বরিশালে আ’লীগ ও বিএনপির ইস্পাত ঐক্যে ভাঙ্গণের সুর

হাসান মাহমুদ, বিশেষ প্রতিনিধি, বরিশাল থেকে ফিরে ॥  সদ্য সমাপ্ত বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের পর এখানকার আ’লীগ সমর্থিত ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোট ও বিএনপি সমর্থিত ১৮ দলীয় জোটের ইস্পাত ঐক্যে ভাঙ্গনের সুর বাজছে। এ নিয়ে উভয়দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মাঝে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে।

 
আজ বৃহস্পতিবার জেলার ১০ উপজেলা আ’লীগের পক্ষে জেলা আ’লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধে পরাজিত মেয়র প্রার্থী ও মহানগর আ’লীগের সভাপতি শওকত হোসেন হিরণের অপপ্রচার বন্ধে সংবাদ সম্মেলন করা হয়। এরপূর্বে হিরণ তার পরাজয়ের ব্যাপারে সরাসরি হাসানাত ও তার স্বজনদের দায়ী করেন। এরপর থেকেই এখানকার আ’লীগের মধ্যে দ্বিধা বিভক্ত ছড়িয়ে পরে। ইতোমধ্যে দু’দফা হাসানাত বিরোধী মিছিলও করেছেন হিরণের সমর্থকেরা। ইতোমধ্যে এখানকার ছাত্রলীগের দু’গ্র“পের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। অপরদিকে নির্বাচনের পর গত ১৭ জুন ১৮ দলীয় জোটের বিজয়ী মেয়র আহসান হাবিব কামালের সমর্থক ও মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার-এমপি’র সমর্থক ছাত্রদল নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এ নিয়ে এখানকার ছাত্রদলের কারণে বিএনপিতেও ভাঙ্গনের সুর বাজছে।

সূত্রমতে, সিটি নির্বাচনের তিনদিন পর গত ১৮ জুন বিকেলে বরিশাল মহানগর আ’লীগের কর্মীসভায় মুখ খোলেন বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে পরাজিত হওয়া ১৪ দলের মেয়র পদপ্রার্থী ও মহানগর আ’লীগের সভাপতি আলহাজ্ব শওকত হোসেন হিরণ। তিনি ওই সভায় তার বক্তব্যে জেলা আ’লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ভাই কি ক্ষতি করেছি আপনার, যেকারনে আপনি, আপনার ছেলে, আপনার শ্যালক কাজী কামাল, ছাত্রলীগ নেতা অসিম দেওয়ান, অপনার বন্ধু জাহাঙ্গীর হোসেন বিএনপির প্রার্থীর আনারস মার্কার পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করে আমাকে পরাজিত করেছেন। অতীতে ঠিক যেভাবে আ’লীগের পক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী এসপি মাহাবুব, মরহুম মহিউদ্দিন আহমেদ, এনায়েত পীরের মতো নেতাদের আপনি আস্তুকুড়ে নিক্ষেপ করেছেন। তেমনি আমার বেলায়ও একই কাজ করলেন। হিরণ আরো বলেন, তার (হাসানাত) হাত ধরে রাজনীতিতে আসলেও তিনি এখন থেকে আর আমার অভিভাবক নয়। পরবর্তীতে হিরণ তার সমর্থক প্রায় ১০ হাজার নেতা-কর্মীকে নিয়ে মিছিল সহকারে নগরীর বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করেন।

গত ১৯ জুনও একইভাবে হিরণ তার সমর্থকদের নিয়ে মিছিল বের করেন। এসময় হিরণের সমর্থকেরা হাসানাত বিরোধী নানা শ্লোগান দেয়। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আ’লীগের প্রার্থী শওকত হোসেন হিরণের পরাজয়ের নেপথ্যে জেলা আ’লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহকে দায়ী করায় গত ১৭ জুন ছাত্রলীগের দু’গ্র“পের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। ওইদিন দুপুরে সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের অস্থায়ী কর্ম পরিষদে বসে হিরণ সমর্থিত মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি জসিম উদ্দিনের সাথে হাসানাত সমর্থিত মহানগর ছাত্রলীগের সাধারন সম্পাদক অসিম দেওয়ানের মধ্যে বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে উভয়ের মধ্যে প্রথমে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে উভয় গ্র“পের সমর্থকেরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পরে। খবর পেয়ে কোতয়ালী মডেল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনেন।

এদিকে হিরণের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে আজ বৃহস্পতিবার বেলা এগারোটায় বরিশাল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন জেলার ১০টি উপজেলার আ’লীগ নেতারা। গৌরনদী উপজেলা আ’লীগের সাধারন সম্পাদক ও পৌর মেয়র মোঃ হরিছুর রহমান হারিছ লিখিত বক্তব্যে বলেন, ১৪ দলের পক্ষ থেকে মেয়র পদে শওকত হোসেন হিরণকে মনোনয়ন দেয়ার পর জেলা আ’লীগের সভাপতি ও সাবেক চীফ হুইপ আলহাজ্ব আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ তার সাধ্য অনুযায়ী হিরণের পক্ষে কাজ করেছেন। এরপরও তাকে দায়ী করা অযৌক্তিক ও অন্যায়। এছাড়া হিরণ যে ভাষায় তাকে আক্রমণ করছে তা রাজনৈতিক শিষ্টাচার বর্হিভূত। এতে করে দলে বিভাজন বাড়বে। যার সুফল নেবে স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত ও বিএনপি চক্র। তাই আ’লীগের ঐক্য বিনষ্ট না করতে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত নেতারা হিরণকে আহবান করেন। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যদের মধ্যে মেহেন্দিগঞ্জের সাবেক সাংসদ মাঈদুল ইসলাম, বাকেরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শামসুল আলম চুন্নু, মুলাদীর পৌর মেয়র শফিকুল ইসলাম রুবেল, বাকেরগঞ্জের পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়া সহ দশ উপজেলার আ’লীগের সভাপতি ও সাধারন সম্পাদকেরা উপস্থিত ছিলেন।

অপরদিকে বরিশালে দীর্ঘ একযুগ থেকে এমপি সরোয়ার ও জেলা বিএনপির সভাপতি আহসান হাবিব কামালের সাথে তীব্র বিরোধ চলে আসছিলো। এনিয়ে উভয়গ্র“পের সমর্থকদের মধ্যে একাধিকবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও হতা হতের ঘটনাও ঘটেছে। দীর্ঘদিনের সকল বিরোধ ভুলে চার সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষনার পর বরিশালে মেয়র পদে প্রার্থী হতে আহসান হাবিব কামাল স্ব-শরীরে হাজির হন মজিবর রহমান সরোয়ারের বাসভবনে। এসময় কামাল নিজেকে পুরোটাই আত্মসমর্পন করেন সরোয়ারের কাছে। পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় ভাবে সরোয়ার-কামালের সকল বিরোধ মীমাংসার মাধ্যমে আহসান হাবিব কামালকে একক প্রার্থী ঘোষনা করে সরোয়ারকে দায়িত্ব দেয়া হয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্ময়কের। সেই থেকে শুরু হয় সরোয়ারের অগ্নিপরীক্ষা। গত এক যুগের দ্বন্ধ ও নিজের আধিপত্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে কেন্দ্রের দেয়া দায়িত্বকে পালন করতে গিয়ে সরোয়ার তার অগ্নিপরীক্ষায় শতভাগ উত্তীর্ণ হন।

দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে দলীয় প্রার্থী আহসান হাবিব কামালকে বিজয়ী করতে তিনি (সরোয়ার) অতীতের সকল বিরোধ ভুলে নির্বাচনের মাঠে এমন ভাবেই সক্রিয় ছিলেন যেন তিনি নিজেই মেয়র প্রার্থী। যে কারনে নিজের নিরলস প্রচেষ্টা ও নেতা-কর্মীদের একত্রিত করে গত ১৫ জুনের নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে সরোয়ার দলের সাফল্য বয়ে আনেন। সেই সফলতার একদিন পরেই গত ১৭ জুন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বিজয়ের পরেই ছাত্রদলের দু’গ্র“পের সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এখানকার সরোয়ার-কামালের দীর্ঘদিনের দ্বন্ধের অবসান ঘটিয়ে ১৮ দলীয় জোটের ইস্পাত কঠিন ঐক্যে প্রথমেই ফাঁটল ধরায় কতিপয় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরা।

সূত্র মতে, মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সদর আসনের সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ারের সমর্থক ছাত্রদল নেতা সুজন হাওলাদার বাবুর নেতৃত্বে সদ্য নির্বাচিত মেয়র আহসান হাবিব কামালকে অভিনন্দন জানিয়ে ওইদিন দুপুরে বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ক্যাম্পাসে মিছিল বের করা হয়। এ ঘটনার জেরধরে আহসান হাবিব কামালের সমর্থক ছাত্রদল নেতা মাইনুল ইসলাম রাজিবের নেতৃত্বে অপর অংশের ছাত্রদল নেতা-কর্মীরা মিছিলে বাঁধা দেয়। এ নিয়ে উভয় গ্র“পের মধ্যে বাকবিতন্ডার একপর্যায়ে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পর থেকেই শুধুমাত্র ছাত্রদলের কারনেই এখানকার বিএনপিতে ফাঁটলের সুর দেখা দিয়েছে। যদিও এখানকার বিএনপির শীর্ষ নেতারা জানিয়েছেন, কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিলো তা পরবর্তীতে নিস্ফতি করে দেয়া হয়েছে।