ঘ ছয় বছর আমি সেই গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। একজন সৈনিক ও অফিসার হিসাবে সামনাসামনি শত্রুকে মোকাবেলা করতে আমি কখনো ভয় পাইনি। পাক-ভারত যুদ্ধে আমি কাশ্মীর ও শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেই। সেই যুদ্ধের ক্ষত চিহ্ন এখনো আমার শরীরে বর্তমান।  

বাঙালি অফিসারদের মধ্যে একমাত্র আমিই ‘মেরুন প্যারাসুট উইং’ পাই। আমি একসঙ্গে একশত পঁয়ত্রিশটি স্ট্যাটিক লাইন জাম্প করার কৃতিত্বের অধিকারী। আমার কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করার জন্য আমাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়। জর্জিয়া প্রদেশের ফোর্ট বেনিং.এ অবস্থিত রেঞ্জার ট্রেনিং ইন্সটিটিউট আমাকে রেঞ্জার পুরস্কার ভূষিত করে। আমি নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্যাগ.এ অবস্থিত স্পেশাল ফোর্সেস অফিসার্স ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থেকে সম্মান স্নাতক ডিগ্রী লাভ করি। উল্লেখ্য, তখনো পর্যন্ত আর কোন বাঙালি অফিসার এই কৃতিত্ব অর্জনে সক্ষম হননি।  

এখন সামরিক জান্তার বর্বরতম ফ্যাসিস্ট আক্রমণের দিনগুলো ফিরে আসা যাক। সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলাম। দেশে ফিরে দেখি নির্বাচন হয়ে গেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের দল আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জিতেছে। দেশে ফিরে অনেকের সঙ্গে আলাপ করার পর আমার বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া হবে না। সামরিক জান্তা আর তার দোসর জুলফিকার আলী ভুট্টা, এই লোকটা পাকিস্তানি রাজনীতির অধ্যায়ে একটা জ্বলন্ত অভিশাপ, এরা কোনদিনই রাষ্ট্রক্ষমতার আইনানুগ দাবীদার আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাদের দৃঢ় সংকল্প ছিল যে তারা কখনো পাকিস্তানে কোন বাঙালিকে ক্ষমতাসীন হতে দেবে না, শেখ মুজিবকে তারা কোনভাবেই মেনে নিতে বা সহ্য করতে পারছিল না। আমি অঘটনের আভাষ পেলাম। তাই আমার স্ত্রী ও পরিবারকে ময়মনসিংহে আমার গ্রামের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেই। সময়টা ছিল ফেব্রুয়ারি মাস। শীতের প্রকোপ তখনো যায়নি।  

আমি জানতাম বাঙালিরা কোন অন্যায়কেই বিনা প্রতিবাদে মেনে নেবে না, তারা প্রতিরোধ করবেই। আমার মনে হচ্ছিলো দেশের মানুষকে স্বাধীন করার দিন এগিয়ে আসছে। জানি না কয়জন এভাবে ভাবতেন। যতই দিন যাচ্ছিলো, আমাদের মন মানসিকতারও দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিলো। আস্তে আস্তে আমরা অনিবার্য ঘটনাবলীর জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠলাম।

পঁচিশে মার্চ আমি কোয়েটায় স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস এ উচ্চতর কারিগরি প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছিলাম। সন্ধ্যা নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই জানতে পারলাম সেদিন রাতে বাংলাদেশে কড়া ব্যবস্থা নেয়া হবে। সারা রাত আমি কোয়েটার খালি রাস্তায় হেঁটে বেড়ালাম। কি হচ্ছে তা আঁচ করবার চেষ্টা করছিলাম। সেই রাতে আমার জাতির ওপর কি সীমাহীন দুর্যোগ নেমে এসেছিল তা আমি এখনো কল্পনা করতে পারি না। বাংলাদেশের বুকে যেন এক নারকীয় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল।  

পরদিন ২৬শে মার্চ ভোরেই রেডিওতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানেরে ভাষণ শুনলাম। সে এক ভয়ংকর মুহূর্ত। এক নতুন দেশের জন্ম যন্ত্রণা যেন আমি অনুভব করছিলাম। বাংলাদেশে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য পাক হানাদার বাহিনীর প্রতি আমার বিদ্বেষ কোন গোপনীয় ব্যাপার ছিল না। তাই অচিরেই আমি উপরওয়ালাদের অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ালাম। হঠাৎ করে আটাশে মার্চ স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকসের কোর্স বন্ধ করে দেয়া হলো, আমাদের সবাইকে যার যার ইউনিটে যোগ দিতে আদেশ দেয়া হলো।  

সে সময় অনেক বাঙালি জুনিয়র অফিসার আমার কাছে এসে পরামর্শ চায়। আমি তাদের স্পষ্ট ভাষায় বলে দেই মাতৃভূমির প্রতিই হচ্ছে তাদের একমাত্র কর্তব্য। তাদের একমাত্র চিন্তা হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে যেয়ে যুদ্ধে যোগ দেয়া। এরা আমাকে আরো জানায় যে তারা কোয়েটায় অবস্থানরত অন্য আরো সিনিয়র অফিসারদের কাছে গেয়ে তারা এদের উপদেশ দেয়া তো দূরের কথা সৌজন্য করে আপ্যায়ন কিংবা কথাটা পর্যন্ত  বলে নি; শেষে আবার পাকিস্তানি প্রভুরা তাদের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ করে। আমার মনোভাব জানার পরে এ সমস্ত সিনিয়র অফিসাররা আমাকে শুধু এড়িয়েই চলে নি, এমনকি কথা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল।  

আজকে সেই একই অফিসারদের অনেকেই এদেশের জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে বেশ উচ্চপদে রয়েছেন। আর তাদের কয়েকজন আবার আমার বিচার করার জন্য এখানে উপস্থিত রয়েছেন। পঁচিশে মার্চের আগে এই অফিসাররা শেখ মুজিবের সঙ্গে তাদের পরিচয় ও সম্পর্কের কথা জাহির করতে বেশ উৎসাহ পেতেন, পঁচিশে মার্চের পর এরাই আবার তাঁকে দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেন।  

(ভাষণের এই পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাহেরকে বাধা দেন। এখানে এই ধরনের কথা বলা যাবে না বলে তাঁকে জানানো হয়। কোর্টের মধ্যে প্রচণ্ড বাক বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। তাহের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে বলেন-‘আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ না দিলে আমি বরং চুপ থাকাটাই ভালো মনে করব। এমন নিম্ন মানের ট্রাইব্যুনালের সামনে আত্মপক্ষ সমর্থন করছি। নিজের ওপরই ঘৃণা লাগে।’ আরো বাকবিতণ্ডার পরে তাহেরের আইনজীবীদের হস্তক্ষেপের ফলে শেষে তাহেরকে বক্তব্য রাখার অনুমতি দেয়া হয়।)  

পরে আমি জেনে খুব খুশী হই যে যাদের আমি পালিয়ে আসতে উৎসাহ দিয়েছিলাম, তাদের মধ্যে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নূর ও সেকেন্ডে লেফটেন্যান্ট এনাম পালিয়ে যেতে পেরেছে ও স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। কয়দিন পরই পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করার অভিযোগে আমাকে কোয়েটায় নজরবন্দি করা হয়।  

স্কুল অফ ইনফ্যান্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিকস এর কমান্ডাণ্ট বি. এম. মোস্তফার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। কিছুদিন পর তাঁর হস্তক্ষেপে আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো তুলে নেয়া হয়। খারিয়া সেনানিবাসে একটা মাঝারি রেজিমেন্টের সঙ্গে আমাকে যুক্ত করা হয়। আমাকে আমার আগের কমান্ডে ইউনিটে ফিরে যেতে দেয়া হয়নি। এই ইউনিটকে ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছিল আমার ভাইদের হত্যা করার জন্য। এরাই শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে।  

খারিয়া সেনানিবাসে আমি ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ও ক্যাপ্টেন দেলোয়ারকে আমার সঙ্গে পালিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করি। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মিরপুর শহরে কর্মরত এক বাঙালি প্রকৌশলীর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করি। তিনি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেয়ার আর সীমান্ত পর্যন্ত যাবার ব্যবস্থা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু নির্ধারিত দিনে মিরপুর পৌঁছে দেখি, অবাক কাণ্ড, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বাসায় তালা মেরে পরিজন সহ সটকে পড়েছেন। এই প্রথম দেখলাম বাঙালি অভিজাত শ্রেণীর দেশপ্রেমের নমুনা।  

বিকেলটা আমরা তার লনে বসেই কাটিয়ে দিলাম। রাত নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পাহাড়ি পথে রওয়ানা দিলাম। আমার দুই সহযাত্রী ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ও ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের পাহাড়ি পথে হেটে অভ্যাস নেই। কয়েক ঘণ্টা পর তারা আর এগোতে পারলো না। আমাদের আবার ফিরে আসতে হলো খারিয়াতে।  

তখন পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় এক হাজার বাঙালি অফিসার ছিলেন। তাদের অনেককেই বললাম পালিয়ে যেয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দিতে। বোঝাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু আসলে এদের দেশপ্রেম ড্রইং রুমের তর্কবিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এর বেশী না। পরে যখন আমি এবোটাবাদে বালুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি হয়ে যাই সেখানেও আমি বাঙালি অফিসারদের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে উদ্বুদ্ধ করতাম।  

সৌভাগ্যবশত এদের মধ্যে রাওয়ালপিন্ডির জেনারেল হেড কোয়ার্টার্সে কর্মরত মেজর জিয়াউদ্দিন আমার সঙ্গে পালাতে রাজী হয়ে যান। আমাদের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে দেরী হলো না। আমার যা সঞ্চয় হল তার দিয়ে একটা পুরানো গাড়ী কিনলাম। গাড়ী দিয়ে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে। পিণ্ডি থেকে আমরা দু’জন রওয়ানা দিলাম। পথে ঝিলাম ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে সঙ্গে নিলাম। দিনের আলো তখনো কিছু বাকী ছিল। তাই শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে মেজর মঞ্জুরের বাসায় উঠলাম। আমার পরিকল্পনা শুনে মঞ্জুর চুপ হয়ে গেলেন। তার মধ্যে কোন উৎসাহ দেখলাম না। কিন্তু তার স্ত্রী জেদ ধরলে বাঙালি ব্যাটম্যানসহ মেজর মঞ্জুর সপরিবারে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। সন্ধ্যার পর গাড়ী করে সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছলাম। তারপর গাড়ী ফেলে রেখে হাঁটতে হাঁটতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আমরা ভারতে পৌঁছি।  

আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম এই ভেবে যে এবারে সব শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি ঘটবে। কিন্তু যুদ্ধের পর দেশের কি দশা হলো? যে যুদ্ধের বেশীর ভাগই হয়েছিল স্বদেশের মাটির বাইরে, সে যুদ্ধ আমাদের জনগণকে কি সুফল উপহার দিতে পারে। নিরস্ত্র, শান্তিপ্রিয়, ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিল আশ্রয় আর খাবারের খোঁজে। বেঁচে যাওয়া সৈন্যদের মধ্যে বেশীরভাগই তাই- করেছিল। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য নেতৃত্বদানকারী গণ সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলোর ছিল ঐ একই উদ্দেশ্যে। কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেট লাভকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ছিল এক বিরাট দায়িত্ব ও কর্তব্য। দুর্ভাগ্যবশত সম্পূর্ণ অস্ত্র বলহীন একটি নিরস্ত্র জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনরকম চিন্তাই করেনি। সম্ভাব্য ভয়াবহতা মোকাবেলা করার জন্য আগে থেকে তারা জনগণকে কোনভাবেই প্রস্তুত করেনি। একটা আধুনিক সেনাবাহিনীর সশস্ত্র শক্তির বিরুদ্ধে বেসামরিক জনসাধারণের সংঘাতে যাওয়াটা নিঃসন্দেহে একটা চরম বোকামি। আমাদের ক্ষেত্রে ঠিক তাই ঘটেছিল, আর সে জন্য আমাদের মূল্যও দিতে হয়েছে চড়া ভাবে। দেশের অজস্র মানুষের ভাগ্যের কথা চিন্তা করে আওয়ামী নেতৃত্ব যদি আন্তরিক ও সাহসী ভূমিকা নিত তাহলে ঘটনা প্রবাহ অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি।  

আমাদের সৈন্যদের ক্ষেত্রেও ঐ একই কথা খাটে। অত্যাসন্ন জাতীয় যুদ্ধ সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। পরিণামে বিশ্বের এক অন্যতম প্রধান আধুনিক, সুশৃঙ্খল ও সুশিক্ষিত নিয়মিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে কিভাবে অনিয়মিত বাহিনীর মাধ্যমে এক দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ পরিচালনা করা যাবে তার কোন পরিকল্পনাই ছিল না। ভারত খুব খুশী মনেই আমাদের শিশুদের, সাধারণ মানুষকে আর সেনাদের প্রতি খাবার আর আশ্রয়ের নিরাপত্তা দিতে প্রস্তুত ছিল। কারণ ভারত জানতো এতে করে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আর কূটনীতির অঙ্গনে তাদের সম্মান ও ভাবমূর্তি বেড়ে যাবে। আর উপমহাদেশে তার আধিপত্য বিস্তারের নীতি ও আরও সুদৃঢ় হবে। আসলে বাংলাদেশের ঘটনায় ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থ ও সম্পদের দিক থেকে সবচাইতে বেশী লাভবান হয়েছিল ভারত। যুদ্ধের ব্যাপারে এতটুকু বলতে পারি- আমাদের অফিসার ও সৈনিকরা মূলত ভারতীয়দের ইচ্ছামাফিক তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ করে যাচ্ছিল।  

আমি যখন যুদ্ধে যোগ দেই তখন মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী আমাকে বিভিন্ন সেক্টর পরিদর্শনের নির্দেশ দেন। উদ্দেশ্য ছিল আমাদের খুঁতগুলো চিহ্নিত করে আরও সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার উপায় খুঁজে বের করা। প্রথমেই আমি এগারো নং সেক্টরে যাই। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে বিস্তৃত এই সেক্টরের সীমানা। বর্তমানে উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এই এলাকায় প্রচলিত সামরিক কায়দায় একটা ব্রিগেড গঠনের চেষ্টা করছিলেন। তখন এই সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং।  

আমি দেখে অবাক হয়ে গেলাম, এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে এজন্য ভারতীয় অফিসারকে। রণ কৌশলগত দিক দিয়ে ঢাকা আক্রমণ করার জন্য এই সেক্টরের গুরুত্ব অপরিসীম। আমি ঘুরে ঘুরে সেক্টরের পর সেক্টর পরিদর্শন করতে থাকলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আমি মিশে গেলাম; তাদের সঙ্গে আমার চিন্তাভাবনা ও পরিকল্পনা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করলাম। আমার কাছে এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে যাদের ওপর আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তাদের কেউই সেই দায়িত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। সোজা কথায় তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। আমাদের জাতীয় যুদ্ধ হয়ে উঠেছিল প্রায় হেরে যাওয়া একটা ব্যাপার। অথচ আমরা যুদ্ধ করছিলাম একটা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল নিয়মিত বাহিনীর বিরুদ্ধে। আমাদের শত্রুরা সামরিক দিক থেকে অত্যন্ত সুশিক্ষিত। তারা কঠোরভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত। অন্যদিকে আমাদের এমন কোন সুসংহত নেতৃত্বই ছিল না যা এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হতাশাগ্রস্ত সৈন্যদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারে। আমাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, সুযোগ সুবিধা কিংবা অস্ত্রশস্ত্রের কিছুই ছিল না। অথচ আমাদের নেতৃত্ব তখন বিদেশের মাটিতে একটি প্রচলিত ধরনের সেনাবাহিনী গঠনের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন। আমাদের ছেলেদের কখনও সাহস কিংবা দেশপ্রেমের অভাব ছিল না। কিন্তু তারা ছিল অসংগঠিত, বিভিন্ন দলে বিভক্ত স্বাধীনতা পাগল দামাল ছেলে; যারা কখনও পাক বাহিনীর সামরিক আক্রমণের কথা চিন্তাও করেনি। অসতর্কাবস্থায় এরা তাই পাকিস্তানিদের জঘন্য গণহত্যার শিকার হয়।  

আমাদের যুদ্ধকৌশলের দুর্বলতাগুলো খুব সহজেই চিহ্নিত করা সম্ভব ছিল। প্রথমত আমরা সমস্ত জাতি এক যুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছিলাম। অথচ আমাদের সামনে কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া গেরিলা যুদ্ধ কখনো বিকাশ পেতে পারে না। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব এই সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হয়েছিল।  

দ্বিতীয়ত গেরিলা যুদ্ধের তাত্ত্বিক কাঠামো সম্বন্ধে নেতৃত্বের কোন ধারণাই ছিল না। কর্নেল ওসমানী, মেজর জিয়া, মেজর খালেদ ও মেজর শফিউল্লাহর মতো অন্যান্য যারা নিয়মিত সামরিক কাঠামোর লোক তাঁদের মধ্যে এমন লোক খুব কমই চিলেন যারা গেরিলা যুদ্ধ কিভাবে সংগঠন করতে হয় সে সম্বন্ধে কোন ধারণা রাখতেন। গেরিলা যুদ্ধের স্বাভাবিক বিকাশের পথে বড় বাধা ছিল এসব অফিসার আর তাদের প্রচলিত কায়দার সামরিক চিন্তাভাবনা।  

তৃতীয়ত স্বাধীনতা যুদ্ধের সামরিক নেতাদের সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্য ও অফিসারদের কতগুলো নিয়মিত ব্রিগেডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করা হয়েছিল। সাধারণভাবে গড়ে ওঠা মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা তাই প্রয়োজনীয় সামরিক নেতৃত্ব ও কলাকৌশল অর্জন করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। এর আসল কারণ হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর নেতাদের মুক্তি সংগ্রাম সম্বন্ধে ধারনার অভাব। তাদের একমাত্র চিন্তা ছিল কিভাবে একটা নিয়মিত বাহিনী গড়ে তুলে নিজেদের ক্ষমতার আসন পাকাপোক্ত করা যায়।

তখন বলা হচ্ছিল যথা সময়ে বিশ ডিভিশন সৈন্যের এক বাহিনী গড়ে তোলা হবে। আর ঠিক এভাবেই তখন বিকাশমান একটি জাতীয় গণযুদ্ধের স্বাভাবিক বিকাশের গতি রুদ্ধ করা হচ্ছিল। দেশের ভেতর মুক্তিসেনারা বীরের মতো যুদ্ধ করে যাচ্ছিল, কিন্তু তাদের অনুপ্রেরণা দেয়ার মতো কেউই ছিল না। বাইরে থেকে বাধা না আসলে হয়তো দেশের ভিতরেই স্বাভাবিকভাবে যোগ্য ও দূরদর্শী নেতৃত্ব গড়ে উঠতে পারত। আগরতলা আর মেঘালয়ে মেজর খালেদ মোশাররফ আর জিয়ার নেতৃত্বে যে দুই ব্রিগেড সুশিক্ষিত সৈন্য গড়ে উঠেছিল তাদের যদি মুক্তিযুদ্ধে সঠিকভাবে নিয়োজিত করা হতো তাহলে সাত.আট মাসের মধ্যেই দেশের মাটিতে ক্ষেতমজুর-কৃষকদের নিয়ে বিশ ডিভিশনের এক বিশাল গেরিলা বাহিনী প্রস্তুত হয়ে যেত।  

আমার কথা শুনে কর্নেল ওসমানী যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছিলেন। তখন তাঁর কাজকর্ম খুব সহজই ছিল। ঘুমানো জন্য তাঁর একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছিল। আর ঘুরে ঘুরে সেক্টর সদরগুলো দেখার জন্য তাঁর হাতে থাকতো অনেক সময়। আসলে এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের নামে এক প্রহসন। নেতৃত্ব ছিল পাগলামীর নামান্তর। একটা গেরিলা যুদ্ধ আর একটা নিয়মিত যুদ্ধের মধ্যে আসলে অনেক তফাৎ। কিন্তু কর্নেল ওসমানী কখনোই তা বুঝতে চাননি। গেরিলা যুদ্ধের প্রথম দিকেই একটা নিয়মিত বাহিনী গঠনের চিন্তা করা একদম ঠিক নয়। ঠিক সময় এলে একটা গেরিলা বাহিনী নিজেই নিয়মিত বাহিনীতে পরিণত হয়।  

এগারো নং সেক্টরের কৌশলগত গুরুত্ব দেখে সেখানেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেই। বিভিন্ন সেক্টর ঘুরে বেড়ানোতে শুধু সময়ের অপচয় হতো মাত্র। ওসমানী অসন্তুষ্ট মনেই আমাকে সেক্টর প্রধান নিয়োগ করলেন।  

(এতটুকু বলার পর তাহেরকে আবার বাধা দেয়া হয়। আবারো বাক-বিতণ্ডা শুরু হয়। তাহেরকে তাড়াতাড়ি শেষ করতে বলা হয়। কর্নেল তাহের তখন বলেন- এভাবে আমাকে বাধা দিতে থাকলে জবানবন্দি বলে যাওয়াটা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমার জীবনে অনেক নিচু লোকই চোখে পড়েছে, কিন্তু আপনার মতো নীচ মনের লোক আমি একজনও দেখিনি।)  

চতুর্থত বাংলাদেশের মাটিতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কাদের সিদ্দিকী, মেজর আফসার, খলিল, বাতেন ও মারফতের মতো এরা অনেক খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর এক বিশাল দল গড়ে উঠেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধরত শক্তিগুলোর এটাই ছিল স্বাভাবিক বিকাশ। দুর্ভাগ্যবশত কর্নেল ওসমানীর নিয়মিত সামরিক কমান্ড ও প্রবাসী সরকার এই স্বাভাবিক  শক্তির বিকাশকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। তার ফলে নিয়মিত বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সমন্বয় সাধিত হয়নি।  

পঞ্চমত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) অশুভ প্রভাবে মুক্তিবাহিনীর কিছু সংখ্যক ছেলের মাথায় ব্যক্তিগত লোভ-লালসার চিন্তা ঢুকে যায়। এদের আদর্শগত ভিত্তি ছিল নিতান্তই দুর্বল। এরাই অনেক লুট-পাটের ঘটনার নায়ক।  

এসব সমস্যা সমাধানের পথ ছিল একটাই। তা হচ্ছে বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তাঞ্চলে প্রবাসী সরকারকে নিয়ে আসা। আমি সামরিক নেতৃত্বকে বোঝাতে চেষ্টা করি যেন ভারতীয় এলাকা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের ভেতরে কোথাও সদর দপ্তর স্থানান্তর করা হয়। মেজর জিয়া আমার সঙ্গে একমত হলেন। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম সব কমান্ড সীমান্তের এপারেই স্থানান্তর করা উচিত। আমাদের ইচ্ছা ছিল সব সেক্টরে সমন্বিত ভাবে একটা নির্ধারিত সময়ে এই কাজ হোক। তাই সেক্টর কমান্ডারদের একটা সভা ডাকা হলো। কর্নেল ওসমানী সহ মেজর খালেদ মোশাররফ আর মেজর শফিউল্লাহ আমার প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেন। বাংলাদেশের মাটিতে সেক্টর সদর দপ্তর স্থানান্তর করা থেকে আমাদের বিরত করা হলো। শুধু তাই না, মেজর জিয়ার ব্রিগেডকে আমর সেক্টর থেকে সরিয়ে নেয়া হলো।  

আমার সঙ্গে থেকে যান ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ নামে একজন বিমান বাহিনীর অফিসার ও যুদ্ধাহত অফিসার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মান্নান। যাতায়াতের জন্য আমাকে শুধুমাত্র একটা জিপ দেয়া হয়েছিল। আমাদের অসহায় অবস্থার সুযোগ নিয়ে ব্রিগেডিয়ার সিং ভাবলেন তিনি তাঁর ইচ্ছামতো আমাদের চালাতে পারবেন। ব্রিগেডিয়ার সীমান্ত থেকে প্রায় চল্লিশ মাইল দূরে ‘তুরা’ নামে এক জায়গায় আমার সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপন করার পরামর্শ দিলেন। উল্লেখ্য, আমাদের প্রায় সব সেক্টর সদরই ছিল ভারতের অনেক ভেতরে। আমাদের প্রায় সব সেক্টর অধিনায়কই তাদের তাবুতে কার্পেট ব্যবহার করতেন।  

আমি ব্রিগেডিয়ার সিং-এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম। কামালপুর শত্রু-ঘাটির আটশ’ গজ দূরে অবস্থিত হলো এগারো নং সেক্টরের সদর দপ্তর। আমি ভালোভাবেই জানতাম আমাকে সেই পথের ওপর জোর দিতে হবে যা আমাদেরকে এনে দেবে চূড়ান্ত বিজয়। আর এই পথ হবে কামালপুর, জামালপুর ও টাঙ্গাইল হয়ে শেষে ঢাকা। কামালপুরই ছিল ঢাকার প্রবেশদ্বার।  

আমি এখন সুবেদার আফতাব নামে এক বীর মুক্তিযোদ্ধার স্মৃতি স্মরণে কিছু বলতে চাই। সে ছিল সুঃসাহসী এক নিবেদিত প্রাণ যোদ্ধা। সে কখনো দেশের মাটি ত্যাগ করে নি। কিছু সংখ্যক যুবককে নিয়ে সে বীরত্বের সঙ্গে পাক দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছিলো; মওকা পেলেই সে তাদেরকে নাস্তানাবুদ করে ছাড়তো। এগারো নং সেক্টরে আসার পর আমি শুনতে পেলাম সুবেদার আফতাব এক বিদ্রোহী। সে কারো আদেশ-নির্দেশের তোয়াਆা করে না। রৌমারি থানার কোদালকাঠি নামে এক জায়গায় সে অবস্থান করছিলো। বারবার নির্দেশ পাওয়া সত্ত্বেও সে কখনোই মেজর জিয়া বা ব্রিগেডিয়ার সিং-র সঙ্গে দেখা করে নি। আমি আফতাব সম্বন্ধে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে পড়লাম। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আঠারো মাইল হেঁটে আমি কোদালকাঠি পৌঁছাই। সে দারুণ অবাক হয়ে গিয়েছিল। দেশের ভূখণ্ডে খোদ একজন অফিসারকে দেখবে তা সে কখনো আশাই করেনি। যুদ্ধ কৌশল নিয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে গিয়ে দেখি আমাদের মত অভিন্ন। তারপর থেকেই আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে যাই।

(ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান আবারো বাধা দিলেন। তাহের তখন বলেন- এই কথাগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। আপনিতো (চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ্যে করে) যুদ্ধে ছিলেন না, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্বন্ধে আপনার কি ধারণা থাকবে।’ এই বলে তিনি আবার শুরু করেন।

সুবেদার আফতাব আমাকে জানালো, সে রৌমারি থানার এক বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত রাখতে সক্ষম হয়েছে। ষোলই ডিসেম্বর পর্যন্ত এই এলাকাগুলো মুক্তাঞ্চল ছিল। যুদ্ধ চলাকালীন পুরো সময়টাই সে ভারতের অভ্যন্তরে ঘাঁটি স্থাপন করতে অস্বীকার করে আসছিল। সে রাত আমি তাঁর সঙ্গে কথা বলে কাটিয়ে দিলাম। দেখলাম সে খুব সহজেই মানুষের নেতৃত্বের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিতে পেরেছে। তার সামনে নিজেকে বড়ো ছোট লাগলো।  

সুবেদার বললো সে যে কোন কিছু করার জন্য প্রস্তুত আছে। ওদের অবস্থানের কিছু দূরে এক চরে পাকিস্তানিদের এক ঘাঁটি ছিল। আমি তখন তাদের তাড়িয়ে দেয়ার জন্য একটা আক্রমণের প্রস্তাব দিলাম। দুই শিবিরের মধ্যে একটা নদী। পাকিস্তানিরা যে চরে অবস্থান নিয়েছিল তা একটা খালের মাধ্যমে দু ভাগে ভাগ হয়ে আছে। আমি আর সুবেদার একটা নৌকায় করে চরে পৌঁছলাম। দেখি পাকিস্তানিরা চরের অন্য প্রান্তে। এই চর ছিল ঘন কাশবনে ঢাকা। আমি পরিকল্পনা করলাম একদল যোদ্ধা রাতে নদী পার হয়ে খালের পাশের কাশবনে অবস্থান নেবে। পরদিন ভোরে একটা ছোট দল বের হবে পাকিস্তানিদের হাতে তাড়া খাবার জন্য। চারদিনের মধ্যেই সুবেদার আফতাব পরিকল্পনা মাফিক অভিযানের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল।  

যা আশা করেছিলাম তাই হলো, পাকিস্তানিরা ভোরবেলার দলটাকে পিছু ধাওয়া করলো। এভাবে ওদের মুক্তিযোদ্ধাদের মৃত্যু ফাঁদের আওতার ভেতরে নিয়ে আসা হলো। প্রথম দফা আক্রমণেই পাকিস্তানিদের বেশ বড়োসড়ো ক্ষতি হলো। ওরা দু’বার আক্রমণ করলো, দু’বারই আক্রমণ প্রতিহত হওয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তারা পালিয়ে গেল। এভাবেই রৌমারি থানা সহ বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা আমাদের দখলে আসে।  

এরপর আমরা চিলমারীর ওপর নজর দেই। চিলমারী যুদ্ধ এক পরিচিত সংঘর্ষ। আমি এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। তখন মাঝ সেপ্টেম্বর। একরাতে বারো শ’ মুক্তিযোদ্ধা ব্রহ্মপুত্র নদী পাড়ি দিল। আমাদের লক্ষ্যস্থল পাহারায় ছিল দুই কোম্পানি পাকিস্তানি নিয়মিত সৈন্য। এছাড়া অজস্র রাজাকার তো ছিলই। আমরা ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত চিলমারী বন্দরকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। আর প্রচুর গোলাবারুদ ও যুদ্ধবন্দি নিয়ে ফিরে এসেছিলাম। এটা ছিল এক দুঃসাহসিক আক্রমণ। এমন নজির যুদ্ধের ইতিহাসে কমই আছে।  

সেপ্টেম্বর মাস থেকেই রেডিওতে প্রচারিত স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত সংবাদের বেশীর ভাগেই থাকতো আমাদের সেক্টরের খবর। এমনকি বিখ্যাত আমেরিকান সাংবাদিক জ্যাক অ্যান্ডারসনও আমাদের এলাকার অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এই বলে- কামালপুরের ঘাঁটি পতনের মানেই হচ্ছে পাকিস্তানিরা এই যুদ্ধে হেরে গেছে। কামালপুরে যুদ্ধ পরিচালনার সময় আমার একটা পা হারাই। আমার সেক্টরের ছেলেরাই সবার আগে ঢাকা পৌঁছেছিল।

স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা বলতে যেয়ে অবশ্যই আমাদের মুক্তিসেনাদের দেশপ্রেম, বীরত্ব ও আনুগত্যের উল্লেখ করতে হয়। এরাই জাতির সেরা সন্তান। এছাড়াও গ্রামের সব গরীব গ্রামবাসীদের কথাও বলতে হয়। এরা আমাদের দিয়েছে খাদ্য ও আশ্রয়। শত্রু-সনার অবস্থান সম্পর্কে তারা আমাদের সব সময় খবর দিয়েছে। এরা ছিল আমাদের সার্বক্ষণিক অনুপ্রেরণার উৎস। আমার হাতে তো তাও একটা অস্ত্র ছিল। এদের কাছে কিছুই ছিল না। আমাদের সাহায্য করতে যেয়ে এরা পাকিস্তানি বুলেটের শিকার হয়েছে। তাদের ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে, তাদের স্ত্রী-মা-বোনদের সম্মানহানি করা হয়েছে। এরাই ছিল আসলে সবচেয়ে বেশী সাহসী। এদের কথা আমি সব সময় মনে রাখবো।  

ষোলই ডিসেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। এতে আশ্চর্যের কিছুই ছিল না। আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের অসাবধানী, অযোগ্য ও দেউলিয়া আচরণের জন্যই প্রবাসী সরকার সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে পড়েছিল। এর ফলে ভারতীয় হস্তক্ষেপের একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়। ঘাঁটিগুলো ভারতে থাকায় ও ভারতের ওপর নির্ভরশীলতার কারণে আমাদের নিয়মিত সৈন্যরা ছিল মানসিকভাবে দুর্বল ও হীনমন্য। বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে পা দেয়া মাত্রই ভারতীয় সৈন্যরা বিজিত সম্পদের ওপর বিজয়ী বাহিনীর  মতোই হাত বসালো।  

জনাব চেয়ারম্যান ও ট্রাইব্যুনালের সদস্যবৃন্দ, আমি এখানে গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করতে চাই একজনের কথা। ভারতীয় সৈন্যদের লুট-পাটে বাধা দেওয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন এই কমান্ডিং অফিসার। তিনি মেজর এম. এ. জলিল; নয় নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক। তিনিও এই মামলায় একজন সহ-অভিযুক্ত। জলিলকে এর জন্য যথেষ্ট খেসারত দিতে হয়েছিল। দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে তাঁকে দীর্ঘদিন করা প্রাচীরের অন্তরালে কাটাতে হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ থেকে অব্যাহতি পাবার পর মেজর জলিল আরেকটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। তরুণ বিপ্লবীদের প্রতিনিধি আ.স.ম.আব্দুর রব (যিনি এ মামলায় একজন সহ-অভিযুক্ত)-এর সহযোগিতায় মেজর জলিল বাংলাদেশের প্রথম বিরোধী দল জাসদ গঠন করেন। এখানে উল্লেখ্য আ.স.ম.আব্দুর রব সেই ব্যক্তি যিনি প্রথম ঐতিহাসিক বটতলা সমাবেশে একাত্তরের দোসরা মে তারিখে আমাদের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। আমি অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে উল্লেখ করছি, মেজর জলিলকে যে ট্রাইব্যুনালে বিচার করে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল আমি ছিলাম সেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান।  

এ মামলায় অভিযুক্ত আমার ভাইদের সম্পর্কে আমি এখন দু’একটি কথা বলতে চাই। মনে হয় ইচ্ছা করে আমাদের পুরো পরিবারটাকে ধ্বংস করে দেয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খান সৌদি আরবে; সৌদি বিমান বাহিনীতে ডেপুটেশনে ছিলেন। যুদ্ধ বাঁধলে পালিয়ে এসে তিনি আমাদের সেক্টরে যোগ দেন। এখন শুনতে যে রকম লাগুক না কেন এটাতো ঠিক যে ঐ ঘাঁটিতে তখন আরো অনেক বাঙালি অফিসার ছিলেন, তারা কেউই পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দেন নি। বরং এরা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যান ও পরে তিয়াত্তর সালে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। জামালপুরের যুদ্ধে অসাধারণ কৃতিত্বের জন্য তাকে ‘বীর বিক্রম’ পদকে ভূষিত করা হয়। তিনিই প্রথম পাকিস্তানি কমান্ড হেডকোয়ার্টারে পৌঁছান ও জেনারেল নিয়াজির আত্মসমর্পণ প্রত্যক্ষ করেন। তিনি জেনারেল নিয়াজীর গাড়ীর পতাকার গর্বিত মালিক। আমার বিশ্বাস পৃথিবীতে এমন ভালো লোকের সংখ্যা খুব কম।  

আমার ভাই আনোয়ারও এই মামলায় অভিযুক্ত। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক (বর্তমানে অধ্যাপক)-সম্পাদক। যুদ্ধের সময় সে আমার সেক্টরের একজন স্টাফ অফিসার ছিল। সে এমন লোক.একজন মুক্তিযোদ্ধা কিংবা কোন শরণার্থীর প্রয়োজন হতে পারে এই ভেবে সে নিজে দ্বিতীয় কোন শার্ট পর্যন্ত ব্যবহার করতো না। আমার ভাই বাহারের কথাও উল্লেখ করতে হয়। এই সরকারের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই কিছুদিন আগে আরও তিনজন বীর যুবকের সঙ্গে তাঁকে আমরা হারিয়েছি। সে যুদ্ধ চলাকালে প্রায় দু’শ মুক্তিযোদ্ধার একটি কোম্পানি পরিচালনা করতো। নভেম্বরের মধ্যেই সে নেত্রকোনা মহকুমার (বর্তমানে জেলা) বেশীর ভাগ এলাকা মুক্ত করেছিল। অসাধারণ বীরত্বের জন্য তাকে দু’দুবার বীর প্রতীক পদকে ভূষিত করা হয়। সে-ও এদেশের এক জাতীয় বীর। আমার সর্বকনিষ্ঠ ভাই বেলাল। সেও এই সরকারের ঘৃণ্য চক্রান্তের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। তাঁকেও এই মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছে। তাঁকেও দু’বার ‘বীর প্রতীক’ পদকে ভূষিত করা হয়েছে।

আমরা ছয় ভাই ও দুই বোন স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছিলাম। যুদ্ধে অবদানের জন্য আমাকে ‘বীর উত্তম’ পদক দেয়া হয়। আমাদের মধ্যে চার জনকে তাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে সামরিক সম্মানে ভূষিত করা হয়েছিল। এসবই ইতিহাসের অংশ। স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য আমাদের গ্রাম লুণ্ঠিত হয়। আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ও তাঁর ওপর অত্যাচার করা হয়। আমি এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কাদেরের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। তাঁর পদক্ষেপে আমার বাবা ছাড়া পেয়েছিলেন।  

শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগের পর সবাই আশা করেছিল যে জাতীয় পুনর্গঠনের কাজকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেয়া হবে, শুরু হবে একটা সুষ্ঠু ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজ। আমাদের আশা ছিল একটা সমৃদ্ধ স্বনির্ভর বাংলাদেশের, যে দেশে দুর্নীতি ও মানুষে মানুষে শোষণের কোন সুযোগ থাকবে না। যেদেশে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেশরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্ক হবে আন্তরিক। এই সেনাবাহিনী হবে আমাদের উৎপাদন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই আশা এই স্বপ্ন নিয়েই আমাদের জাতি বারবার এত কঠোর সংগ্রামে নেমেছে। এই আশায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে আমাদের আদর্শ ও মূল্যবোধ। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। কেউ বুঝে ওঠার আগেই অধঃপতনের ধারা শুরু হয়ে যায়।

বাহাত্তরের এপ্রিলে পা-এ অস্ত্রোপচারের পর অন্যান্য আনুষঙ্গিক চিকিৎসা শেষে আমি দেশে ফিরে আসি। স্বদেশে ফিরেই আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুটান্ট জেনারেল পদে যোগ দেই। আমি সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনি, তখন এই কাজ  ছিল দুঃসাধ্য। এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান নিজেই জানেন কিভাবে আমি অবৈধ কাজ-কর্মের দায়ে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত ও মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর মতো আরো কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেই। অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছিল এরা অবৈধভাবে টাকা-পয়সা  ও সম্পদ কুক্ষিগত করেছেন। পরিস্থিতি তখন ছিল খুবই নাজুক। আমার বিশ্বাস ছিল অফিসারদের অবৈধ উপায়ে অর্জিত যে কোন সম্পত্তি ফেরত দিতে হবে। কেবল তখনই তারা বুক ফুলিয়ে সাহসের সঙ্গে খাঁটি সৈনিকের মতো দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে এসে দাঁড়াতে পারবে।  

আমি কখনোই এ নীতির প্রশ্নে আপোষ করিনি। কয়েক মাসের মধ্যেই আমাকে কুমিল্লায় অবস্থিত ৪৪তম ব্রিগেডের নতুন অধিনায়ক নিয়োগ করা হয়। কুমিল্লা ব্রিগেডের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর পরই আমার অধীনস্থ অফিসারদের নির্দেশ দেই মুক্তিযুদ্ধের আগে বা পরে অবৈধ উপায়ে যা কিছু অর্জিত হয়েছে তার সব ফিরিয়ে দিতে হবে। এরা আমার নির্দেশ পালন করেছিলেন। আমার হাতে ছিল একদল অফিসার যাদের ছিল একটা স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণ নীতিবোধ।  

এটাকেই আমি নেতৃত্বের স্বরূপ মনে করেছি। আমি সব সময় মানুষের ভালো দিকটা জাগিয়ে তুলতে চেয়েছি, কোন মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নেয়াকে আমি ঘৃণা করতাম ও এড়িয়ে চলতাম।  

স্বাধীনতা যুদ্ধে এবং ঢাকা ও কুমিল্লা সেনানিবাসে অর্জিত অভিজ্ঞতা আমাকে উৎপাদন-বিমুখ স্থায়ী সেনাবাহিনীকে একটা বিপ্লবী গণবাহিনীতে পরিণত করতে উদ্বুদ্ধ করে। আমার সৈনিক জীবনে লক্ষ্য করেছি, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে একটা স্থায়ী সেনাবাহিনী জাতীয় অর্থনীতির ওপর একটি বোঝা স্বরূপ। এ ধরনের সেনাবাহিনী সমাজ প্রগতির পক্ষে একটা বিরাট বাধা। জাতীয় উৎপাদনে এদের কোন অবদানই থাকে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে নিষ্ঠা, আনুগত্য ও ত্যাগের মনোভাব লক্ষ্য করেছিলাম, তাতে স্বাধীনতা উত্তরকালে একটা উৎপাদন-মুখী বিপ্লবী গণবাহিনী (আর পি এ) গঠন করা অসম্ভব বলে আমার মনে হয়নি।  আর এতে আমি সবচেয়ে বেশী উদ্বুদ্ধ হয়েছি।  

সামরিক বাহিনীর অনেকেরই এটা জানার কথা যে আমি কুমিল্লা ব্রিগেডকে একটা ‘গণবাহিনী’র মতো করে গড়ো তুলতে চেষ্টা করেছিলাম। মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সেনাদের নিয়ে একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে আমি সব সময় চেষ্টা করেছি। আমার সামরিক সংগঠন প্রক্রিয়ার মূল নীতি ছিল ‘উৎপাদন-মুখী সেনাবাহিনী’। এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের অফিসার ও সৈনিকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে উৎপাদনে অংশ নেয়। আমরা নিজেরা জমিতে হাল ধরেছি, নিজেদের খাবার উৎপাদন করে নিয়েছি। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে গ্রামের মানুষের বাড়ী গিয়েছি। এটাই ছিল স্বনির্ভর হওয়ার একমাত্র পথ। আমি যথেষ্ট আনন্দের সঙ্গে স্মরণ করছি কুমিল্লা ব্রিগেডের অফিসারদের কথা, তারা আমার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন ভালোভাবেই। এঁরা আমাদের ইউনিটকে কিছু দিনের মধ্যেই একটা উৎপাদন-মুখী শক্তিতে পরিণত করেন।  

কিন্তু বিরোধ দেখা দিল অল্প দিনের মধ্যেই। মুজিব সরকার সেনাবাহিনী গঠনের ব্যাপারটা উপেক্ষা করে কুখ্যাত আধা-সামরিক শক্তি রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলায় মন দেয়। ভারতীয় উপদেষ্টা ও অফিসারেরা এই রক্ষীবাহিনী গঠনে সরাসরি জড়িত ছিল। আমি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে আমার পূর্ণ বিরোধিতার কথা জানালাম। যুদ্ধের সময় ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত গোপন চুক্তির ব্যাপারেও আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানাই।  

সেনা সদর দপ্তরে খুঁজলেই আমার প্রতিবাদের দলিল পাওয়া যাবে। এই দুই কারণে আর তাছাড়া বর্তমান প্রচলিত উপনিবেশিক কাঠামোর সেনাবাহিনী থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসার ব্যাপারে আমার ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণে সরকারের সঙ্গেও সরকারের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। কিছু দিনের মধ্যেই লে: কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে সরকারের মত বিরোধ দেখা দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীতে থেকে সরে আসাটাই প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ালো। বাহাত্তরের নভেম্বর লে: কর্নেল জিয়াউদ্দিন ও আমি সেনাবাহিনী থেকে সরে আসলাম। আমরা দু’জন নিজেদের পথে এগিয়ে গেলাম, পছন্দমত রাজনীতি বেছে নিলাম। যখনই সম্ভব হতো আমরা পরস্পরের খোঁজ-খবর নিতাম আর ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে একে অন্যকে অবহিত করতাম।  

১৯৭৩ সালে আমি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ড্রেজার সংস্থার পরিচালকের পদে একটা চাকুরী নেই। আমি যে সময় দায়িত্ব নেই তখন এই সংস্থা ইতোমধ্যেই আমরা একে কর্মক্ষম করে তুলি। ১৯৫২ সালে সংস্থার জন্ম লগ্নের সময় থেকে আর কখনোই এর আয় অত বেশী ছিল না। সংস্থার একজন পাহারাদার থেকে শুরু করে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পর্যন্ত সবাইকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন আমি কিভাবে এই সংস্থা চালিয়েছি।  

(তাহের তাঁর বক্তব্যের এই পর্যায়ে আবার বাধা পেলে বলেন- ‘জনাব চেয়ারম্যান ও মামলার সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, আমাকে সবকিছু বলতেই হবে। তাহলে আপনারা আমাকে আরো কাছ থেকে বুঝতে পারবেন…)  

১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার কি ভূমিকা পালন করেছে তা দেশবাসী সবারই জানা। কিভাবে একের পর এক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল ও জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো গলা টিপে হত্যা করা হচ্ছিল তার এখন দলিলের বিষয়। এক কথায় বলা যায়, আমাদের লালিত সব স্বপ্ন, আদর্শ ও মূল্যবোধগুলো এক এক করে ধ্বংস করা হচ্ছিল। গণতন্ত্রের অসম্মানজনক কবর শয্যা রচিত হয়েছিল। মানুষের অধিকার মাটি চাপা পড়েছিল। আর সারা জাতির ওপর চেপে বসেছিল এক ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র।  

ফ্যাসিবাদী নির্যাতনের গর্ভে ধীরে ধীরে জন্ম নিলো ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণ প্রতিরোধ আন্দোলন। এটা খুবই দুঃখজনক ও  বেদনাদায়ক যে এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের অন্যতম প্রধান পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান শেষ পর্যন্ত একনায়কে পরিণত হয়েছিলেন। অথচ মুজিব তাঁর সংঘাতময় রাজনৈতিক জীবনে কখনো স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে আপোষ করেন নি। তিনি ছিলেন এককালে আমাদের গণতন্ত্র ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মূর্ত প্রতীক। অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও তিনিই ছিলেন একমাত্র নেতা যিনি জনগণের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন, জনগণের মধ্যে তাঁর ব্যাপক ভিত্তি ছিল। প্রতিদানে জনগণ তাঁকে তাদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। জনগণই মুজিবকে স্থান এনে দিয়েছিল, বহুগুণ করে তাঁকে নায়কের প্রতিমূর্তি দিয়েছিল। আসলে জনগণ তাদের নেতা হিসেবে মুজিবকে তাঁদের মন মতো করে গড়ে নিয়েছিল। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ‘মুজিব’ নামটি ছিল রণহুংকার। মুজিব ছিলেন জনগণের নেতা। এক কথা অস্বীকার করার অর্থ সত্যকে অস্বীকার করা। তাই চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তাঁর ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার শুধু জনগণেরই ছিল। সে মুজিব জনগণকে প্রতারিত করে একনায়ক হয়ে উঠেছিলেন তাকে জনগণের শক্তি দিয়ে মোকাবেলা করাটাই হতো সব থেকে ভালো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যে জনতা মুজিবকে নেতার আসনে বসিয়েছিল, সেই জনতাই একদিন একনায়ক মুজিবকে উৎখাত করতো। ষড়যন্ত্র আর চক্রান্ত করার অধিকার জনতা কাউকে দেয় নি।

১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট। একদল সামরিক অফিসর আর সেনাবাহিনীর একটা অংশবিশেষ শেখ মুজিবকে হত্যা করে। সেদিন সকালে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির এক অফিসার আমাকে টেলিফোন করেন। তিনি বলেন, মেজর রশীদের পক্ষ থেকে তিনি আমাকে টেলিফোন করেন। তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশ বেতার’ ভবনে যেতে বললেন। তিনি আমাকে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের খবরও দিয়েছিলেন। আমাকে জানানো হয় যে প্রয়াত রাষ্ট্রপতির একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী খন্দকার মোশতাক আহমেদ এই অফিসারদের নেতৃত্বে রয়েছেন।

আমি তখন রেডিও চালিয়ে দেই। জানতে পেলাম শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে আর খন্দকার  মোশতাক ক্ষমতা দখল করেছেন। এই খবর শুনে আমি যথেষ্ট আঘাত পাই। আমার মনে হলো এতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। এমনকি জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। এর মধ্যে আমার কাছে অনেকগুলো টেলিফোন আসতে থাকলো। সবার অনুরোধ ছিল আমি যেন ‘বাংলাদেশ বেতার’ ভবনে যাই। আমি ভাবলাম, যেয়ে দেখা উচিত পরিস্থিতি কি দাঁড়িয়েছে।

সকাল নটায় বেতার ভবনে গেলাম। মেজর রশীদ আমাকে একটা কক্ষে নিয়ে গেলেন। সেখানে আমি খন্দকার মোশতাক, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মেজর ডালিম আর মেজর জেনারেল এম. খলিলুর রহমানকে দেখতে পাই। খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আমি কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। আমি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে এই মুহূর্তে জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষা করাটাই সবচেয়ে জরুরী। মেজর রশীদ আমাকে আরেকটা কক্ষে নিয়ে গেল ও জানতে চাইল আমি মন্ত্রীসভায় যোগ দিতে উৎসাহী কিনা। আমি তাকে পরামর্শ দিলাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে অবস্থা পর্যালোচনা করে এটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে। মেজর রশীদ জোর দিয়ে বললো আমি আর লে: কর্নেল জিয়াউদ্দিন-ই এ অবস্থা সামাল দিতে সক্ষম। সে বললো অন্য কোন বাহিনী প্রধানদের ওপর কিংবা কোন রাজনীতিবিদের ওপর তার কোন আস্থা নেই। আমি তার প্রস্তাব নাকচ করে দিলাম। আমি তাকে পরামর্শ দিলাম বাকশালকে বাদ দিয়ে অন্য সব দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক শক্তিকে নিয়ে যেন একটা সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হয়।

খন্দকার মোশতাকের সামনে বিবেচনার জন্য আমি বেশ কয়েকটা প্রস্তাব রেখেছিলাম।  

(১) অবিলম্বে সংবিধান স্থগিত করণ,  

২) দেশব্যাপী সামরিক শাসন ঘোষণা ও তার প্রবর্তন,  

৩) দলমত নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দান,

৪) বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা,

৫) জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একটা জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

খন্দকার মোশতাক আমার সব কথা মন দিয়ে শুনলেন ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিলেন। রশীদ বারবার জোর দিয়ে বলতে থাকল যে আমি যেন বঙ্গভবনে খন্দকার মোশতাকের শপথ গ্রহণের সময় উপস্থিত থাকি। সকাল সাড়ে এগারোটায় আমি বেতার ভবন ত্যাগ করি গভীর উদ্বেগ নিয়ে। আমার মনে হচ্ছিল মোশতাক তার কথা রাখবেন না, বরং উল্টাপথে এগুবেন। আমার আরো মনে হচ্ছিল এটা শুধু মোশতাক আর সেই অফিসারদের দলের ব্যাপার নয়। এর পেছনে অন্য কিছু বা অন্য কারো হাত রয়েছে। তারাই আড়াল থেকে কলকাঠি নাড়ছে।

আমার ধারণাই সত্যে পরিণত হলো। জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে খন্দকার মোশতাক আমার সঙ্গে আলোচিত একটা কথাও উল্লেখ করেন নি। দুপুর বেলায় আমি যখন বঙ্গভবনে পৌঁছলাম ততক্ষণে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় আমি হত্যাকাণ্ডে জড়িত অফিসারদের সঙ্গে আলোচনায় বসি।  এদের নেতা ছিল মেজর রশীদ। সেদিন সকালে মোশতাকের কাছে আমি যে প্রস্তাবগুলো রেখেছিলাম এদের কাছেও সেগুলো পেশ করি। সুনির্দিষ্ট কোন পদক্ষেপ নেয়ার আগেই যাতে জরুরি ভিত্তিতে সব রাজবন্দীদের মুক্তি দেয়া হয় সে ব্যাপার আমি বেশ জোর দিয়েছিলাম।

আমাদের আলোচনার শেষের দিকে আলোচনায় যোগ দেয়ার জন্য জেনারেল জিয়াকে ডেকে আনলাম। আমার প্রস্তাবগুলো সবাই সমর্থন করলেন। এ ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছিলেন যে সে মুহূর্তে সেটাই ছিল একমাত্র গ্রহণযোগ্য পথ। পরদিন মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ ও মেজর জেনারেল এম. খলিলুর রহমানের সঙ্গে আমার অনেকক্ষণ আলাপ হয়। তাঁরাও আমার প্রস্তাবগুলো সঠিক ও গ্রহণীয় মনে করেন।

কিন্তু ষোলই আগস্ট আমি বুঝতে পারলাম মেজর রশিদ ও মেজর ফারুক শুধু আমার নামটাই ব্যবহার করছে, যাতে তাদের নেতৃত্বাধীন সিপাহিরা এই ধারণা পায় যে আমি তাদের সঙ্গে রয়েছি। পরদিন ১৭ আগস্ট এটা পরিઋকার হয়ে গেল যে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক। আমি আরো বুঝতে পারলাম যে এর পেছনে খন্দকার মোশতাকসহ আওয়ামী লীগের উপরের তলার একটা অংশও সরাসরি জড়িত। এই চক্র অনেক আগেই যে তাদের কর্মপন্থা ঠিক করে নিয়েছিল  সেটাও আর গোপন রইল না। সেদিন থেকেই আমি বঙ্গভবনে যাওয়া বন্ধ করে ও এই চক্রের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন করি।

জেনারেল ওসমানীকে খন্দকার মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়েছিল। তিনি আমর সঙ্গে সব সময়ই যোগাযোগ রক্ষা করতেন, তাঁর সঙ্গে প্রায়ই আমাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে হতো। তিনি সব সময় লে: কর্নেল জিয়াউদ্দিনের খোঁজ খবর জানতে চাইতেন ও তার সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করতেন। মজিব সরকার জিয়াউদ্দিনের ওপর মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছিল। আমি তাঁকে বলেছিলাম, আগে এই পরোয়ানা উঠিয়ে নিয়ে তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ থেকে তাকে অব্যাহতি দিতে হবে। তাহলেই শুধুমাত্র জিয়াউদ্দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারেন।

সেপ্টেম্বরের শেষে দিকে মেজর রশীদ রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটা  প্রস্তাব আনলেন। আমি আর লে: কর্নেল জিয়াউদ্দিন একটা রাজনৈতিক দল গঠন করবো; আনুষঙ্গিক সব খরচ বহন করবেন তিনি। আমি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি। তাকে জানিয়ে দেই যে সব রাজনৈতিক বন্দিদের অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে। এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে মোশতাকের কোন রাজনৈতিক ভিত্তি ছিল না। সেনাবাহিনীতে একটা ছোট অংশ বাদে অন্য কোথাও তার কোন সমর্থন ছিল না, সাধারণ মানুষের মধ্যেও তার সমর্থন ছিল না।

আসুন, আমরা মোশতাক সরকারের কথায় ফিরে আসি। মোশতাক সরকার জনগণকে মুজিব সরকারের চাইতে কোন ভাল বিকল্প উপহার দিতে পারে নি। পরিবর্তন হয়েছিল শুধু এই, রুশ-ভারতের প্রভাব বলয় থেকে মুক্তি হয়ে দেশ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপুটে ঝুঁকে পড়েছিল। এ ছাড়া দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ছিল আগের মতোই। সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে কোন কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। অন্যদিকে রাজনৈতিক নিপীড়ন আগের থেকেও বেড়ে গিয়েছিল। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অত্যাচারের প্রবৃত্তি যেন দিন দিন বেড়েই চলছিল। জনগণের দুর্ভোগ ও হয়রানি আগের মতোই চলতে থাকে, রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেফতার অব্যাহত থাকে। সত্যিকার অর্থে দেশ তখন একটা বেসামরিক একনায়কতন্ত্র থেকে সামরিক আমলাতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রের কবলে পড়ে গিয়েছিল।

মানুষ অস্থির হয়ে ওঠে। তারা এই অবস্থা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। রুশ-ভারতের চর। জনতার কাছে অগ্রহণযোগ্য অসামাজিক শক্তিগুলো পরিস্থিতির সুযোগ নেয়ার জন্য ওঁৎ পেতে ছিল। মোশতাক সরকারের ব্যর্থতার সুযোগ আমাদের জাতীয় স্বার্থকে বিপন্ন করার জন্য একটা ষড়যন্ত্র গড়ে ওঠে। এই চক্রান্তের নায়ক ছিলেন উচ্চাভিলাষী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। প্রতিবিপ্লবী ষড়যন্ত্রমূলক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পঁচাত্তরের তেসরা নভেম্বর খালেদ মোশাররফ ক্ষমতায় আসেন।

সেদিন আমি অসুস্থ, আমার নারায়ণগঞ্জের বাসায় বিছানায় পড়ে ছিলাম। ভোর চারটার দিকে টেলিফোন বেজে উঠল। ওপারে ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। আমার সাহায্য তার খুব দরকার। কিন্তু কথা শেষ হলো না, লাইন কেটে গেল। সেদিন বেশ কিছু সিপাহি, এন.সি.ও. ও জে.সি.ও. আমার নারায়ণগঞ্জের বাসায় এসে হাজির হন। তাদের সবার সঙ্গে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কেবল তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমার শোবার ঘরে কথা বলেছিলাম। তারা আমাকে জানালো যে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের পেছনে ভারতীয়দের হাত রয়েছে। বাকশাল ও তাদের সহযোগীরা ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্রে নেমেছে। তারা আমাকে আরো জানালো যে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য কোরের মধ্যে প্রচণ্ড উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোন মুহূর্তে গোলাগুলি শুরু হতে পারে।

আমি তাদেরকে শান্ত থাকতে ও সৈন্যদের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করে পরিস্থিতি সম্পর্কে সবার মতামত জানার জন্য পরামর্শ দেই। এ ছাড়া আমাদের জাতীয় অস্তিত্ব বিপন্নকারী যে কোন ধরনের তৎপরতার বিরুদ্ধে সজাগ থাকতে বলে দেই। আমি তাদেরকে পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিলাম, সশস্ত্র বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যের কর্তব্য হলো সীমান্ত এবং প্রজাতন্ত্রের আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষা করা। আমাদের মতো সমাজে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে নাক গলানো সশস্ত্র বাহিনীর কর্তব্য নয়। অভ্যুত্থান ও পাল্টা অভ্যুত্থানের মূলে রয়েছে উচ্চাভিলাষী অফিসারদের ক্ষমতা দখলের দ্বন্দ্ব। এসব অফিসার তাদের নিজ স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। আর তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য তারা সাধারণ সৈন্যদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। দেশ কিভাবে পরিচালিত হবে তার চূড়ান্ত রায় দেবার মালিক হচ্ছে জনসাধারণ। আমি সৈন্যদের আরো বললাম কোন অবস্থাতেই যেন তারা নিজেদের মধ্যে গোলাগুলি শুরু না করে। আমি তাদের বরং ব্যারাকে ফিরে যেতে বললাম। বললাম যে জনমানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের প্রয়োজনে যে কোন মুহূর্তে একসঙ্গে আঘাত হানাবার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। ক্ষমতা লোভী সামরিক ব্যক্তিদের উচ্চাভিলাষ গুড়িয়ে দেবার এটাই ছিল একমাত্র পথ।

তেসরা নভেম্বরের পর কি ভয়ার্ত নৈরাজ্য জনক পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এ জাতির জীবন অতিবাহিত হচ্ছিল তা সবারই জানা। কিভাবে আমাদের জাতীয় আত্মসম্মানবোধ লঙ্ঘন করা হচ্ছিল তার নিশ্চয় বিস্তারিত বিবরণের দরকার পড়ে না। এটা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে খালেদ মোশাররফের পেছনে ভারতীয়দের হাত রয়েছে। একদিকে যখন দেশের এই সার্বভৌমত্ব-সংকট অন্যদিকে ঠিক তখনই রিয়ার-অ্যাডমিরাল এম এইচ খান আর এয়ার ভাইস-মার্শাল এম জি তাওয়াব খালেদ মোশারফকে মেজর জেনারেলের ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছিলেন। সে ছিল এক করুণ দৃশ্য। এসব নীচ লোকদের আমি করুণা করি। এই কাপুরুষগুলো যখন হাঁটু গেড়ে জীবন ভিক্ষা করছিল তখন  আমাকে জাতির উদ্যম ও মনোবল সমুন্নত রাখতে কাজে নামতে হয়েছিল। আর জিয়াউর রহমান? সে তখন খালেদের হাতে বন্দি, অসহায়ভাবে ভয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছিল। তাওয়াব ও খানেরা তখন কোথায় ছিল? তারা তখন তাদের নতুন দেবতার বুট লেহনে ব্যস্ত। এই সব কাপুরুষদের এদেশের সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত রাখা আমাদের শোভা পায় না।

চৌঠা নভেম্বর বিকেলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান তার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমার কাছে খবর পাঠানো। জিয়ার অনুরোধ ছিল আমি যেন সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে আমার প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তাকে মুক্ত করি ও দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করি। আমি তাকে শান্ত থাকতো ও মনে সাহস রাখতে বলেছিলাম। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হবে ও সব ধরনের অপকর্মের অবসান ঘটানো হবে। এদিকে সেনাবাহিনীর সজাগ অফিসার ও সৈন্যরা আমাকে বিশ্বাসঘাতক খালেদ মোশাররফ চক্রকে উৎখাত করার জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা নিতে অনুরোধ করে আসছিল। এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী তাগিদ এসেছিল সিপাহীদের বিশেষ করে এন. সি.ও. আর জে. সি. ও’দের কাছ থেকেই।

সৈন্যদের মধ্যে ব্যাপক যোগাযোগ, আলোচনা ও মত বিনিময়ের পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পরিকল্পনা প্রস্তুত করা হয়। ছয় নভেম্বর আমি সৈনিকদের প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে রাখলাম। ঢাকা সেনানিবাসের সব ইউনিট প্রতিনিধিদের মাধ্যমে সবাইকে সজাগ থাকতে ও পরবর্তী নির্দেশের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে দেয়া হলো। ছয়ই নভেম্বর সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হয়। সাতই নভেম্বর ভোর রাত একটায় সিপাহি অভ্যুত্থান শুরু হবে। আমাদের সিদ্ধান্তগুলো ছিল-  

১) খালেদ মোশাররফ চক্রকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করা,

২) বন্দিদশা থেকে জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা,  

৩) একটা বিপ্লবী সামরিক কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা,  

৪) দলমত নির্বিশেষে সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি দান,  

৫) রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা প্রত্যাহার,  

৬) বাকশালকে বাদ দিয়ে একটা সর্বদলীয় গণতান্ত্রিক জাতীয় সরকার গঠন করা,  

৭) বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বারো দফা দাবি মেনে নেয়া ও তার বাস্তবায়ন করা।

সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক হয়। বেতার, টি.ভি. টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, পোস্ট অফিস, বিমানবন্দর ও অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলো প্রথম আঘাতেই দখল করা হয়। ভোর রাত্রে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়। আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের সঙ্গে আমি ভোর তিনটার দিকে সেনানিবাসে যাই। সঙ্গে ছিল ট্রাক ভর্তি সেনাদল।

জিয়াকে আমি তার নৈশ পোশাকে পেলাম। সেখানে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত সহ আরো ক’জন অফিসার ও  সৈনিক ছিল। জিয়া আমাকে আর আমার ভাইকে গভীরভাবে আলিঙ্গনাবদ্ধ করলেন। পানি ভর্তি চোখে তিনি আমাদের তার জীবন বাঁচানোর জন্য কৃতজ্ঞতা জানালেন। তার জীবন রক্ষার জন্য জাসদ যা করেছে তার জন্য জিয়া আমার প্রতি ও জাসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন আমরা যা বলবো তিনি তাই করবেন। আমরা তখন পরবর্তী করণীয় কাজ নিয়ে কিছুক্ষণ আলোচনা করি। তখন ভোর চারটা। আমরা একসঙ্গে বেতার ভবনে পৌঁছাই। পথে আমরা তাৎক্ষণিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করি।

[এই পর্যায়ে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান তাহেরকে বাধা দেন। বিচার কক্ষে বাক.বিতণ্ডা শুরু হয়ে যায়। কর্নেল তাহের বলেন- ‘আমার যা বলা দরকার, তা আপনাদের শুনতেই হবে। নয় আমি আর কোন কথা বলবো না। ফাঁসি দিন… এখনি ফাঁসি দিন… আমি ভয় পাই না। কিন্তু আমাকে বিরক্ত করবেন না। … কি যেন বলছিলাম শরীফ?’ (শরীফ চাকলাদার বিবাদী পক্ষের একজন সহকারী কৌশলী) এই বলে তাহের আবার শুরু করলেন।]

এর মধ্যে বেতার থেকে সিপাহি অভ্যুত্থানের ঘোষণা করা হয়েছে। জিয়াকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা দেয়া হয়েছে। বেতার ভবনে যাবার পথে জিয়া শহীদ মিনারে একটা জনসমাবেশে ভাষণ দিতে রাজ হয়েছিলেন। তাই কথামতো আমি সিপাহিদের নির্দেশ দিয়েছিলাম শহীদ মিনারে সমবেত হতে। সেখানে আমি ও জিয়া সমাবেশে ভাষণ দেবো। তাহলে তাদের অফিসারদের ছাড়াই যেই বিপ্লবী সৈনিকরা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছে সেই সৈনিকদের কাছে দেয়া অঙ্গীকার থেকে কেউই পিছু হটতে পারবে না।

উৎফুল্ল মনে সৈনিকরা শহরের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একসঙ্গে এদের জড়ো করতে কিছুটা সময় দরকার। শহীদ মিনারে সমাবেশের সময় তাই ঠিক করি সকাল দশটায়। হাজারো মানুষ খুশী মনে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তারা বিপ্লবী সৈনিকদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে শ্লোগান তুলেছিল। চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুল। মানুষের আনন্দ আর উল্লাসের মাঝে পুরো শহরটা যেন উৎসবের আনন্দে রঙিন হয়ে উঠেছিল।

সকাল সাড়ে আটটায় সৈনিকরা আমাকে জানালো যে খন্দকার মোশতাক আহমেদ বেতার ভবনে ঢুকে পড়েছেন ও একটা ভাষণ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমি তখন বেতার কেন্দ্রে গেলাম। মোশতাককে আমি খুব স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলাম যে চক্রান্তের রাজনীতির দিন শেষ; তাকে এখনই বেতার কেন্দ্র ছেড়ে যেতে হবে। তিনি আমার কথা মতো বেতার কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেলেন। এরপর আমি সমাবেশে ভাষণ দেয়ার জন্য  জিয়াকে নিয়ে আনতে সেনানিবাসে গেলাম। সেখানে পৌঁছে দেখি পরিস্থিতি বদলে গেছে। জিয়া দাড়ি কামিয়ে সামরিক পোশাকে সুসজ্জিত হয়ে নিয়েছেন। তাকে দেখে মনে হলো তিনি বন্দিদশার আঘাত কাটিয়ে উঠেছেন। শহীদ মিনারে যাবার কথা তুললে জিয়া সেখানে যেতে অস্বীকৃতি জানালেন। বিনয়ের সঙ্গে জিয়া যুক্তি দেখালেন যে তিনি একজন সৈনিক, তার গণ জমায়েতে বক্তৃতা দেয়া সাজে না। তিনি আমাকে শহীদ মিনারে যেয়ে সেনাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিতে বললেন। আমি বরং সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরে আসার জন্য শহীদ মিনারে নির্দেশ পাঠালাম।

এগারোটার দিকে আমরা সেনা সদর দপ্তরে একটা আলোচনায় বসি। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে আমরা নীতিগতভাবে একমত হই। সেই আলোচনায় উপস্থিত ছিলাম আমি, জিয়া, তাওয়াব, এম.এইচ.খান, খলিলুর রহমান, ওসমানী ও মুখ্য সচিব মাহবুব আলম চাষী।  সরকারের ধারাবাহিকতার প্রশ্নে একটা আইনগত সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। সবাই চাচ্ছিলেন বিচারপতি সায়েম দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন। (সায়েমকে খালেদ মোশাররফ পাঁচ নভেম্বর নিয়োগ করেছিলেন।) আমি তা মেনে নিলাম কিন্তু আমি চাচ্ছিলাম জিয়া হবেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হতে জিয়ার আপত্তির কারণে কিছুক্ষণ আলোচনার পর ঠিক হলো জিয়া, তাওয়াব আর এম.এইচ. খান প্রত্যেকেই উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হবেন। এদের ওপর কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বভার ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। ঠিক হলো বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে তিন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকদের নিয়ে একটা উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করবেন। সেদিনের আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তা হচ্ছে সব রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে।

রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনার পর রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালু করতে দেয়া হবে ও মোশতাক সরকার ঘোষিত সাধারণ নির্বাচনের নির্ধারিত সময়ের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সায়েম শুধু এক অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চালাবেন। আমি এই সভাতে সাতই নভেম্বরের বিপ্লবের অনুক্রমকে স্বীকৃতি দিতে বললাম।

বিকালের দিকে আমি বেতার কেন্দ্রে যাই। বিপ্লবী সৈন্যরা জিয়াউর রহমানের কাছে বারো দফা দাবি পেশের সিদ্ধান্ত নেয়। তারা চাচ্ছিল তাদের দাবি পেশ করার সময় আমি সেখানে উপস্থিত থাকি। বেতার কেন্দ্র থেকে আমি জিয়াউর রহমানকে টেলিফোন করি ও সৈন্যদের প্রস্তাবের কথা তাকে জানাই। তখন সৈন্যরা প্রচন্ডভাবে উত্তেজিত। বেতার কেন্দ্রের ভেতরে তারা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। পৌনে আটটার দিকে জিয়ার সঙ্গে মোশতাক ও সায়েমকে বেতার কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়।  বিপ্লবী সৈন্যদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে পেশ করা বারো দফা দাবির দলিলে জিয়ার সম্মতিসূচক স্বাক্ষরের পরই এদের বেতার কেন্দ্রে প্রবেশাধিকার দেয়া হয়।

খন্দকার মোশতাক ও বিচারপতি সায়েম জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন। আমি আর জিয়া তখন বেতার ভবনের টেলিভিশন কক্ষে, এক সঙ্গে ভাষণ শুনছি। সায়েম তার ভাষণে আমাদের আলোচনায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরলেন। এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতেই পরদিন আট নভেম্বর মেজর জলিল ও আ.স.ম. আব্দুর রবকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। সেদিন আমি জেনারেল জিয়াকে টেলিফোন করে এর জন্য ধন্যবাদ জানাই আর মতিন,অহিদুর সহ অন্যান্য বন্দিদেরও সেই সঙ্গে মুক্তি দিতে অনুরোধ করি।

আট তারিখে সন্ধ্যায় জিয়া আমাকে জানালেন যে, কয়েকটা ঘটনায় কিছু অফিসার মারা গেছেন। আমি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্য করার প্রস্তাব দেই। আমি তখনি সেনানিবাসে আসার প্রস্তাব করি। জিয়াকে আমি আরো জানাই যে বিপ্লবী সৈন্যদের ওপর আমার কড়া নির্দেশ ছিল যাতে কোন অফিসারের ওপর এভাবে আক্রমণ করা না হয়। এগার তারিখ পর্যন্ত জিয়া আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করেন। কিন্তু বার তারিখের পর তাকে আর পাওয়া যাচ্ছিল না। সব যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। তার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেই জিয়া আমাকে এড়িয়ে যেতেন।

তেইশে নভেম্বর পুলিশের একটা বড়ো দল আমার বড় ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের বাড়ী ঘেরাও করে ও তাঁকে গ্রেফতার করে পুলিশ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়। এই ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে আমি মেজর জেনারেল জিয়াকে টেলিফোন করি। অন্য প্রান্ত থেকে আমাকে জানানো  হয় মেজর জেনারেল জিয়াকে পাওয়া যাচ্ছে না। তার পরিবর্তে সেনাবাহিনীর উপ.প্রধান মেজর জেনারেল এরশাদ আমার সঙ্গে কথা বলবেন। এরশাদ আমার কথা শুনে বলেন যে আমার ভাইয়ের গ্রেফতারের ব্যাপারে সেনাবাহিনী কিছুই জানে না। ওটা হচ্ছে একটা সাধারণ পুলিশী তৎপরতা। আমি তখনও জানতাম না আমার ভাইকে যখন পুলিশ গ্রেফতার করে তখন একই সময়ে মেজর জলিল ও আ.স.ম. আব্দুর রব সহ অন্যান্য অনেক জাসদ নেতা ও কর্মীকেও গ্রেফতার করা হয়েছিল। এসব জানার পর আমার বুঝতে আর অসুবিধা হলো না যাদের আমরা সাত নভেম্বর ক্ষমতায় বসিয়েছিলাম তারা আবার এক নতুন ষড়যন্ত্রের খেলায় মেতেছে।

২৪শে নভেম্বর এক বিরাট পুলিশ বাহিনী আমাকে ঘিরে ফেলে। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার আমাকে জানালেন জিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য তাদের সঙ্গে যাওয়া দরকার। আমি অবাক হয়ে বললাম জিয়ার কাছে যাওয়ার জন্য এত পুলিশ প্রহরার কি দরকার? এরা আমাকে একটা জিপে তুলে সোজা এই জেলে নিয়ে আসে। এভাবেই যাদের প্রাণ বাঁচিয়ে আমাকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলাম সেই সব বিশ্বাসঘাতকের দল আমাকে জেলে অন্তরীণ করলো।

জিয়া শুধু আমার সঙ্গেই নয়, বিপ্লবী সেনাদের সঙ্গে, সাত নভেম্বরের পবিত্র অঙ্গীকারের সঙ্গে, এক কথায় গোটা জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তুলনায় জিয়া মুদ্রার অন্য পিঠ বলেই প্রমাণিত হয়েছে।

আমাদের জাতির ইতিহাসে আর একটাই মাত্র এরকম বিশ্বাসঘাতকতার নজীর রয়েছে, তা’ হচ্ছে মীর জাফরের। বাঙালি জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে সে গোটা উপমহাদেশকে দু’শ বছরের গোলামীর পথে ঠেলে দিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে এটা সতের শ’ সাতান্ন সাল নয়। উনিশ শ’ ছিয়াত্তর। আমাদের আছে বিপ্লবী সিপাহি জনতা, তারা জিয়াউর রহমানের মতো বিশ্বাসঘাতকদের চক্রান্তকে নির্মূল করবে।

(এই পর্যায়ে কর্নেল তাহেরকে আবার বাধা দেয়া হয়। কোর্টে বাক-বিতণ্ডার তোড়ে কাজ কর্ম বন্ধ হয়ে যায়। তাহের তখন বলেন- ‘ কোন অধিকারে আমাকে ফাঁসি দেবেন? আমাকে মুক্তি দেয়ার কিংবা সাজা দেয়ার কোন ক্ষমতাই আপনাদের নেই।’)

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে কয়েকদিন রাখার পর আমাকে হেলিকপ্টারে করে রাজশাহী জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাকে একটা নির্জন প্রকোষ্ঠে রাখা হয়। আজ পর্যন্ত আমার পরিবারের কোন সদস্য আমার সঙ্গে দেখা করারা অনুমতি পায়নি। কিন্তু জেলে থাকলেও দেশের নাড়ী আমি ঠিকই উপলব্ধি করতে পারি। দেশের জন্য এখন এক চরম সংকটের সময়। আমাদের সামনে এখন দুটো জরুরি সমস্যা। একদিকে একটা রাজনৈতিক দলের কিছু সদস্য ভারতে পালিয়ে যেয়ে সীমান্ত সশস্ত্র সংঘর্ষের অবতারণা করছে। অন্যদিকে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত গঙ্গার পানির বন্ধ করে দিয়েছে। দুটো সমস্যাই এদেশের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক বুনিয়াদের মূলে সরাসরি হুমকির নামান্তর। নির্জনে কারারুদ্ধ অবস্থায় উপর্যুপরি লাঞ্ছনার মুখেও এই হুমকির প্রতিবাদ জানাতে আমার দেরী হয়নি। ১৯৭৬ সালের দশ মে আমি রাষ্ট্রপতির কাছে একটা চিঠি পাঠাই সেই চিঠি আমি এখানে পড়ে শোনাতে চাই।

(আদালত তাহেরকে এই চিঠি পড়তে দেয় নি। ট্রাইব্যুনাল আরো জানায় যে বক্তব্য সংক্ষেপ করার আশ্বাস না দিলে তাঁকে এমনকি বক্তব্য পেশ করতেও দেয়া হবে না। এরপর বিবাদী পক্ষের প্রধান আইনজীবীদের হস্তক্ষেপের পর তাহেরকে কথা বলার অনুমতি দেয়া হয়। তাহেরের আইনজীবী আদালতে বলেন- ‘অনুগ্রহ করে তাঁকে (বক্তব্য দেয়ার) অনুমতি দিন। এ ট্রাইব্যুনালের অবশ্যই অধিকার আছে (তাঁকে) সেই সুযোগ না দেয়ার, কিন্তু তিনি প্রধান বিবাদী; যত বড়োই হোক না কেন বক্তব্য উপস্থাপন করে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তাঁকে দিতেই হবে।’)

জনাব চেয়ারম্যান ও মামলার সম্মানিত সদস্যবৃন্দ। রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা চিঠিতে আমার ইচ্ছার প্রকাশ হয়েছে। এ ইচ্ছা নিজ দেশকে বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একজন সাধারণ নাগরিকের দৃঢ় সংকল্পের দলিল। আমি একজন মুক্ত মানুষ। নিজের যোগ্যতা দিয়ে আমি এই স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই জেলের উঁচু দেয়াল, এই নির্জন কারাবাস, এই হাতকড়া কিছুই সেই স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারে না।

বাইশে মে আমাকে রাজশাহী থেকে হেলিকপ্টারে করে এই জেলে আনা হয় এবং সরাসরি একটা নির্জন সেলে আটকে রাখা হয়। গোটা জেলখানাই যেন ছিল এক রহস্য ঘেরা নীরবতায় ভরা। এখানে আসার পর থেকেই আমাকে আর অন্যান্যদের বিচার করার কথা শুনতে পাচ্ছিলাম; জেলের ভেতরে এক বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার হবে। ইতোমধ্যেই নাকি বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল আইনও জারি করা হয়েছে। পনের জুন ট্রাইব্যুনালের বর্তমান চেয়ারম্যান আমার সঙ্গে জেলের ভেতরে দেখা করেন। আমি ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হতে অস্বীকৃতি জানাই। জেলের ভেতর সামরিক ট্রাইব্যুনাল বিচারের নামে সরকারী প্রহসন ছাড়া আর কি হতে পারে। একুশে জুন চারজন আইনজীবী আমার সঙ্গে জেলের ভেতরে দেখা করেন। তাঁরা আমাকে আশ্বাস দেন যে ন্যায় বিচার করা হবে; সরকারী কোন রকম হস্তক্ষেপ ছাড়াই ট্রাইব্যুনাল তার কাজ করবে। শুধু মাত্র এই আশ্বাসের পরই আমি আদালতের সামনে হাজির হতে রাজি হই।

এখানে আমি একটা কথা বলতে চাই। যেই অধ্যাদেশের আওতায় এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে তার সম্পূর্ণ অবৈধ। এই অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল উনিশ শ’ ছিয়াত্তরের পনের জুন। অথচ পনের জুন ট্রাইব্যুনাল কারাগার পরিদর্শন করে। তাহলে ট্রাইব্যুনাল নিশ্চয় আরো আগে গঠিত হয়েছে। নাহলে পনের তারিখে কাজ করে কিভাবে? এছাড়া জেলের ভেতরে আদালত গঠনের জন্য তো সেই জুনের বারো তারিখ থেকেই প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছিল।

আর এই তো আমি। আমাকে আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ দেয়া হয়নি। এমনকি চার্জশীট দেখার কোন সুযোগও আমার হয় নি। আমার পরিবারের কাউকে আমার সঙ্গে দেখা করতে পর্যন্ত দেয় নি। আর যেভাবে এ বিচার অনুষ্ঠিত হয়েছে তার সম্পর্কে যতো কম বলা যায় ততই ভাল। পুরো ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষ সন্তন্ত্র ভঙ্গিতে তাড়াহুড়া করে করেছে যে তা জানলে যে কেউ অবাক হবেন।

আমার এবং কিছু বেসামরিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে যে ১৯৭৪ সালের জুলাই থেকে আমরা আইনসিদ্ধ বৈধ সরকারকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করছিলাম। আমি সশস্ত্র বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা ও বিরোধ সৃষ্টি করেছি বলেও অভিযোগ আনা হয়েছে। উনিশ শ’ পঁচাত্তর এর সাতই নভেম্বর একটা সরকারকে উৎখাত করেছি বলে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে আমি একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক নই। জনাব চেয়ারম্যান ও ট্রাইব্যুনালের সদস্যবৃন্দ, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলোর সত্যতা কতটুকু রয়েছে সে সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে চাই না। অভিযোগগুলো এতই মিথ্যা বানোয়াট যে, সে সম্পর্কে কিছু বলার কোন ইচ্ছই আমার নেই। যারা আওয়ামী লীগ সবকারের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন তাদের স্পষ্ট মনে আছে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগে দেশের কি অবস্থা হয়েছিল। গণ নিপীড়ন, আমলাতান্ত্রিক অর্থনীতি, অরাজকতা আর গণতান্ত্রিক ও মানবিক অধিকার লঙ্ঘন ছিল প্রতিদিনকার ঘটনা। আইন শৃঙ্খলার কোন বালাই ছিল না। এরকম প্রতিকুল রাজনৈতিক পরিবেশে জাসদ ও অন্যান্য গণসংগঠন গুলো একটা ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল। দেশপ্রেমের নায়ক.রাজারা তখন কোথায় ছিলেন? কোথায় ছিল জিয়াউর রহমান? কোথায় ছিল মোশাররফ খান আর এম.জি. তাওয়াব? কি করছিল তারা?

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি বৈধভাবে ক্ষমতা লাভকারী সরকারকে উৎখাত করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছি। কিন্তু মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করেছিল কারা? কারা সেই সরকারকে উৎখাত করেছিল? মুজিবের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে কে ক্ষমতায় এসেছিল? মুজিবের পতনের পর সেনাবাহিনী প্রধান কে হয়েছিল? এখানে অভিযুক্তদের কেউ কি এসব ঘটিয়েছিল? নাকি এখানে উপবিষ্ট আপনারা এবং তারা- যাদের আজ্ঞা আপনি পালন করে যাচ্ছেন, তারাই কি মুজিব হত্যার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে বেশি লাভবান হন নি?

সেনাবাহিনীতে বিরোধ এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়েছে আমার বিরুদ্ধে। কিন্তু পনেরই আগস্ট এবং তেসরা নভেম্বর সেনাবাহিনীতে কি ঘটেছিল? তারা কোন মেজররা যারা সিনিয়র অফিসারদের হুকুম দিয়ে বেড়াতো? তিন নভেম্বরের পর কারা সেনাবাহিনীর কমান্ডের সমস্ত নিয়ম কানুনকে ভেঙ্গে দিয়েছিল? বন্দি জিয়া কার কাছে প্রাণ রক্ষার জন্য খবর পাঠিয়েছিল? হ্যাঁ, অবশ্যই আমার নির্দেশে এক সিপাহি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াকে মুক্ত করা হয়। আমাদের প্রধান কর্তব্য ছিল জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও সংহত করা। এর জন্য সৈনিকদের সংগঠিত করে তাদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করে তুলতে হয়েছিল। আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, আমি এই কাজে সফল হয়েছিলাম। এই জাতি ও সশস্ত্র বাহিনীকে আমরা এক মহাদুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছি।

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আমি একটা বৈধ সরকারকে উৎখাত করেছি। হ্যাঁ, এটা সত্য। সাতই নভেম্বরের আগে কে ক্ষমতায় এসেছিল? খালেদ মোশাররফ কাদের প্রতিনিধিত্ব করছিল? কে জিয়াকে গ্রেফতার করেছিল? ভয়ার্ত জনতা কার উৎখাত কামনা করেছিল? জাতীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে ও জাতিকে একটা নতুন পথের দিশা দিতে আমরা বিপ্লবী সিপাহি জনতার সঙ্গে মিলে বিশ্বাসঘাতক খালেদ মোশাররফ চক্রকে উৎখাত করেছিলাম। আমি একজন অনুগত নাগরিক নই বলে অভিযোগ করা হয়েছে। একজন মানুষ যে তার রক্ত ঝরিয়েছে, নিজের দেহের একটা অঙ্গ পর্যন্ত হারিয়েছে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তার কাছ থেকে আর কি আনুগত্য তোমরা চাও? আর কোনভাবে এদেশের প্রতি আমার আনুগত্য প্রকাশ করব? আমাদের সীমান্তকে মুক্ত রাখতে, সশস্ত্র বাহিনীর স্থান আর জাতীয় মর্যাদা সমুন্নত রাখবার ইচ্ছায় ঐতিহাসিক সিপাহি অভ্যুত্থান পরিচালনা করতে যে পঙ্গু লোকটি নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছিল তার কাছ থেকে আর কি বিশেষ আনুগত্য তোমাদের পাওনা?

এ জন্যই আমি ট্রাইব্যুনালকে অনুরোধ করেছিলাম মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়ার.অ্যাডমিরাল এম.এইচ. খান, এয়ার ভাইস.মার্শাল এম. জি. তাওয়াব, জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানী ও বিচারপতি এ.এস.এম. সায়েমকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করার জন্য। তারা যদি এখানে আসতেন, ট্রাইব্যুনালের যদি ক্ষমতা থাকতো এখানে আনার তাহলে আমি নিশ্চিন্ত যে তারা এমন মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগের সামনে দাঁড়াতে সাহস পেত না। কিন্তু এই ট্রাইব্যুনাল  তার দায়িত্ব পালন করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। দেশ ও জাতির মঙ্গলের লক্ষ্যে পরিচালিত নয় যে আইন সে আইন কোন আইন-ই নয়। ছিয়াত্তরে পনের জুন যে অধ্যাদেশের জারি হয়েছে তা একটা কালো আইন। শুধু মাত্র সরকারের খেয়াল-খুশীর প্রয়োজন মেটাতেই এই অধ্যাদেশ জারিকৃত হয়েছে। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি অধ্যাদেশ। এই ট্রাইব্যুনালের তাই আমাকে বিচার করার কোন আইন সমস্ত বা নীতিগত ভিত্তি নেই।

একুশে জুনের পর থেকে এই বিচার শুরু হওয়ার দিন পর্যন্ত যে সব ঘটনা ঘটেছে আমি এখন সেগুলো বলতে চাই।

(তাহেরকে তাঁর বক্তব্যের এই অংশ রাখতে দেয়া হয়নি। তাহের বলেন, তিনি কখনোই এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মতো এমন নীচ চরিত্রের লোক দেখে নি।

সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত একনিষ্ঠ অধ্যবসায়ের মাধ্যমে মানব সভ্যতা ভালো যা কিছু অর্জন করেছে এই ট্রাইব্যুনালের কীর্তিকলাপ তার সব মলিন করে দিয়েছে।)

শেষ করার আগে বলতে চাই ছয় ও সাতই নভেম্বরের মাঝের রাত্রিতে ও  সাত তারিখ দিনে যা হয়েছে তার সবই আমি বিস্তারিতভাবে বলেছি। এখন হয়তো ট্রাইব্যুনাল বুঝতে পারবেন কেন আমি সায়েম, জিয়া, এম.এইচ. খান, তাওয়াব আর ওসমানীকে সাক্ষী হিসেবে হাজির করতে বলেছিলাম। তারা এখানে এসে বলুন আমি যা বলেছি তার কোথাও একবর্ণ মিথ্যা আছে কিনা।

আমার সঙ্গে এ মামলায় অভিযুক্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের সম্বন্ধে আমার কিছু বলবার আছে। তাদের প্রতি আমার একটা দায়িত্ব রয়েছে। যদি তারা কোন অপরাধ করে থাকে তাহলে  এদের বিচার করা উচিত ছিল সশস্ত্র বাহিনীর আইন অনুযায়ী এবং সার্ভিস রুলসের আওতায়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শুরুর দিকে আমি তার একজন অন্যতম উচ্চপদস্থ অফিসার ছিলাম। বড়ো দুঃখ হয়। এই সামরিক জান্তা আর তাদের জঘন্য উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে যেয়ে এভাবে সেনাবাহিনী পঙ্গু হয়ে যাবে। এইসব যুবকেরা সত্যিকারের বীর। তাঁদের নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।

সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই জাতি মরতে পারে না। বাংলাদেশ বীরের জাতি। সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থান থেকে তাঁরা যেই শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা পেয়েছে তা ভবিষ্যতে তাঁদের সব কাজে পথ দেখাবে। জাতি আজ এক অদম্য প্রেরণায় উদ্ভাসিত। যা করে থাকি না কেন তার জন্য আমি গর্বিত। আমি ভীত নই। জনাব চেয়ারম্যান, শেষে শুধু বলবো, আমি আমার দেশ ও জাতিকে ভালবাসি। এ জাতির প্রাণে আমি মিশে রয়েছি। কার সাহস আছে আমাদের আলাদা করবে। নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোন বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিতে যাই।

বিপ্লব দীর্ঘজীবী হউক!

দীর্ঘজীবী হউক স্বদেশ!

তথ্যসূত্র : col-taher.com