বরিশালের উন্নয়ন-বনাম ভোট ব্যাংক ॥ ভোটের সমিকরণ নিয়ে জটিলতা

হাসান মাহমুদ, বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আজ শনিবার সকাল থেকে শুরু হয়েছে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ রাতের মধ্যেই জানা যাবে কে হচ্ছেন আগামী পাঁচ বছরের জন্য বরিশাল সিটির নির্বাচিত তৃতীয় নগর পিতা। এ নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে এখন দু’জোটের জন্য প্রেষ্টিস ইস্যু হয়ে দাঁড়ালেও এখানকার সাধারন ভোটারদের কাছে দলের পরিচয়ের চেয়ে প্রার্থীদের ব্যক্তি ইমেজ ও নগরীর উন্নয়নই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। ফলে এখানে হিরণের উন্নয়ন ও কামালের ভোট ব্যাংক নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। যে কারনে ঘুরে ফিরে ভোটের সমিকরণ নিয়ে দেখা দিয়েছে তীব্র জটিলতা।
নির্বাচন নিয়ে বিশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, বরিশালের আওয়ামীলীগ নেতা-কর্মীদের কাছে রাজনৈতিক অভিভাবকখ্যাত বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে, জেলা আ’লীগের সভাপতি আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ও বরিশাল সদর আসনের বিএনপি দলীয় এমপি মজিবর রহমান সরোয়ারের জন্য এ নির্বাচনে নিজ নিজ দলের প্রার্থীদের জয়ের ব্যাপারে অগ্নিপরীক্ষার লড়াই। কারন হিসেবে জানা গেছে, এখানে যে দলের মেয়র প্রার্থী বিজয়ী হবেন আগামী সংসদ নির্বাচনে সে দলের প্রার্থীর জয়ের পথ অনেকটাই সুগম হবে। এখানে মেয়র পদে ১৪ দল সমর্থিত সম্মিলিত নাগরিক কমিটির মেয়র প্রার্থী ও সদস্য বিদায়ী মেয়র আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণ-টেলিভিশন, ১৮ দল সমর্থিত জাতীয়তাবাদী নাগরিক পরিষদের মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল-আনারস ও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে যুবলীগের বহিস্কৃত নেতা মাহমুদুল হক খান মামুন-দোয়াত কলম প্রতীক নিয়ে নির্বাচনী মাঠে ভোটের লড়াই করছেন।
ভোটের রাজনীতিতে বরিশাল বিএনপির দূর্গবলেখ্যাত হওয়া সত্বেও মেয়র থাকাকালীন সময়ে শওকত হোসেন হিরণ নগরীর ব্যাপক উন্নয়ণ ও সাধারন ভোটারদের দোড় গোড়ায় পৌঁছে যাওয়ায় তিনি অনেকটাই ভোটারদের মন জয় করে নিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে এ নির্বাচনে আ’লীগের এককপ্রার্থী হলে খুব সহজেই জয়ের আশা করা যেতো। এ অবস্থায় অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন ১৮ দলের মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ সহ মহাজোটের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা হিরণের ব্যাপক উন্নয়নকে সামনে রেখেই হিরণের টেলিভিশন মার্কার সমর্থনে ভোটারদের সাথে গণসংযোগ করেছেন। আর প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী আহসান হাবিব কামালের অনুজ্জল ভাবমূর্তিকে ঘষেমেজে প্রচারণা চালিয়েছেন বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য ও আনারস মার্কার প্রধান নির্বাচনী সমন্বয়ক এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার।
হিরণ-কামালের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে হিরণ ও কামালের মধ্যে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। প্রচার প্রচারণায় মহাজোট সমর্থিত সম্মিলিত নাগরিক কমিটির প্রার্থী সদ্যবিদায়ী মেয়র ও মহানগর আ’লীগের সভাপতি আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরন এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে ছিলেন না ১৮ দল সমর্থিত জাতীয়তাবাদী নাগরিক পরিষদের প্রার্থী সাবেক মেয়র আহসান হাবিব কামালও। বরং ভোটের হিসেবে কামাল খানিকটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন বলে দাবি করছেন তার সমর্থকেরা। প্রচার-প্রচরনা বন্ধ হওয়ার পর সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো বিশেষ করে ফেসবুকে হিরণের জন্য ভোট চাচ্ছেন তার সমর্থকেরা। ভোটারদের মোবাইল ফোনে ম্যাসেজও পাঠানো হয়েছে হিরণের প্রতীক টেলিভিশন মার্কায় ভোট দেয়ার জন্য। প্রতিদ্বন্ধী প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল প্রচারণায় হিরণের সঙ্গে পিছিয়ে থাকলেও জনসমর্থনের বিবেচনায় তিনি হিরণের সাথে সমানে পাল্লা দিচ্ছেন। সচেতন ভোটাররা মনে করছেন, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলেও বাস্তবে পুরো নির্বাচনটি রাজনৈতিক নির্বাচনে রূপ নিয়েছে। এখানে লড়াই হচ্ছে দুই দলের। তাই ভোটও হবে দলীয় বিবেচনায়। কামাল সমর্থকদের দাবি, বরিশাল বিএনপি অধ্যুষিত এলাকা। সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হবেন। হিরণ সমর্থকের দাবি, গত নির্বাচনের ফলাফল থেকেই আ’লীগ-বিএনপির ভোটের হিসেব স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাছাড়া মেয়র থাকাকালীন হিরণ নগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। নির্বাচনে সাধারন ভোটাররা তার প্রতিদান হিরণকে দেবেনই। তারা আরো বলেন, দলীয় পরিচয়ে, নাকি নগরীর উন্নয়নে মেয়র নির্বাচিত করবেন সেটা আজ বরিশালের ভোটারদের সামনে কঠিন পরীক্ষা।
স্তব্ধ বরিশাল, অপেক্ষায় নগরবাসী
প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর থেকেই আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণায় মাঠে নেমেছিলেন বরিশালের মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা। এরমধ্যে মেয়র পদে তিনজন, সংরক্ষিত ১০টি আসনে ৪৫ জন ও ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১১৫ জন প্রার্থী দিন-রাত সমান তালে তাদের নির্বাচনী প্রচারনা চালিয়েছেন। বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় প্রচার-প্রচারণা শেষ হওয়ার পর থেকে স্তব্ধ হয়ে যায় সমগ্র বরিশাল মহানগরী। আজ শনিবার ভোটাররা যোগ্যপ্রার্থীকে তাদের মূল্যবান ভোটাধিকার প্রয়োগ করে আগামীর নগর পিতা ও স্ব-স্ব ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত করবেন, এ অপেক্ষায় রয়েছে পুরো নগরবাসী। সবমিলে জয়-পরাজয়ের ফলাফল পেতে ভোট গণনা পর্যন্ত নিরব অপেক্ষায় থাকতে হবে প্রার্থী ও তাদের কর্মী-সমর্থকদের।
পিস্তল-শুটারগানসহ দু’জন গ্রেফতার
বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের দায়িত্বরত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর একটি টহল দল বৃহস্পতিবার রাতে পিস্তল, ওয়ান শুটারগান ও চার রাউন্ড গুলিসহ ছাত্রদল ও যুবদলের দু’জনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হলো, নগরীর পশ্চিম কাউনিয়া হাজেরা খাতুন সড়কের বাসিন্দা মতিউর রহমানের পুত্র যুবদল নেতা বাবুল শিকদার বাবলা ও নগরীর মুসলিম গোরস্থান রোড করিম কুঠির এলাকার আব্দুল মজিদ হাওলাদারের পুত্র ছাত্রদল নেতা আল-আমিন। র্যাব সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন উপলক্ষ্যে নাশকতার প্রস্তুতি নেয়ার সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে নগরীর ১নং ওয়ার্ডের বসিক পুল (নতুন বাজার) এলাকা থেকে বাবলাকে একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলি ও একটি ম্যাগজিনসহ এবং নগরীর কোতোয়ালী থানার নবগ্রাম রোড থেকে একটি ওয়ান শুটারগানসহ আল-আমিনকে গ্রেফতার করা হয়। এদিকে অস্ত্র উদ্ধারের পর নগরীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়েছে।
প্রার্থীর লোকদের হাতে ইসির সাংবাদিক কার্ড
নির্বাচনের দিন দায়িত্বপালনের জন্য আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস থেকে কর্মরত সাংবাদিকদের দেয়া পর্যবেক্ষণ কার্ড এখন প্রার্থীদের সমর্থকদের হাতে। যারা এতোদিন বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ ও প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন তারা আজ নির্বাচনের দিন সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষণ কার্ড নিয়ে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্র ঘুরে বেড়াবেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীতে প্রায় অর্ধশতাধিক ‘সাংবাদিক কার্ড’ এখন প্রার্থীদের দলীয় লোকদের হাতে। এছাড়াও নামসর্বস্ত্র দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাছাড়াও অনলাইনের নাম ব্যবহার করে সুযোগ সন্ধানীরাও পেয়েছে নির্বাচন কমিশনের সাংবাদিক কার্ড। একটি সূত্রে জানা গেছে, আজ নির্বাচনের দিন সাংবাদিক পরিচয়ে প্রভাব, দলীয় আধিপত্য বিস্তার ও নির্বাচনী এলাকায় বিনা বাঁধায় বিচরণ করতেই প্রতারনার মাধ্যমে এমনটি করা হয়েছে। ফলে চরম বিরক্তিকর অবস্থায় পরতে হচ্ছে প্রকৃত সংবাদকর্মীদের।
বস্তাভর্তি টাকা বিলির অভিযোগ
নগরের বিভিন্ন বস্তি, গুচ্ছগ্রামসহ নানাস্থানে বস্তাভর্তি টাকা বিলি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল। গতকাল শুক্রবার দুপুরে টাউন হলস্থ বিএনপির দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিদ্বন্ধী মেয়র প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করেন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক এবায়দুল হক চাঁন। সংবাদ সম্মেলনে চাঁন বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে বিভিন্ন গুচ্ছগ্রামে টাকা দেয়া হচ্ছে, বস্তিতে বস্তাভর্তি করে টাকা নিয়ে যাচ্ছে প্রার্থী হিরণের লোকেরা। চাঁন আরো বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আজ শনিবার ভোটযুদ্ধ নয়; তাদের প্রার্থীর ভোট বিপ্লব হবে। সাংবাদিক সম্মেলনে মেয়র প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল, যুবদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাবেক এমপি বিলকিস জাহান শিরিন, উত্তর জেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান, মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট কামরুল আহসান শাহীন, আব্দুর রহমান তপন উপস্থিত ছিলেন।