হাসান মাহমুদ, বিশেষ প্রতিনিধি ॥ বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের (বিসিসি) নির্বাচনের তিন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে ১৪ দল সমর্থিত সম্মিলিত নাগরিক কমিটির মেয়র প্রার্থী ও সদ্য বিদায়ী মেয়র আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণ এবং ১৮ দল সমর্থিত জাতীয়তাবাদী নাগরিক পরিষদের মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামালের সমর্থনে উভয় জোটের কেন্দ্রীয় নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের শেষ সময়ের প্রচার-প্রচারনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে নির্বাচনী মাঠ। অপর স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মাহমুদুল হক খান মামুন ও তার সমর্থকেরা প্রচার প্রচারনায় অনেকটাই চাঁপের মধ্যে রয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন।
এখানে মূল প্রতিদ্বন্ধীতা হবে হিরণ ও কামালের মধ্যে। এরা দু’জনই এখানকার সাবেক মেয়র। কার সময়ে এখানে কতোটা উন্নয়ন হয়েছে তাতেই বিশ্বাসী রাজনৈতিক সচেতন বলেখ্যাত বরিশাল নগরবাসী। এখানে বিএনপির ভোট ব্যাংক বলেখ্যাত হলেও এবার স্থানীয় নির্বাচনে তার কোন প্রভাব পরছেনা। ফলে প্রতিশ্র“তির ফুল ঝুঁড়িতে মন গলছেনা সাধারন ভোটারদের। দু’সাবেক মেয়রের কার সময়ে কতটুকু উন্নয়ন হয়েছে অতীতের সেই হিসেব-নিকেশ করেই ভোটাররা আগামি ১৫ জুন তাদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন বলে জানিয়েছেন। ইতোমধ্যে মেয়র প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হলে এটা করবেন, কি ওটা করবেনসহ স্থানীয় নির্বাচনে জাতীয় ইস্যু টেনে এনে ভোটারদের প্রভাবিত করে আগামীর নগরী নিয়ে ভোটারদের কাছে প্রতিশ্র“তির ফুল ঝুঁড়ি ছিটানো শুরু করেছেন। তার পরেও কোন কিছুতেই সাধারন ভোটারদের মনগলাতে পারছেন না শুধু নির্বাচনের সময় ভোটারদের কাছে ছুটে আসা ঢাকার ব্যবসায়ী ওইসব প্রার্থীরা।
সূত্রমতে, বরিশাল মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডে ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে আধুনিক শহর প্রতিষ্ঠার একমাত্র দাবিদার আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণের টেলিভিশন মার্কার সমর্থনে এখানে ব্যাপক গণসংযোগ করেছেন ১৪ দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দরা। গত ১১ জুন বিকেলে হিরন তার ২৩ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ষোষণা করেছেন। এতে বরিশাল শহরের যানজট নিরসনের জন্য নগরীর শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন সড়কে উড়াল সেতু (ফ্লাইওভার) নির্মানসহ নদী বেষ্টিত বরিশালের সাথে সারাদেশের রেল যোগাযোগ নিশ্চিত ও ভোলার গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে বরিশাল শহরে এনে গৃহস্থলির কাজে সরবরাহ, বেকার সমস্যা সমাধানে শিল্প কারখানা ইপিজেট নির্মান, নাগরিকদের সেবা, স্বাস্থ্য, চিত্তবিনোদন, সকল ধর্ম ও রাজনীতি অতীতের ন্যায় সহঅবস্থান, নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা মার্কেট নির্মান, শিশু হাসপাতাল স্থাপন, বিএম কলেজ ক্যাম্পাস ও বিবির পুকুর পাড়ের পাবলিক স্কয়ারে ওয়াইফাই জন নির্মান, কীর্তনখোলা নদীর তীরে রিং রোড নির্মান, জলবদ্ধতা নিরসনে নগরীর ড্রেনগুলোকে নিয়মিত পরিস্কার করা, বর্ধিত এলাকাগুলোকে শহরের মতো গড়ে তোলা, নগরীকে নিরক্ষতামুক্ত করা, সকল ক্ষেত্রে নগরবাসীর কাছে মেয়রের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করনসহ নগরীর সৌন্দর্য আরো বৃদ্ধি করে বরিশালকে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে একমাত্র সৃজনশীল শহর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পাশাপাশি সন্ত্রাস-চাঁদাবাজ নিমূর্লে গণআন্দোলন গড়ে তোলা, মসজিদ, মাদ্রাসাসহ সকল ধর্মীয় উপসানালয়গুলোর উন্নয়নে অতীতের ন্যায় বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করেছেন। হিরণের গত ৪ বছর ৭ মাস ৩ দিনের মেয়র থাকাকালীন সময়ে এ নগরীতে ৪’শ কোটি টাকার উন্নয়নের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে তিনি (হিরণ) মেয়র নির্বাচিত হতে পারলে তার এ ভবিষ্যত পরিকল্পনাকে তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে সাধারন ভোটাররা মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও হিরণের এ নির্বাচনী ইশতেহারের কথা সাধারন ভোটারদের মাঝে ছড়িয়ে পরলে পুরো নগরী জুরে হিরণের টেলিভিশন মার্কার পক্ষে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে।
অপরদিকে বরিশালকে একটি আধুনিক শিল্প নগরী গড়ে তোলাসহ ২২ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছেন ১৮ দল সমর্থিত আনারস মার্কার মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল। গত ৯ জুন তিনি নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হলে এক মতবিনিময় সভায় তিনি ইশতেহার ঘোষণা করেন। এ সময় কামাল বলেন, আগামি নির্বাচনে আমি বিজয়ী হলে বরিশালের খালগুলো পুনরায় খনন করে শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন করবো। এছাড়া নগরীর বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানে বিশেষ প্রকল্প গ্রহন করা হবে। কামালের এ নির্বাচনী ইশতেহারের তীব্র বিরোধীতা করে নগরীর আমানতগঞ্জ এলাকার রিসকা চালক আব্দুর রহিম, ইসমাইল হোসেন, রসুলপুর এলাকার আব্দুল কাইউম, শাহিনুল ইসলামসহ অনেকেই বলেন, কামাল গরীবদের পেটে লাথি মারার মেয়র। কারণ হিসেবে তারা বলেন, তৎকালীন সময়ে আহসান হাবিব কামাল মেয়র থাকাকালীন সময়ে রিকসা আটক অভিযানের নামে প্রায় চার হাজার রিকসা কীর্তনখোলা নদীতে ফেলে দিয়েছিলেন। সেজন্য গত নির্বাচনের ন্যায় এবারও তাকে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে নারাজ ওইসব খেটে খাওয়া দিনমজুরেরা। এছাড়াও সম্প্রতি সময়ে সদ্যপদত্যাগ করা বরিশাল জেলা (দক্ষিণ) সভাপতি আহসান হাবিব কামাল ও মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার-এমপি’র আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্ধে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এবং একই দ্বন্ধে সরকারি বরিশাল কলেজ ছাত্রদলের আহবায়ক রাফসান আহমেদ জিতু নিহত, দীর্ঘ এক বছরের অধিক সময় ধরে ২০নং ওয়ার্ড ছাত্রদলের সভাপতি ফিরোজ খান কালু ও ছাত্রদল নেতা মিরাজ হোসেনের রহস্যজনক নিখোঁজের বিষয়টিও মেনে নিতে পারেননি খোঁদ ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। তার পরেও দিনরাত সমানতালে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে জাতীয় ইস্যু ভোটারদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন আনারস মার্কার প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল।
অন্যদিকে শওকত হোসেন হিরণ ও আহসান হাবিব কামালের প্রচারণা তুঙ্গে উঠলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী মাহমুদুল হক খান মামুন তার দোয়াত কলম মার্কার প্রচারণার ক্ষেত্রে চাঁপের মুখে রয়েছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন। মামুন অভিযোগ করে বলেন, তার বাসার সামনে সার্বক্ষণিক আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সাদাপোষাকে অবস্থান করছে। ইতোমধ্যে তার ১৫ জন কর্মী-সমর্থককে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। গত ১১ জুন বরিশাল প্রেসক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে মেয়র প্রার্থী মাহমুদুল হক খান মামুন তার ১৯ দফার নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন। তিনি সকল অবিচার, অন্যায়, উশৃংখলা, বেহায়াপনা, শিক্ষক নির্যাতন, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ধ্বংসকরণ, লুটপাট, জমি দখল ইত্যাদির বিরুদ্ধে সজাগ থেকে ১৪ ও ১৮ দলের যাঁতাকল থেকে রেহাই পেতে নগরবাসীর কাছে ভোট প্রার্থণা করেন।
রিটার্নিং অফিস সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল পৌরসভা থেকে ২০০২ সনের ২৫ জুলাই সিটি কর্পোরেশনে উন্নীত হওয়ায় এ সিটিতে এবার মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজার ৫৩০ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লক্ষ ৭ হাজার ১৮৪জন এবং মহিলা ভোটার ১ লক্ষ ৩ হাজার ৩৪৬ জন। গত বারের তুলনায় এবার নতুন প্রজন্মের ভোটার বেড়েছে ১৮ হাজার ৩০৩ জন। ৩০টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এ সিটিতে ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ১’শ টি, স্থায়ী ভোট কক্ষ ৬১৪ টি এবং অস্থায়ী ভোটকক্ষের সংখ্যা ৩৭টি। গত নির্বাচনে শওকত হোসেন হিরণ ৪৬ হাজার ৭৯৬ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী এস. সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ২০৮ ভোট। আহসান হাবিব কামাল পেয়েছিলেন ২৬ হাজার ৪১৬ ভোট।