আর্কাইভ

বরিশালে বিএনপির বিজয়ের নেপথ্যে সরোয়ারের কৌশল

হতাশাগ্রস্থ আ’লীগ

হাসান মাহমুদ, বিশেষ প্রতিনিধি, বরিশাল থেকে ফিরে ॥  বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীর বিজয়ের নেপথ্যে একমাত্র কাজ করেছেন মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সদর আসনের বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ারের রাজনৈতিক কৌশল। এমনটাই মনে করছেন এখানকার রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

সূত্রমতে, বরিশালে দীর্ঘ একযুগ থেকে এমপি সরোয়ার ও জেলা বিএনপির সভাপতি আহসান হাবিব কামালের সাথে তীব্র বিরোধ চলে আসছিলো। এনিয়ে উভয়গ্র“পের সমর্থকদের মধ্যে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হতা হতের ঘটনাও ঘটেছে। দীর্ঘদিনের সকল বিরোধ ভুলে চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার পর বরিশালে মেয়র পদে প্রার্থী হতে আহসান হাবিব কামাল স্ব-শরীরে হাজির হন মজিবর রহমান সরোয়ারের বাসভবনে। এসময় কামাল নিজেকে পুরোটাই আত্মসমর্পন করেন সরোয়ারের কাছে। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ভাবে সরোয়ার-কামালের সকল বিরোধ মীমাংসার মাধ্যমে আহসান হাবিব কামালকে একক প্রার্থী ঘোষনা করে সরোয়ারকে দায়িত্ব দেয়া হয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্ময়কের। সেই থেকে শুরু হয় সরোয়ারের অগ্নিপরীক্ষা। গত এক যুগের দ্বন্ধ ও নিজের আধিপত্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে কেন্দ্রের দেয়া দায়িত্বকে পালন করতে গিয়ে সরোয়ার তার অগ্নিপরীক্ষায় শতভাগ উত্তীর্ণ হয়েছেন। দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে দলীয় প্রার্থী আহসান হাবিব কামালকে বিজয়ী করতে তিনি (সরোয়ার) অতীতের সকল বিরোধ ভুলে নির্বাচনের মাঠে এমন ভাবেই সক্রিয় ছিলেন যেন তিনি নিজেই মেয়র প্রার্থী। যে কারনে নিজের নিরলস প্রচেষ্টা ও নেতা-কর্মীদের একত্রিত করে গত ১৫ জুনের নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে সরোয়ার দলের সাফল্য বয়ে আনেন। সেক্ষেত্রে তফসিল ঘোষণার পর থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেয়াসহ প্রচার-প্রচারনায় পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন ক্ষমতাসিন ১৪ দলের নেতৃবৃন্দরা।

সূত্রে আরো জানা গেছে, বরিশাল সদরে বিএনপির ঘাঁটি বলে পরিচিত। এখানে মজিবর রহমান সরোয়ারের কাছে রয়েছে ভোটের প্রধান চাবি। তিনি নেতা-কর্মীদের একত্রিত করে ভোটারদের মাঝে কৌশলে আ’লীগের সরকার বিরোধী অপপ্রচার করিয়ে সাধারন ভোটারদের ভোট বাগিয়ে আনতে সক্ষম হন। সেক্ষেত্রে মজিবর রহমান সরোয়ারের নেতৃত্ব না থাকলে এখানে আহসান হাবিব কামালের বিজয় ছিলো অনিশ্চিত। এজন্য সরোয়ারকে কখনও আইন শৃংখলা বাহিনী ও আ’লীগ নেতাদের সাথে কৌশলী ভূমিকা এবং কখনো অগ্নিরূপ প্রকাশ করতে হয়েছে।

আ’লীগে হতাশা, উৎফুল্ল বিএনপি

চার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের ভরাডুবিতে বরিশালসহ গোটা দক্ষিণাঞ্চলের আ’লীগ নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধিরা চরম হতাশাগ্রস্থ হয়ে পরেছেন। বর্তমান সরকার চার সিটিতেই শত শত কোটি টাকার উন্নয়ন করা সত্বেও সিটি নির্বাচনে আ’লীগের মেয়র প্রার্থীদের পরাজয়ে আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের বিজয় নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন আ’লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। অপরদিকে চার সিটিতে বিএনপির প্রার্থীদের জয়জয়কারে উজ্জীবিত ও উৎফুল্ল হয়েছেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। ইতোমধ্যে তারা বিভিন্ন এলাকায় বনভোজন থেকে শুরু করে শোকরানা দোয়া-মিলাদের আয়োজন করে আ’লীগ সমর্থিত তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন ধরনের তীরস্কার করে উস্কানীমূলক বাক্য ছুঁড়ে দিচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোমবার বিকেলে নগরীর অশ্বিনী কুমার টাউন হলে ১৮ দলের উদ্যোগে শোকরানা দোয়া-মোনাজাতের আয়োজন করা হয়। এখানে উপস্থিত ছিলেন নব-নির্বাচিত মেয়র আহসান হাবিব কামাল, বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মজিবর রহমান সরোয়ার-এমপি, জেলা বিএনপি’র আহবায়ক এবায়দুল হক চাঁন, মহানগর জামায়াতের আমীর এ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলালসহ জেলা ও মহানগর বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা।

অপরদিকে গৌরনদী উপজেলা যুবদলের উদ্যোগে একইদিন বিকেলে গৌরনদী বাসষ্ট্যান্ড জামে মসজিদে শোকরানা দোয়া-মিলাদ অনুষ্ঠিত হয়। দোয়া ও মিলাদে উপজেলা যুবদলের সভাপতি সফিকুর রহমান শরীফ স্বপন, পৌর সভাপতি নান্না খান, উপজেলা সাধারণ সম্পাদক রফিক চোকদারসহ নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে পৌর এলাকার গেরাকুল মহল্লায় বনভোজন করেছে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীরা। সেখানে বসে ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি সুমন বেপারীকে কটুক্তি করে ভবিষ্যতে দেখে নেয়ারও হুমকি দিয়েছেন বিএনপি নেতা ও খুনী এরশাদ সিকদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী গোলাম মোর্শেদ পান্না।   

বিজয়ের পরই ছাত্রদলের সংঘর্ষ

সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ের পরেই সোমবার ছাত্রদলের দু’গ্রুপের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনাকে সহজেই মেনে নিতে পারছেন না বরিশালের সাধারন জনগন। এখানকার সরোয়ার-কামালের দীর্ঘদিনের দ্বন্ধের অবসান ঘটিয়ে ১৮ দলীয় জোটের ইস্পাত কঠিন ঐক্যে প্রথমেই ফাঁটলের কালিমার ছাঁপ বসিয়েছে কতিপয় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা। সূত্র মতে, মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সদর আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ারের সমর্থক ছাত্রদল নেতা সুজন হাওলাদার বাবুর নেতৃত্বে সদ্য নির্বাচিত মেয়র আহসান হাবিব কামালকে অভিনন্দন জানিয়ে সোমবার দুপুরে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে মিছিল বের করা হয়। এ ঘটনার জেরধরে আহসান হাবিব কামালের সমর্থক ছাত্রদল নেতা মাইনুল ইসলাম রাজিবের নেতৃত্বে অপর অংশের ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা মিছিলে বাঁধা দেয়। এ নিয়ে উভয় গ্র“পের মধ্যে বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সংষর্ষ

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আ’লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণের পরাজয়ের নেপথ্যে জেলা আ’লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে দায়ী করায় ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। জানা গেছে, সোমবার দুপুরে সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের অস্থায়ী কর্ম পরিষদে বসে হিরণ সমর্থিত মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসিম উদ্দিনের সাথে হাসানাত সমর্থিত মহানগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক ওয়াসিম দেওয়ানের মধ্যে বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে প্রথমে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে উভয় গ্রুপের সমর্থকেরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পরে। খবর পেয়ে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন।

 

জামায়াত ও হেফাজত নিষিদ্ধ না হলে করুণ পরিণতি

জামায়াত ও হেফাজত নিষিদ্ধ করা না হলে ডিসেম্বরে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে আরো করুণ পরিস্থিতি দেখতে হবে। এমনকি যেসব ঘাতকের বিচার এবং রায় কার্যকর করার অপেক্ষায় রয়েছে, একদিন তারাই হয়তো পাল্টা বিচার করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের। চার সিটিতে আ’লীগের ভড়াডুবির পর এ কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কমান্ডের বরিশালের গৌরনদী উপজেলা শাখার আহবায়ক ও গণজাগরন মঞ্চের উদ্যোক্তা সৈকত গুহ পিকলু। তিনি আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং একাত্তরের মতই শ্লোগানে সোচ্চার হতে হবে। একাত্তরে ওরা মানুষ হত্যা করেছে, আসুন আমরা পশু হত্যা করি। দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষদের ধর্মীয় অনুভূতি পুঁজি করে ওরা বাংলাদেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে মিথ্যাচারে লিপ্ত রয়েছে। এর প্রকৃত বার্তা দেশবাসীর কাছে উন্মুক্ত করতে হবে বলেও তিনি মনে করেন।

স্কুলের গন্ডি পার হতে পারেননি ১৩ কাউন্সিলর

প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা না থাকলেও এলাকায় জনপ্রিয়তার কারনে বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিজয়ী হয়েছেন স্কুলের গন্ডি পার না হওয়া ১৩ জন কাউন্সিলর প্রার্থী। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ৫ম থেকে সর্বোচ্চ ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত। এদের মধ্যে দুইজন হলফনামায় তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতার স্থানে ‘অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন’ লিখেছেন। আর একজন লিখেছেন স্বশিক্ষিত। তবে তাদের সৎ আর নিষ্ঠার কারনে শিক্ষাগত অক্ষমতা বিজয়ী হবার পথে বাঁধার সৃষ্টি করেনি। অপর ১৭ জনের মধ্যে এসএসসি পাশ ২জন, এইচএসসি পাশ ৮জন এবং বিএ অথবা স্নাতোকোত্তর ডিগ্রীধারী কাউন্সিলর হচ্ছেন ৭ জন। স্কুলের গন্ডি পার হতে না পারা ১৩ বিজয়ী কাউন্সিলরা হলেন- ৩নং ওয়ার্ডের সৈয়দ হাবিবুর রহমান ফারুক (৮ম শ্রেনী), ৪নং ওয়ার্ডের মোঃ ইউনুস মিয়া (৮ম শ্রেনী), ৭নং ওয়ার্ডের সৈয়দ আকবর হোসেন (স্বশিক্ষিত), ৮নং ওয়ার্ডের সেলিম হাওলাদার (এসএসসি ফেল), ৯নং ওয়ার্ডের হারুন-অর রশিদ (৮ম শ্রেনী), ১০নং ওয়ার্ডের মোঃ জয়নাল আবেদীন (৮ম শ্রেনী), ১১নং ওয়ার্ডের মুজিবুর রহমান (৮ম শ্রেনী), ১২নং ওয়ার্ডের কে.এম শহীদুল্লাহ (৯ম শ্রেনী), ২৩নং ওয়ার্ডের রেজভী চৌধুরী (৮ম শ্রেনী), ২২নং ওয়ার্ডের সহিদুল ইসলাম তালুকদার (স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন), ২৪নং ওয়ার্ডের ফিরোজ আহম্মেদ (৮ম শ্রেনী), ২৬নং ওয়ার্ডের ফরিদ হোসেন (৮ম শ্রেনী) ও ২৭নং ওয়ার্ডের নুরুল ইসলাম (স্বাক্ষর জ্ঞান সম্পন্ন)।

বাতিল হয়েছে ৫ হাজার ভোট

সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র, কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের দেয়া ১’শ টি কেন্দ্রের ভোটের মধ্যে ৫ হাজার ৩১৮টি ভোট বাতিল করা হয়েছে। ভোটদানের সঠিক পদ্ধতি না জানায় এ ভোটগুলো বাতিল হয়েছে বলে জানিয়েছেন সহকারী রিটার্নিং অফিসার মোঃ দুলাল তালুকদার। সূত্রমতে, বাতিল হওয়া ভোটের উল্লেখযোগ্য কেন্দ্রগুলো হচ্ছে-নগরীর কাউনিয়া পৌর আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৯৯টি, বিসিক অফিস কেন্দ্রে ৬৬টি, সৈয়দা মজিদুন্নেছা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৬৭টি, এ.কাদের চৌধুরী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৯৪টি, শের-ই-বাংলা দিবা নৈশ মাধ্যমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ৬৩টি, পুরানপাড়া কেন্দ্রে ৫১টি ও অন্যান্য কেন্দ্রসহ মোট ৫ হাজার ৩১৮টি ভোট বাতিল করা হয়েছে। এছাড়া ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম)’র মাধ্যমে ভোট দিতে গিয়ে ৪০টি ভোট নষ্ট হয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

Back to top button