প্রতিক্ষা : যুথিকা বড়ুয়া

এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, যেন কিছুই ঘটেনি! অথচ মনে মনে ভাবছে, মা নিশ্চয়ই জেনে গেছে! এতক্ষণ ওয়াচই্ করছিল বোধহয় ওকে!

অপ্রস্তুত মমতা হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলেও খোকনের আপদমস্তক লক্ষ্য করে জিজ্ঞাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। স্তম্ভিত হয়ে যায় বিস্ময়ে। কিছু একটা যে ঘটতে চলেছে, সেটা টের পেয়েই অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথেই নিশ্চিত হয়। আবার পরক্ষণে ভাবে, না:, বোধহয় ওরই বোঝার ভুল হচ্ছে হয়তো!

অথচ মমতা আদৌ জানে না যে, ঐ পোটলাতে কি আছে! সেই মারাত্মক জিনিসটি কি! আর মায়ের অজান্তেতলে তলে খোকন এসব করছেই বা কি!

লক্ষ্য করলো, চেহারাটা মুহূর্তে বিবর্ণ হয়ে গেল খোকনের। গভীর তন্ময় হয়ে কি যেন ভাবছে। কিন্তু একজন গর্ভধারিনী, স্নেহময়ী মায়ের মন, সত্য উদ্ঘাটন না হওয়া পর্যন্ত কখনো শান্তি পায়না। কারণ অনুসন্ধানে প্রচন্ড উদগ্রীব হয়ে ওঠে মমতা।

খোকনের মুখের দিকে গম্ভীর হয়ে চেয়ে থাকে মমতা। চোখে চোখ পড়তেই বলল,-‘খোকা, তুই আমায় সত্যি করে বল্ তো, এতো সকালে কোথায় যাচ্ছিস? কোন্ রাজকার্যে যাচ্ছিস শুনি? এমন করছিস কেন? কিরকম

অন্যমনস্ক, অন্থির অস্খির ভাব! এতো কিসের চিন্তা তোর? সংসারে আমাদের আর আছে কে বল তো!’

খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, -‘মায়ের কাছে কিছু লুকোস নে বাবা! কি হয়েছে, আমায় খুলে বল!’

খোকন নিরুত্তর। পড়ে যায় বিপাকে। পোটলাটা লুকোবার চেষ্টা করে। মাকে উপেক্ষা করে হঠাৎই আহাল্লাদে গদগদ হয়ে ওঠে। বাধ্যগত ছেলের মতো খুব নরম হয়ে, মোলায়েম করে বলল,-‘তুমি না ঘুমিয়ে উঠে এলে কেন মা! আমি কি দুধের খোকা! ইউনিভার্সিটির ছাত্র আমি! হাট্টা গোট্টা তরুণ যুবক! সামান্য একটা বিষয়কে এতো সিরিয়াসভাবে নিচ্ছো কেন বলো তো! আমারও তো একটা প্রাইভেসি আছে, না কি!’

ভ্রু-যুগল কুঁচকে চেয়ে থাকে মমতা। ভিতরে ভিতরে খুব চটে যাচ্ছে। কিছু বলার ব্যকুলতায় ঠোঁটদুটো কেঁপে উঠতেই ফিক্ করে হেসে ফেলল খোকন। মাকে কনভিন্স করার চেষ্টা করে। বলে,-“ও: হো:, এতো টেনশন নিচ্ছো কেন বলো তো! রিল্যাক্স মা রিল্যাক্স! ডোন্ট ওরি! ক’মন! আচ্ছা, উঠেই পড়েছ যখন ফটাফট্ এক কাপ গরম চা নিয়ে এসো দেখি! শরীরটা একটু ঝরঝরে হয়ে যাক!’

মমতা তক্ষুণিই চলে যায় রান্নাঘরে। ইত্যবসরে খোকন তাড়াহুড়ো করে গা-হাত-পা মুছে, ঝটপট্ জামা-প্যন্ট পড়ে নেয়। মাথা আঁচড়াতে আঁচড়াতে রান্নাঘরের দিকে গলা টেনে একবার দেখল। দেখে কি যেন ভাবল। আর তক্ষুণি কাপড়ের পোটলাটা হাতে নিয়ে পা টিপে নি:শব্দে দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

তার পরক্ষণেই চা নিয়ে আসে মমতা। ঘরে ঢুকেই থমকে দাঁড়ায়। দ্যাখে, খোকন ঘরে নেই। বাথরুমে গলা টেনে দেখলো, সেখানেও নেই। হঠাৎ নজরে পড়ে, কাপড়ের সেই পোটলাটাও নেই। মায়ের অগোচরে কখন যে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল খোকন, টেরই পেলনা। -‘আশ্চর্য্য, খোকা আজ দানাপানি মুখে দিয়েই চলে গেল! যাবার পথে একবার দর্শণও দিলো না! কিন্তু পোটলায় বেঁধে খোকা কি নিয়ে গেল? কোথায় নিয়ে গেল?’

হাজার প্রশ্নের ভীঁড় জমে ওঠে মমতার। দু:শ্চিন্তায়-দুর্ভাবনায় একটা মুহূর্তও স্বস্তি পায় না।

মমতা সহজ সরল, সেকেলে মহিলা। সংস্কারপ্রবণ মন-মানসিকতা। স্বামী বিয়োগের পর একেবারে নরম হয়ে গেছে। কোন বিষয়েই তেমন গভীরভাবে ভাবতে পারেনা। অথচ তার আজ এক একটা মুহূর্ত্য কি অপরিসীম উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় অতিবাহিত হচ্ছে! মায়ের মন, সব সময় কু-ই গায়! বাস করে তার নিজস্ব জগতে। গ্রামের বাড়িতে শ্বশুড় কূলের ভিটে-বাড়ি সহ স্বল্প পরিমানে কিছু ধানি জমি ছিল, তাতে আনাচপাতির চাষ করে। সম্প্রতি হাঁস-মুরগীর পল্ট্রিও খুলেছে। সেখান থেকেও আমদানী হয় প্রচুর। সব মিলিয়ে উপার্জন যা হয়, তা দিয়ে মায়ে-পুতের দিব্যি স্বচ্ছলভাবেই চলে যায়। পয়সা কড়ির জন্য কখনো ভাবতে হয়না। এখন খোকনকে নিয়েই মমতার যতো চিন্তা-ভাবনা। অকাল বৈধব্যে একাকীত্বের শোক-দু:খ-বেদনা ভুলে, প্রাত্যহিক জীবনের পারিপার্শ্বিক কোন্দল-বিবাদ-বিচ্ছেদ-বেদনার কালো ছায়া থেকে দূরে সড়ে এসে এতকাল বুকে আলগে রেখে খোকনকে মানুষ করেছিল কি এই জন্য? মায়ের মনে কষ্ট দিতে বিবেকে ওর এতটুক বাঁধলো না? দু:শ্চিন্তায় মায়ের কি হাল হবে, একবার ভাবল না! কিন্তু আজ ও’ গেল কোথায়?

খোকন ছোটবেলা থেকেই ধীর-স্খির-গম্ভীর! বড্ড একরোখা ছেলে! অনমনীয় ওর জেদ। বিরল সেন্টিমেন্টাল। প্রতিটা বিষয়েই ওর বিরোধীতা, আপত্তি, অভিযোগ। প্রখর সংগ্রামী মনোভাব। যেদিন শহরের রাজপথে প্রথম ভাষা আন্দোলনের শুরুতে নবীন সদস্য আবদুল রশীদ বেকায়দায় পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে আত্মাহুতি দিয়েছিল, তাদেরই বন্দুকের গুলী বিদ্ধ করে। আর সেই ঘটনা জনগণের মনে বৈপ্লবিক চেতনার সাংঘাতিক বিস্ফোরণ ঘটেছিল। সেই বৈপ্লবিক বাতাবরণে আরো গভীরভাবে স্বাধীনতা বিপ্লবের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে খোকন। লোকের কানাঘুষোয় শোনা গেছে, -“খোকন বিপ্লববাদী স্বদেশী।”

তবু কখনও তেমনভাবে সন্দেহের দানা বাঁধেনি মমতার। বরং গর্ববোধ করতো মনে মনে। ভাবতো, স্বদেশী মানেই তো দেশকে ভালোবাসা, দেশের সেবা করা, দশের সেবা করা! আর জনগণের সেবা করা, সেটা তো একটা মহৎ কাজ! মহা পূণ্যের কাজ! কিন্তু আজ?

মমতা অশান্ত, উদ্বেলিত, মর্মাহত। ক্ষণপূর্বের গহীন বেদনানুভূতির তীব্র দংশণ আর ভোরের ভয়ঙ্কর দু:স্বপ্নের প্রতি:চ্ছবি তখনো ওর স্নায়ূকোষে ঘুরপাক খাচ্ছে। কখনো জীবন্ত হয়ে দেখা দিচ্ছে। তন্মধ্যে হঠাৎ অভাবনীয় খোকনের ব্যতিক্রম চাল-চলন, কথাবার্তা, বিবর্তন চেহারায় সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করে মমতার। ক্রমশ ঘনীভূত হতে থাকে। ভীষণ খটকা লাগল মমতার। প্রচন্ড ভাবিয়ে তুললো। নদীর ঢেউ-এর মতো বারবার একই প্রশ্ন ফিরে এসে আঘাত করতে লাগল হৃদয়ের গভীরে। -মায়ের চোখে ফাঁকি দিয়ে, মাকে ভাবনার সাগরে ডুবিয়ে, সম্পূর্ণ উপবাসে খোকা আজ গেল কোথায়?

সেই তখন থেকে চা-জল-খাবার নিয়ে বসেছিল মমতা। কিছুতেই মুখে ঢুকছে না। কখন থেকে কলিং বেলটা একটানা বাজজিল, এতক্ষণ খেয়ালই করেনি! হঠাৎ জানালার ধারে বসে থাকা হুলো বিড়ালটা মিঁয়াউ করে ডাক দিতেই চমকে ওঠে। বেলের আওয়াজ শুনে ভাবল, খোকা ফিরে এসেছে!

দৌড়ে গেল দরজা খুলে দিতে। কিন্তু দরজা খুলে দেখল, একটি অচেনা অজানা যুবতী মেয়ে দরজার ওপ্রান্তে দাঁড়িয়ে। ওর চোখে-মুখে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা।

ঘাবড়ে গেল মমতা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মেয়েটি বলল, -‘মাসিমা, আমি শান্তনা, খোকনের ক্লাসমেট্। কিছুক্ষণ আগে ওকে দেখলাম মনে হলো! গায়ে চাদর পড়া, রেললাইন ধরে খুব জোরে হেঁটে যাচ্ছিল! ও’ কোথায় গেল জানেন?’

ভয়ার্ত কণ্ঠে মমতা বলল,-‘কোথায় গেছে, তা তো জানিনা! বলছিল, ইউনিভার্সিটিতে যাবে! কি একটা জরুরী মিটিং আছে! কিন্তু যাবার সময়…!

-‘এ্যাঁ, ইউনিভার্সিটিতে গেছে!’ ভয়ার্ত চোখে তাকায় শান্তনা। কিছুক্ষণ থেমে বলল,-‘সর্বণাশ, আপনি আজ বেরুতে দিলেন কেন ওকে?’ বলে ধপ্ করে বসে পড়ে সিঁড়িতে।

এ যেন মরার উপর পড়ল খাড়া। চিন্তাধারার গতীবেগ আরো তিনগুণ বেড়ে গেল মমতার। অজানা আশáক্ষায় বুকের ভিতরটা ধুক্ধুক্ করে কাঁপতে থাকে! বিচলিত হয়ে ওঠে। ভয়-ভীতিতে বুক শুকিয়ে যাচ্ছে! চোখেমুখে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, মনে বিভীষিকা। হঠাৎ কাঁন্নাজড়িত কণ্ঠে চাপা আর্তনাদ করে উঠল,-‘কার কি সর্বণাশ হবে মা! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি নে!’

চোখ বড় করে তাকায় শান্তনা। বিরক্তির সুরে বলে,-‘কেন, আপনি শোনেন নি কিছু! ইউনিভার্সিটির চারপাশে সরকার এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে। নোটিশ দিয়েছে, ইউনিভার্সিটির ত্রিসীমানায় কোন মিটিং, মিছিল করা চলবে না। আজ গন্ডোগোল হওয়ার খুবই সম্ভাবনা আছে!’

শুনে আঁতকে ওঠে মমতা,-‘এ্যাঁ, বলো কি! কিসের মিটিং? কাদের মিটিং? মিছিল করবে কেন ওরা? এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা জারি করেছে, কেন? গন্ডোগোলটা হবে কিসের জন্য?’

অসন্তোষ গলায় শান্তনা বলল,-‘সেকি, খোকন কি আপনাকে কিছুই বলেনি! রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা করার দাবিতে ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই আন্দোলন করছে, আপনি জানেন না! আজ ওরা এক’শ চুয়াল্লিশ ধারা লঙ্ঘন করে শ্লোগান দিতে দিতে এসেম্বলীর দিকে যাবে। পুলিশ নিশ্চয়ই তখন লাঠিচার্জ করবে, কাঁদানি গ্যাস ছুড়বে, ব্যস, শুরু হয়ে যাবে গন্ডোগোল।’

বুক কেঁপে উঠল মমতার। ধপ্ করে বসে পড়ে সোফায়। অসহায়ার মতো বিষন্ন চোখে চেয়ে থাকে। কণ্ঠে হতাশার সুর। একটা ঢোক গিলে বলল, -‘তা’হলে কি হবে মা!’

-‘না, না, কি হবে, কিচ্ছু হবেনা! আপনি অযথা ভেঙ্গে পড়ছেন! আমি বলছিলাম, বিপদের কথা বলা যায়না তো! আর তাছাড়া, খোকন বিদ্যান, বুদ্ধিমান, চালাকচতুর ছেলে! আর যাই হোক, অন্তত ওর গায়ে কোনো আঁচড় পড়তে দেবে না! আপনি ওনিয়ে কিচ্ছু চিন্তা করবেন না মাসিমা। আমি দেখছি, কাউকে পাঠানো যায় কি না!’

শান্তনা চলে যেতেই ভারাক্রান্ত মনটা কিছুটা হাল্কা হলো মমতার। শারীরক ও মানসিক অবসাদ ঝেড়ে ফেলে স্বাভাবিক হয়ে উঠল। যথারীতিই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের কাজে।

ততক্ষণে বেলা প্রায় ন’টা বাজে। খোকন তখনও দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল, ইউনিভার্সিটির চারিদিকে পুলিশ পাহাড়া। ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই দলবেঁধে ইউনিভার্সিটির গেটের ভিতরে জটলা করছে। খুব হৈচৈ হচ্ছে সেখানে। মাঝে মধ্যে শ্লোগান শোনা যাচ্ছে, -“রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলা চাই, বাংলা চাই!”

খোকন চেষ্টা করল, ইউনিভার্সিটির পিছন গেট দিয়ে ঢুকতে। কিন্তু তারও উপায় নেই! সেখানেও ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ দাঁড়িয়ে। ততক্ষণে দলে দলে ছেলে-মেয়েরা মিছিল করতে করতে মেইন গেটের বাইরে চলে এসেছে। পুলিশ তক্ষুণি হামলা চালায় ওদের উপর। লাঠিচার্জ করে। ক’য়েক জনকে ধরে তুলে নিলো গাড়িতে। আর তারপরই শুরু হয়, হট্টোগোল, বিশৃঙ্খল, ভাগ-দৌড়। খোকন এলোপাথাড়ী চাদরের ভিতর থেকে ছুঁড়তে লাগল বারুদের গোলা। জ্বালিয়ে দিলো একটি পুলিশ ভ্যান। অন্যদিকে উত্তেজিত জনসমুদ্রের ক্রমাগত ঢেউ -এ ভেসে আসছে, শ্লোগানের তীব্র হুঙ্কার। পুলিশ ছুঁড়তে লাগল কাঁদানি গ্যাস। ছুটছে বন্দুকের গুলী। অনবরত ঘটছে একটার পর একটা হৃদ-কাঁপানো বোমা-বারুদের বিস্ফোরণ। চারিদিকে ধোঁয়া। ছাত্র-ছাত্রীরা দলভঙ্গ হয়ে আত্ম রক্ষায় ছুটতে লাগল, যার যার আপন গন্তব্যে।

যেন থমকে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীটা। গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। বৃষ্টিও পড়ছে গুঁড়িগুঁড়ি। মন-মেজাজটাও সকাল থেকে একদম ভালো নেই মমতার। তন্মধ্যে চতুর্দিক থেকে বজ্রপাতের মতো বোমা বাজীর আওয়াজে মনে হচ্ছে গায়ের উপরেই এসে পড়বে এক্ষুণি! এমন বিপর্যয়ে ছেলেটা কোথায় আছে, কি অবস্খায় আছে, এ চিন্তায় কিছুতেই স্বস্তি পায়না মমতা। বেরিয়ে আসে বারান্দায়। দেখল, একদল যুবক ছেলে কাকে যেন কাঁধে চেপে উর্দ্ধ:শ্বাসে দ্রুত এগিয়ে আসছে। ওদের পিছনে অগণিত মানুষ। খুব হৈ চৈ, চিল্লাচিল্লি হচ্ছে।

শুনে নগ্ন পায়েই দৌড়ে আসে শান্তনা। দৌড়ে আসে, পাড়া-প্রতিবেশী, বাচ্চা-বুড়ো-সবাই। মুহূর্তে ভীঁড় জমে গেল। যা ক্ষণপূর্বেও কল্পনা করেনি মমতা। কিন্তু আপনগর্ভে লালিত সন্তান আর মায়ের নারীর চিরন্তন বন্ধন, সে এক অদৃশ্য শক্তি, এক অবিচ্ছেদ্য গভীর টান! তাকে অবরুদ্ধ করে, সাধ্য কার! স্বয়ং বিধাতারও নেই! আর সেই অদৃশ্য বন্ধন শক্তির প্রভাবে মমতাকে বারান্দা থেকে টেনে নিয়ে আসে আঙ্গিনায়। যা নিজেও জানে না! আর তক্ষুণি কর্ণগোচর হয়, খোকনের নাম ধরে কি যেন বলছে ছেলেরা। নিশ্চয়ই খোকনদের বাাড়িই খুঁজজে ওরা। তবে কি খোকনের কোন অঘটন ঘটল? বুঝতে কিছুই আর বাকী রইল না মমতার!

বিদ্যুতের শখের মতো হৃদস্পন্দনে খুব জোরে একটা ধাক্কা লাগল। ওর ঠোঁট কেঁপে ওঠে, বুক কেঁপে ওঠে। র্থর্থ করে কাঁপে সারাশরীর! অনুভব্য হয়, পায়ের তলা থেকে মাটি যেন ক্রমশ সড়ে যাচ্ছে। জমে হীম হয়ে আসছে ওর সারাশরীর।

মমতা ভাবসাম্যহীন হয়ে পড়ে। স্খীর হয়ে আসে ওর চোখের দৃষ্টি। হঠাৎ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাটিতে উপুর হয়ে পড়তেই জড়িয়ে ধরে শান্তনা। ততক্ষণে চাদরে ঢাকা খোকনের রক্তাক্ত মৃতদেহটাকে শুইয়ে দিলো বারান্দায়। কারো মুখে কথা নেই। সবাই বাক্যাহত, বেদনাহত, মর্মাহত। বিমূঢ়-ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই। সবার চোখে জল। হঠাৎ ভীঁড়ের মধ্য থেকে একটি যুবক ছেলে এগিয়ে বলল, -‘কই, খোকনের মা কোথায়? ওনাকে ডাকুন!’

কিন্তু কোথায় খোকনের মা! তখন ও’ আর ওর মধ্যে নেই। সম্পূর্ণ উদ্মাদ। সমানে আবোল-তাবোল বকছে। কখনো আপনমনে বিড়বিড় করছে। শত চেষ্টা করেও ঘরের ভিতরে নেওয়া গেল না মমতাকে। খালি বলছে, -‘তোমরা কেউ দেখেছ আমার খোকাকে? ও’ কোথায় গেছে জানো? আমার খোকা এখনো ফিরে আসেনি! তোমরা দাঁড়িয়ে আছো কেন সবাই? চলে যাও! আমি তো বসে আছি এখানে।’

হঠাৎ মমতাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে শান্তনা। বিলাপ করে বলে,-‘খোকন আর ফিরে আসবে না মাসিমা! খোকন কোনদিনও আর আমাদের মাঝে ফিরে আসবে না!’

[ সমাপ্ত ]
যুথিকা বড়ুয়া : কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার ও সঙ্গীত শিল্পী।