বিশেষ সম্পাদকীয়
শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে আমরা শব-ই বরাত বলে থাকি। শব অর্থ রাত, আর বরাত অর্থ মুক্তি। শব-ই বরাত অর্থ হলো মুক্তির রাত। হাদিসের পরিভাষায় এই রাতটিকে বলা হয় “লাইলাতুম মিন নিসফি শাবান”। শব-ই বরাত মূলত উম্মতে মুহাম্মদির ওপর আল্লাহ তায়ালার বিশেষ অনুগ্রহ। কোনো ব্যক্তি ঈমান ও ইহতিসাবের সাথে এই রাতগুলো ইবাদত করলে, দীর্ঘ হায়াতপ্রাপ্ত উম্মতের চেয়েও তাদের নেক বৃদ্ধি করে দেবেন। সেই বরকতময় রজনীগুলোর মধ্য থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলো শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত তথা শব-ই বরাত। একাধিক হাদিসের দ্বারা এই রাতের ফজিলত সু-প্রমাণিত। হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আল্লাহ তায়ালার রহমত এবং করুণা ছাড়া কেউ কি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালার রহমত ছাড়া জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে এমন কেউ নেই। তখন হজরত আয়েশা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, আপনি ও নন ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তিনি বললেন, আমি ও নই। তবে আল্লাহ তায়ালা আমাকে স্বীয় রহমতের দ্বারা বেষ্টন করে রাখবেন। এ কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিনবার বলেন। (মিশকাতুল মাসাবিহ ৪০৮ পৃষ্ঠা) অন্য হাদিসে আছে, হজরত আলা ইবনুল হারেস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, হজরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজে দাঁড়ান এবং এত দীর্ঘ সিজদা করেন যে, আমার ধারণা হলো, তিনি হয়তো ইন্তেকাল করেছেন। আমি উঠে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৃদ্ধাঙ্গুলি ধরে নাড়া দেই, তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নড়ে ওঠে। তিনি সিজদা থেকে উঠে যখন নামাজ শেষ করেন তখন আমাকে বলেন, হে আয়েশা! তোমার কি ধারণা হয় যে, আল্লাহ তায়ালার রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন। আমি বললাম, না ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার এই আশংকা হয় যে, আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন। নবীজী জিজ্ঞাসা করেন, তুমি কি জান এটা কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ তায়ালা ও তার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই ভালো জানেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এটা অর্ধশাবানের রাত। আল্লাহ তায়ালা এই রাতে বান্দার প্রতি মনোযোগ দেন এবং ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করে দেন আর অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষপোষণকারীদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেন। কোরআন-হাদিস ও ফিকহের কিতাবাদী ঘাটাঘাটি করলে এই রাতের কয়েকটি আমল সম্পর্কে জানা যায়। রাত জাগরণ করা এই রাতের অন্যতম আমল হলো সারা রাত জাগ্রত থেকে আল্লাহ তায়ালার নফল ইবাদত-বন্দেগী, জিকির-আজকার, কোরআন তেলাওয়াত, তাহাজ্জুদ নামাজ, তাওবা-ইস্তেগফার ইত্যাদি করা। হাদিস শরিফে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি পাঁচটি রাত জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। যিজলহজ্জের অষ্টম রাত, যিলহজ্জের নবম রাত, ঈদুল আযহার রাত, ঈদুল ফিতরের রাত ও শাবানের ১৫ তারিখের রাত (আত্তারগীব ওয়াত্তারহীব ২/১৫২) তবে অধিক রাত জাগার কারণে যদি ফজরের নামাজ কাযা হয়ে যাওয়ার আশংকা থাকে তাহলে যতটুকু সম্ভব জেগে ইবাদত-বন্দেগি করে শুয়ে পড়বে। তবে ফজরের নামাজ অবশ্যই মসজিদে জামায়াতের সাথে পড়বে। অন্যথায় রাত জেগে ইবাদত করার মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। বরং সারারাত ঘুমিয়ে ফজরের নামাজ জামায়াতের সাথে পড়লে সারারাত ইবাদতের করার সাওয়াব পাওয়া যাবে। এইরাতে অধিক পরিমাণে দোয়া করা উচিত। কেননা প্রত্যেক রাতে আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে অবতরণ করে বান্দাকে তার প্রয়োজনের জন্য দোয়া করতে বলেন এবং রাতে আল্লাহ তায়ালা অধিক হারে তার বান্দাদেরকে মাপ করে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে খুব কান্নাকাটি করে দোয়া করতেন। হাদিস শরিফে আছে, হজরত ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, পাঁচটি রাতের দোয়া বিফল যায় না। জুমার রাত, রজব মাসের প্রথম রাত, অর্ধশাবানের রাত এবং দুই ঈদের রাত। (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ৪/৩১৭) অন্য হাদিসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের ১৫ তারিখে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন এবং কালব গোত্রের বকরীর পশমের চেয়ে ও অধিক পরিমাণ লোককে তিনি ক্ষমা করে দেন। উল্লেখ্য, এই গোত্রে ছাগলের সংখ্যা ছিল প্রায় ২০ হাজার। হজরত আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন শাবানের পঞ্চদশ রাত আগমন করে তখন রাতে নামাজ পড় এবং পরবর্তী দিন রোজা রাখ। কেননা সূর্যাস্ত থেকে ফজর পযর্ন্ত আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে এসে এই আহবান করতে থাকেন, আছ কি কোনো ক্ষমাপ্রার্থী? আমি তাকে ক্ষমা করবো। আছ কি কোনো রিজিক অন্বেষণকারী? আমি তাকে রিজিক দান করব। আছ কি কোনো বিপদগ্রস্ত? আমি তার বিপদ দূর করে দেব। আছ কি এমন কোনো ব্যক্তি? এমন কোনো ব্যক্তি? ইত্যাদি। (সুনানে ইবনে মাজা ২/১৬০, হাদিস নং ১২৮৮)।