বরিশালে আ’লীগের ভোট বেড়েছে ॥ কমেছে বিএনপির

হাসান মাহমুদ, বিশেষ প্রতিনিধি, বরিশাল থেকে ফিরে ॥  বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ২০০৮ সনের দ্বিতীয় নির্বাচনের চেয়ে এবার তৃতীয় নির্বাচনে এখানে আওয়ামীলীগের প্রায় ২০ হাজার ভোট বেড়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপির ভোটব্যাংক বলেখ্যাত বরিশালে এবার বিএনপির ভোট কমেছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক মেয়র আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণের ব্যাপক উন্নয়ন ও জনপ্রিয়তার কারনেই ২০ হাজার সাধারন ভোটার এবার তাকে ভোট দিয়েছেন। তবে মুখে এ নির্বাচনকে স্থানীয় নির্বাচন বলা হলেও পুরো নির্বাচনটিতে রাজনৈতিক প্রভাব ফেলার কারনে দলীয় ভোটাররা ব্যক্তির চেয়ে দলকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। যে কারনেই ব্যাপক উন্নয়ন করা সত্বেও একমাত্র দলীয় বিবেচনায় বিশেষ করে বর্তমান সরকারের  নেতিবাচক ইমেজ, পদ্মাসেতু দুর্নীতি, হেফাজতে ইসলাম ইস্যু, হলমার্ক, শেয়ারবাজার ও দলীয় তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীদের অবমূল্যায়ন করার কারনেই হিরণকে পরাজিত হতে হয়েছে।

সূত্রমতে, ২০০৮ সনের সিটি কর্পোরেশনের দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সমর্থিত একক মেয়র প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ ৪৬ হাজার ৭৯৬ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী বিএনপির একাংশ থেকে শিল্পপতি এস. সরফুদ্দিন আহমেদ সান্টু পেয়েছিলেন ৪৬ হাজার ২০৮ ভোট। বর্তমান নির্বাচিত মেয়র আহসান হাবিব কামাল ওই নির্বাচনে পেয়েছিলেন ২৬ হাজার ৪১৬ ভোট এবং বিএনপি নেতা এবায়েদুল হক চাঁন পেয়েছিলেন ১৯ হাজার ৬২৬ ভোট। বিএনপির তিন প্রার্থী মিলে ওইসময় ৯২ হাজার ২৫০ ভোট পেয়েছিলো। সেখানে এবারের নির্বাচনে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণ নগরীতে ব্যাপক উন্নয়ন ও নিজের ব্যক্তি ইমেজকে কাজে লাগিয়ে গতবারের ৪৬ হাজার ৭৯৬ ভোটের বিপরীতে এবার ভোট পেয়েছেন ৬৬ হাজার ৭৪১ ভোট। এখানে বেড়েছে ১৯ হাজার ৯৪৫ ভোট। আর গত নির্বাচনে বিএনপির তিন প্রার্থীর ৯২ হাজার ২৫০ ভোটের বিপরীতে এবার একক প্রার্থী আহসান হাবিব কামাল পেয়েছেন ৮৩ হাজার ৭৫১ভোট। কমেছে ৮ হাজার ৫০৯ ভোট।

সূত্র আরো জানা গেছে, দীর্ঘ একযুগের বিরোধ মীমাংসা করে এখানে বিএনপি একক প্রার্থী মনোনীত করতে সক্ষম হলেও ব্যর্থ হয় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামীলীগ। দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত মেয়র প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণের প্রতিপক্ষ হয়ে নির্বাচনী মাঠ দাঁপড়িয়ে বেড়ায় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ও মহানগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদুল হক খান মামুন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সাধারন ভোটাররা এক দলে দু’প্রার্থীকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেননি। বিদ্রোহী প্রার্থী মামুন নিজের পক্ষে ভোট চাওয়ার বিপরীতে হিরণের বিরুদ্ধে ভোটের মাঠে অপপ্রচার চালিয়েছেন বেশি। যে কারনেও অনেক সাধারন ভোটারদেরকেই বলতে শোনা গেছে, আ’লীগের দু’জন প্রার্থী হওয়ায় তাদের ভোট ভাগাভাগি হয়ে যাবে। হেরা কেউই হইতে পারবে না ফলে এদের ভোট দিলে ভোট নষ্ট হয়ে যাবে। যে কারনে আওয়ামীলীগের মেয়র প্রার্থীর অনেক ভোট কমেছে।

মেয়র কামালকে হিরণের অভিনন্দন

বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে সম্মিলিত নাগরিক কমিটির পরাজিত মেয়র প্রার্থী আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণ রবিবার রাতে এক বিবৃতীতে নবনির্বাচিত মেয়র আহসান হাবিব কামালকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এক বিবৃতীতে তিনি (হিরণ) পরাজয় মেনে নিয়ে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানিয়ে চলমান উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখার জন্য আহবান করেন। একই বিবৃতীতে হিরণ তার টেলিভিশন প্রতীকের সকল নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। পাশাপাশি একটি গ্রহনযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়ায় জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, নির্বাচন কমিশন, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এছাড়াও যে সকল সম্মানিত ভোটাররা তাকে ভোট দিয়ে তার প্রতি যে আস্থা জ্ঞাপন করেছেন তাদের সকলের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন।

হিরণের নির্বাচন পরবর্তী পর্যালোচনা সভা আগামীকাল

নির্বাচন পরবর্তী পর্যালোচনার জন্য আ’লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে কর্মীসভার আয়োজন করেছেন সদ্য সমাপ্ত বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে পরাজিত মেয়র প্রার্থী ও বরিশাল মহানগর আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণ। আগামীকাল মঙ্গলবার বিকেল চার টায় বরিশাল ক্লাব মিলনায়তনে আয়োজিত এ কর্মীসভায় সকল নেতা-কর্মীকে উপস্থিত থাকার জন্য আহবান করেছেন শওকত হোসেন হিরণ।

কামাল নয়-সরোয়ারের বিজয়

সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে নিজ দলের চির প্রতিদ্বন্ধী মজিবর রহমান সরোয়ার-এমপি’র কাছে আত্মসমর্পণ করা সদ্য বিজয়ী মেয়র আহসান হাবিব কামাল শেষ পর্যন্ত সরোয়ারকেই পুঁজি করে বিজয়ী হয়েছেন বলে নগরবাসী মনে করেন। আর এ বিজয় কামালের নয়, সরোয়ারেই বলে মন্তব্য করেছেন সাধারন ভোটাররা। সূত্রমতে, প্রথমে বিএনপি’র হাইকমান্ড দেশের চার সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে একমত ছিলেন না। পরবর্তীতে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে নির্বাচন করার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ায় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সরোয়ারকে বরিশালের নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, জাতীয় রাজনীতির ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে অত্যান্ত নির্বাচন কৌশলী এমপি সরোয়ার তার কর্মী-বাহিনী ও অনুসারীদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত কামালকে বিজয়ী করে তার জাতীয় নির্বাচনের পথকে অনেকটা সুগম করে রেখেছেন। তারা আরো জানান, সরোয়ারের কৌশলী রাজনীতির কাছে হিরণ নয়; হেরে গেছেন স্থানীয় আওয়ামীলীগের কতিপয় সিনিয়র নেতারা।

জামাই-শ্বশুরের জয়

সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে আবারো জামাই-শ্বশুর বিজয়ী হয়েছেন। বিজয়ীরা হচ্ছেন-২৪নং ওয়ার্ডে শ্বশুর ফিরোজ আহম্মেদ ও ২৫নং ওয়ার্ডে জামাই জিয়াউদ্দিন সিকদার। এ জামাই-শ্বশুর ২০০৩ সনে অনুষ্ঠিত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নির্বাচনে উভয়ে নিজ নিজ ওয়ার্ড থেকে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২০০৮ সনের দ্বিতীয় নির্বাচয়ে উভয়ে পরাজিত হয়ে এবার আবারো বিজয়ী হলেন।

চার কাউন্সিলর চতুর্থ বারের মতো নির্বাচিত

পুরনো চারজন কাউন্সিলর হ্যাটট্রিক করার পর এবার চতুর্থ বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। নির্বাচিত কাউন্সিলররা হচ্ছেন-২নং ওয়ার্ডের একেএম মুরতজা আবেদীন, ৮নং ওয়ার্ডের সেলিম হাওলাদার, ১৫নং ওয়ার্ডের সৈয়দ জাকির হোসেন জেলাল ও ২১নং ওয়ার্ডের আলতাফ মাহমুদ শিকদার। এছাড়া এবার হ্যাটট্রিক করেছেন ১২নং ওয়ার্ডের কেএম শহিদুল্লাহ ও ২৮নং ওয়ার্ডের হুমায়ুন কবির।

হিরণ সমর্থকের ওপর হামলা

পরাজিত মেয়র প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণের সমর্থক আব্দুর রাজ্জাকের ওপর হামলা চালিয়ে আহত করেছে বিজয়ী মেয়র আহসান হাবিব কামালের সমর্থকেরা। জানা গেছে, বিজয়ী মেয়রের সমর্থক ফিরোজ আহম্মেদের নেতৃত্বে এনায়েত ও চুন্নসহ ৭/৮ জনে রবিবার রাত ১১টার দিকে আব্দুর রাজ্জাকের ওপর হামলা চালিয়ে মারধর করে আহত করে।