মহান জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত সাংসদদের মুখে অশ্লীলতার ফুলঝুরি

প্রেমানন্দ ঘরামী ॥  গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু ও জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক মহান জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে এ কোন ভাষায় কথা বলছেন আমাদের আইন প্রণেতারা? সংসদ টিভিতে সরাসরি তাদের নোংরা, অশোভন, রুচিহীন কথাবার্তা শুনে স্তম্ভিত দেশের ১৬ কোটি মানুষ। এ কি মন্তব্য নাকি খিস্তিখেউড়? বেশ কিছুদিন ধরে সংসদে বিরোধী দল ও সরকারি দলের কয়েকজন সংসদ সদস্য কে কতো বেশি খারাপ ও নোংরা ভাষায় কথা বলতে পারেন, যেন তারই প্রতিযোগীতায় নেমেছেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য এগিয়ে রয়েছেন বিরোধী দলের সাংসদরা। শুরুটাও করেছিলেন বিরোধী দলের সংরক্ষিত নারী আসনের তিন সদস্য। এ প্রতিযোগীতায় এখন শামিল সরকারি দলের কোনো কোনো সদস্য। তাদের অব্যাহত অশালীন বক্তব্যে শঙ্কিত জাতি। সর্বস্তরের মানুষের দাবি, বন্ধ হোক এই অশ্লীলতার চর্চা। মহান সংসদে দাঁড়িয়ে জনগণের উন্নয়নের কথা বলুন। সংসদকে কলুষিত করার অধিকার জনগণ আপনাদের দেয়নি। সংসদে বিরোধী ও সরকারদলীয় চার নারী সাংসদের সাম্প্রতিক যেসব অশালীন বক্তব্য নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছে তা তুলে ধরা হলো।

 

জন্ম পরিচয় নিয়ে অপু উকিলের প্রশ্ন

বিরোধী দলীয় সাংসদ পাপিয়া, রানু ও শাম্মীর অশ্লীল বক্তব্যের রেশ কাটতে না কাটতেই বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার জন্মপরিচয় নিয়ে বক্তব্য রেখে নতুন করে ঝড় তুললেন সরকারদলীয় সংরক্ষিত নারী সদস্য অপু উকিল। গত ২০ জুন সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি রীতিমতো তুলোধুনো করেছেন খালেদা জিয়াকে। এমনকি তার বক্তব্য থেকে ছাড় পায়নি জিয়াউর রহমান ও তার দুই ছেলেও। অপু উকিল বলেন, খালেদা জিয়ার মা লক্ষ্মীরানী মারমা দার্জিলিংয়ের চা বাগানের মালিক উইলসনের চাকরানী ছিলেন। চা বাগানের মালিকের ছিল মদ ও নারীর প্রতি আসক্তি। লক্ষ্মীরানী গর্ভবতী হলে উইলসনের দারোয়ান মুরালী মোহন মারমার সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া হয়। উইলসনের তত্ত্বাবধানে ১৯৪৫ সালের ১৩ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্ম হয়। খালেদা জিয়া ইহুদি ঔরসজাত। তার গায়ের রং ও খাদ্যাভ্যাস তার প্রকৃত ইহুদি পিতার সঙ্গে মিল আছে। ১৯৬০ সালে জিয়াউর রহমান ফুর্তি করতে এসে ফেঁসে গিয়ে খালেদা জিয়াকে বিয়ে করেন বলেও মন্তব্য করেন অপু উকিল। ১৯৭১ সালে খালেদা জিয়া পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তা জানজুয়ার সঙ্গে পরকীয়ায় মত্ত ছিলেন উল্লেখ করে অপু বলেন, লোকে বলে জানজুয়ার অবিকল চেহারা পেয়েছে কোকো। পাকিস্তানের সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের ইন্দো-পাকিস্তান ওয়ার অব ১৯৬৫ বই থেকে উদ্ধৃত করে বক্তব্য দেন অপু। তার বক্তব্যের সময় সিদ্দিক সালিকের লাল মলাটের বইটি উঁচিয়ে সংসদে প্রদর্শন করেন। এ সময় বিরোধীদল তীব্র প্রতিবাদ করে এবং সমস্বরে ছি ছি ধ্বনি দেয়। বিএনপি সাংসদরা অপু উকিলের মাইক বন্ধ করে দেয়ার জন্য স্পিকারের কাছে দাবি জানান। অপু উকিল বক্তব্য অব্যাহত রাখলে রাত ৮টা ৫৭ মিনিটে বিএনপি-জামায়াতের সাংসদরা জমিরউদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে ওয়াকআউট করেন।

 

 

চুদুর বুদুর চইলতো ন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় দেয়া বিএনপির সংরক্ষিত নারী সদস্য রেহানা আক্তার রানুর অশ্লীল বক্তব্য শুধু বাংলাদেশেই নয়, সীমানা পেরিয়ে ঝড় তুলেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও। দাবি উঠেছে এক্সপাঞ্জের। রেহানার বক্তব্যে রুলিং দিয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবো, যদি ভাষা অসংসদীয় হয়, তাহলে বাতিল করা হবে। গত ৯ জুন বিএনপির বাজেটের ওপর আলোচনার নামে সরকারের বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ আক্রমণাত্মক বক্তব্য রাখেন রেহানা আক্তার রানু। তিনি বলেন, দুঃশাসনের কবলে আজ গোটা দেশ। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা চারিদিকে। চুরি ও দুর্নীতির জন্য যদি নোবেল পুরস্কার থাকতো, তবে এই সরকারের সব মন্ত্রীই পেতেন। দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্প ‘ঘ্যাচাং’ করে দেয়ায় সরকার কর্তৃক পদ্মা সেতুর নামে বাঁচ্চাদের টিফিনের টাকা নেয়া হয়েছে, নানাভাবে চাঁদাবাজি করেছে। তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে তিনি বলেন, যে তত্ত্বাবধায়ক ছিল আওয়ামীলীগের দাবি, সেই দাবি এখন ৯০ ভাগ মানুষের দাবি। আজ বিএনপি সেই দাবি করায় সরকারের ‘ডায়রিয়া’ হয়ে গেছে। তারেক জিয়া একথা বলায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী ভয়-আতঙ্কে পেট খারাপ করে কাপড়-চোপড় নষ্ট করে ফেলেছে। সোজা কথা বলতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে কোনো ‘চুদুর বুদুর চইল তো ন’। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, ওয়ান-ইলেভেন সরকার নাকি তাকে গ্রেফতার করে ‘গরম ডিম ঢুকিয়ে দিয়ে’ নির্যাতন করেছে। অর্থমন্ত্রী যে বাজেট দিয়েছেন, তা ছলনাময়ী নারীর মতো। ইন্টারপোলের মাধ্যমে তারেক রহমানকে ফিরিয়ে আনা হবে, এটি সরকারের রাজনৈতিক শয়তানি, আইন প্রতিমন্ত্রীর ডিজিটাল পাগলামি বলেও মন্তব্য করেন রানু। এর আগে ৬ জুন পাটমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় ‘ছাগল ছাগল’ বলে চেঁচিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, অধিবেশন কক্ষে বসে ‘ব্যা ব্যা’ করেছেন ছাগলের সুরে। এছাড়া ২০১২-এর ১৮ মার্চ রাষ্ট্রপতির ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনায় রানু বলেছিলেন, ‘মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনের কোলে বসে ক্ষমতায় এসেছেন।

 

কোলে বসে ক্ষমতায় আসার তত্ত্ব 

সংসদের চলতি অধিবেশনে অশ্লীলতার শুরুটা করেছেন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সংরক্ষিত নারী সাংসদ সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়া। গত ৯ জুন পাপিয়া পয়েন্ট অফ অর্ডারে দাঁড়িয়ে আওয়ামীলীগের সংসদীয় দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এক বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলেন, তার ওই বক্তব্যের ‘ধিক্কার’ জানাই। বক্তব্যে এক পর্যায়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনিকেও আক্রমণ করেন বিরোধী সদস্য পাপিয়া। তাকে ‘হাইব্রিড’ নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন তিনি। পাপিয়ার বক্তব্যের পরে ফজলে রাব্বী মিয়া বক্তব্য রাখার সুযোগ পান। তিনি বিরোধী দলের সংসদ সদস্যের বক্তব্য এক্সপাঞ্জের দাবি জানিয়ে বলেন, এই বক্তব্য কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী হয়নি। এরপর আব্দুল মান্নান বলেন, পয়েন্ট অব অর্ডারের নামে সংসদ নেতা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়ে ‘অশালীন’ বক্তব্য রেখেছেন বিরোধী দলের সংসদ সদস্য। অবশ্য পাপিয়ার এসব অশ্লীলতা নতুন নয়। ২০১২ সালের ১৯ মার্চ রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, ‘মেরুদন্ডহীন রাষ্ট্রপতি’। আওয়ামীলীগের সাংসদ নাজমা আক্তারকে উদ্দেশ্য করে পাপিয়া বলেন, নারায়ণগঞ্জ যাদের বাস তারাই ভালো জানেন নিষিদ্ধপল্লীর কথা। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের কোলে বসে লং ড্রাইভে গেছেন। ১৯৯৬ সালে নির্বাচনের আগে গোলাম আযমের কোলে বসেছেন। মতিউর রহমান রিন্টুর বইয়ে পড়েছি, বেয়াইয়ের কোলে বসার দৃশ্য দেখে চাকর আত্মহত্যা করেছে। সীমান্তের উত্তেজনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় এলে সরকারের দুই নারী মন্ত্রীকে বিবস্ত্র করে ভারতীয় পুলিশ দিয়ে পেটাবো।

 

আমিও….গালি দিতে জানি

সংসদে অশালীন ভাষা ব্যবহার নিয়ে স্পিকারের রুলিংকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বিএনপির সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য শাম্মী আক্তারের অশ্লীল, কদর্য ও ‘প্রকাশের অযোগ্য’ ভাষার বক্তব্য নিয়ে গত ১৯ জুন জাতীয় সংসদে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তীব্র হৈচৈ, হট্টগোল, স্পিকারের বারবার সতর্কবার্তা এবং দুবার মাইক বন্ধ করেও শাম্মী আক্তারকে অসংসদীয় ভাষায় সরকারের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য থেকে বিরত রাখা যায়নি। একপর্যায়ে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী শাম্মীর সকল অসংসদীয় বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করে দেন। শাম্মী তার বক্তব্যে শুধু কদর্য ভাষাই ব্যবহার করেননি, বক্তব্য শেষে তাকে উল্লাস প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে সরকারের উদ্দেশে কবি হেলাল হাফিজের একটি কবিতা পড়ে শোনান, যার শেষ উক্তিটি ছিলো-‘গুছাইয়া গাছাইয়া লন, বেশি দিন পাইবেন না সময়/আলামত দেখতাছি মানুষের হইবোই জয়/আমিও গেরামের পোলা/….গালি দিতে জানি।’ এই কবিতায় ‘চ’ বর্গীয় গালি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি দলের সদস্যরা হইচই শুরু করেন। বলতে থাকেন ছি ছি..। আর সহাস্যে টেবিল চাপড়ে শাম্মী আক্তারকে সমর্থন জানান বিরোধী দলের সদস্যরা। শাম্মীর বক্তব্যের শেষে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আপনার বক্তব্যে কিছু অসংসদীয় শব্দ রয়েছে, যা কার্যবিবরণী থেকে বাদ দেয়া হবে। এর আগেও তার বক্তব্যে কিছু অসংসদীয় ভাষা ও ইঙ্গিত থাকায় স্পিকার এক দফা মাইক বন্ধ করে দেন। ওই সময় শাম্মী বলছিলেন, ‘গলি গলি মে শোর হ্যায়, আওয়ামীলীগ চোর হ্যায়।’ ৯ জুন সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি এটি লোপাটের বাজেট। বিশাল কর্মীবাহিনী, চাপাতি লীগ, রামদা লীগ, ধর্ষক লীগ, অমুক লীগ, তমুক লীগ সকল লীগের উদরপূর্তি করতে হবে তাই এই বিশাল বাজেট। বেশি কিছু বলবো না, তবে দু-চারটা কথা না বললেই তো নয়।’ শাম্মী বলেন, ‘আসুন সমানে সমানে খেলাটা হোক। দেখি আপনাদের ঝুলিতে কতো আছে আর আমাদের কতো আছে। তারেক রহমানের আসার কথা শুনে মন্ত্রীরা আবোল-তাবোল বকতে শুরু করেছেন। আর বাজেট নিয়ে কথা বলবেন কি-কিভাবে নেত্রীকে তুষ্ট করবেন তাতে ব্যস্ত থাকেন। নেত্রীর ছেলে কখন পায়খানা করেছিল এসব বলতে ব্যস্ত থাকেন।’ স্পিকার তখন তাকে থামানোর চেষ্টা করলে তার স্বর আরো উঁচু হয়। শাম্মী আরো বলেন, ‘আপনারা তারেক রহমানের চরিত্র নিয়ে কথা বলেন। তিনি অনেক নারীর শ্লীলতাহানি করেছেন। আমার প্রশ্ন, কয়জন নারী সাংসদের শ্লীলতাহানি করেছেন তারেক? আপনারা কয়জন তার কাছে গিয়েছিলেন?’