রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা ॥ গৌরনদীর মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী ১৫ বছর ধরে কারাগারে ॥ মুক্তির দাবি

রাইখা দ্যাশটা স্বাধীন করছে। মুই রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের হক্কলডির ধারে কই, মোর স্বামীর এট্টাই দোষ আছিলো-হে বঙ্গবন্ধুরে ভালবাইসা হ্যার কতায় স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের জীবন বাজি রাইখা যুদ্ধ করছে। হেইয়ার পর থেইক্কা মোর স্বামী ও মোরা ঘরের সবাই নৌকায় ভোট দেই, এইডাই মোগো বড় অপরাধ। এইয়ার লাইগা ধানের শীষের ন্যাতারা মোর স্বামীরে ষড়যন্ত্র কইরা এট্টা মানুমারা কেচে দিছে। হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন-মোর নির্দোষ স্বামীরে ছাইড়া দ্যান। বলেই বাকরুদ্ধ হয়ে পরেন দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে কারাঅভ্যন্তরে থাকা বাংলার গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাসুদেবপাড়া গ্রামের ইসাহাক আলী পেয়াদা (মৃধা)’র স্ত্রী রওশন আরা বেগম (৫২)।
সরেজমিনে প্রত্যক্ষদর্শী এলাকাবাসি, এজাহার ও অভিযোগে জানা গেছে, গৌরনদী উপজেলার বাসুদেবপাড়া গ্রামের ওহাব আলী সরদার ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের উত্তাল মুহুর্তে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে নারী নির্যাতন, লুঠপাট, অগ্নিসংযোগসহ নির্মম হত্যাকান্ডের সাথে জড়িয়ে পরেন। ওইসময়ই স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে ওহাব আলী মারা যায়। দেশ স্বাধীনের পর তারই (রাজাকার ওহাব আলীর) পুত্র শাহ আলম সরদার স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের তার পিতার হত্যাকারী আখ্যা দিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় শাহ আলম একই এলাকার বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ বজলুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এক পর্যায়ে শাহ আলম সরদার সর্বহারা জিয়া গ্র“পের আঞ্চলিক নেতা রেজাউল করিম আকন্দের সাথে তার দলে যোগদান করে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, ডাকাতি, নারী নির্যাতনসহ সন্ত্রাসের রাম রাজত্ব কায়েম করে।
বাসুদেবপাড়া গ্রামের সিরাজ হাওলাদার (৬০) জানান, ৮০’র দশকে রাজাকার পুত্র শাহ আলম সরদার এলাকার একজন মুর্তিমান আতংক হয়ে দাঁড়ায়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৮০ সালে শাহ আলমের লোলুপ দৃষ্টি পরে একই গ্রামের মৃত মোনাছেব আলী বেপারীর স্ত্রী সুফিয়া বেগমের ওপর। ওই বছরেরই একদিন রাতে বিধবা সুফিয়ার ১২ বছরের একমাত্র সন্তান আব্দুর রব বেপারীকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে পুত্রের সম্মুখেই বিবস্ত্র করে শাহ আলম ও তার সহযোগীরা বিধবা সুফিয়াকে গণধর্ষণ করে। এতেই তারা ক্ষ্যান্ত হয়নি পাষন্ড নরপশুরা সুফিয়া বেগমের যৌনাঙ্গে ধারালো চাক্কু দিয়ে কুপিয়ে ক্ষত বিক্ষত করে। ওই সময় বিধবা সুফিয়া বেগম স্থানীয় প্রভাবশালীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন বিচার পায়নি। বিচার না পেয়ে এবং শাহ আলম ও তার সহযোগীদের হুমকির মুখে ছেলেসহ সুফিয়া দেশত্যাগ করে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় গিয়ে সুফিয়া তার ক্ষত বিক্ষত স্থানের চিকিৎসা করাতে না পেরে ধুকে ধুকে কয়েকদিন পরেই মারা যায়। এ সুযোগে বিধবা সুফিয়ার বাড়ি-ঘরসহ জমাজমি দখল করে নেয় শাহ আলম ও তার বোনজামাতা শামসুল হক ফরাজী।
ওই গ্রামের ছালাম মোল্লা (৫২) জানান, সুফিয়ার পুত্র আব্দুর রব বেপারীর বয়স যখন ২০ বছর ঠিক সেই সময় সে এলাকায় ফিরে এসে প্রতিশোধের নেশায় তার মায়ের ইজ্জত হরনকারী সর্বহারা জিয়া গ্র“পের প্রভাবশালী নেতা ও দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার শাহ আলমের দলেই যোগদান করে। ডাকাত শাহ আলমের দলের সকল প্রকার অপরাধমূলক কাজকর্ম করে রব অল্পদিনেই শাহ আলমের বিশ্বাসতা অর্জন করে। এরইমধ্যে মায়ের ইজ্জত হরনের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রব সুযোগ খুঁজতে থাকে।
দুর্ধর্ষ সর্বহারা নেতা ও ডাকাত সর্দার শাহ আলমের বোন জয়তুন নেছা (৫৫) বলেন, কবরে এক পাও চইল্লা গ্যাছে, মিথ্যা কতা কমু না, হেইদিন (১৯৮৮ সালের ৫ নবেম্ভর বিকেল চারটার দিকে) মোগো জমির আমন ধান রব কাইড্যা লইয়া যাইতাছে, এই খবর পাইয়া মুই আর মোর ভাই শাহ আলম সরদার ভুইর (জমির) দিকে যাইতে আছিলাম। মোর আগে ভাই শাহ আলম দৌড় দিয়া সামনে যাওয়ার সাথে সাথে রব বেপারী এট্টা গাছকাটা দাও দিয়া মোর ভাইর মাথায় কোপ দিয়া মস্তক বাইর কইরা হালায়। সাথে সাথে মোর ভাই শাহ আলম ভূইর মধ্যে হুইয়া পইরা মইরা (মারা) যায়। মুই সামনে যাওয়ার আগেই রব দৌড়াইয়া পলাইয়া যায়। তিনি আরো বলেন, মোর ভাইর খুনী হইছে রব বেপারী। খুনের সময় ইসাহাক মাষ্টার (মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী মৃধা) আছিলোনা। আদালতেও মুই এই একই কতা কইছি। যতদিন বাঁইচ্চা আছি সত্য কতা কইয়াই যামু।
স্থানীয়দের অভিযোগে জানা গেছে, শাহ আলম খুনের ঘটনায় সর্বহারা জিয়া গ্র“পের আঞ্চলিক নেতা ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতা রেজাউল করিম আকন্দ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে নিহত শাহ আলমের ভাই আঃ সোবহান সরদারকে বাদি করে গৌরনদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে (যার নং-৯০/৯১)। ওই মামলায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুল শিক্ষক ইসাহাক আলী পেয়াদা (মৃধা)সহ ১১ জনকে আসামি করা হয়।
বাসুদেপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা (মুক্তি বার্তার ১৪৪ পৃষ্টায় ক্রমিক নাম্বার-০৬০১১০০২৭৮) ইসাহাক আলী পেয়াদা (মৃধা)’র বড়পুত্র দিনমজুর ইসমাইল মৃধা (৩৭) জানান, রবের হাতে যখন ডাকাত শাহ আলম খুন হয় তখন তার বাবা স্কুলে কর্মরত ছিলেন। যার একমাত্র প্রমান বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এরপরেও রহস্যজনক কারনে তাকে (আমার পিতা ইসাহাক আলীকে) শাহ আলম হত্যা মামলায় জড়ানো হয়। তিনি আরো জানান, মামলা দায়েরের পর ১৯৯৪ সালে তার পিতা মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী পেয়াদা (মৃধা) আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। বিচারক তার আবেদন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে আদালতে স্বাক্ষীদের স্বাক্ষ প্রমানে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী নির্দোষ প্রমানিত হলেও অদৃশ্য কারনে ১৯৯৬ সালের ৩০ আগস্ট বরিশালের দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ মমিন উল্লাহ শাহ আলম হত্যা মামলার ১১ নাম্বার আসামি মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীসহ ওই মামলার ৯ জন আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন। পরবর্তীতে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টের শরনাপন্ন হয়েও ব্যর্থ হন।
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর মেঝ পুত্র টুটুল মৃধা (৩৫) বলেন, শাহ আলম খুনের সময় আমার পিতা স্কুলে কর্মরত ছিলেন। যার প্রমান হিসেবে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, উপজেলা সহকারি শিক্ষা অফিসার ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি লিখিতভাবে জানানোর পরেও আদালত তা প্রমানিত ভাবে গন্য করেননি। তিনি আরো বলেন, মামলার চার্জশীট প্রদানের সময় তৎকালীন গৌরনদী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাদের কাছে মোটা অংকের টাকা উৎকোচ দাবি করেন। এ ব্যাপারে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত অভিযোগ দেয়া হলে ওসি ক্ষিপ্ত হয়ে তার মনগড়া ভাবে চার্জশীট তৈরি করে আদালতে প্রেরন করে। যার নিষ্ঠুরতার স্বীকার আমার মুক্তিযোদ্ধা পিতা ইসাহাক আলী। পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পেয়ে তৎকালীন থানার ওসিকে সাসপেন্ডও করেছিলেন। তিনি আরো বলেন, বাদি পক্ষের লোকজন আদালতের কতিপয় অসাধু কর্মচারীদের সহায়তায় আমাদের গুরুতপূর্ণ কাগজপত্র মামলার নথি থেকে গায়েব করে ফেলেছে। পরবর্তীতে আমরা আদালতের কাছে আমাদের পিতার নির্দোষিতা প্রমান করার জন্য সময় প্রার্থনা করলে বিচারক সেই সুযোগ না দিয়েই তড়িঘড়ি করে রায় প্রদান করেন।            
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর ছোট পুত্র মিজানুর রহমান (৩২) জানান, শাহ আলম হত্যা মামলার প্রধান আসামি কাঞ্চন আলী পেয়াদা (মৃধা)’র পুত্র মামুন পেয়াদা প্রভাবশালী বিএনপি নেতা হওয়ায় বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে স্থানীয় সাবেক সাংসদ জহির উদ্দিন স্বপন তদবির করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে দিয়ে রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় হত্যা মামলার ১ নাম্বার আসামি কাঞ্চন আলী পেয়াদা (মৃধা)’কে বেকসুর খালাস করে আনেন। তিনি আরো জানান, তাদের মুক্তিযোদ্ধা পিতার মুক্তির জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতির কাছে সাধারন ক্ষমার আবেদন পত্র লিখে স্থানীয় বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপনের সুপারিশ আনার জন্য গেলে সাংসদের সহযোগী সর্বহারা জিয়া গ্র“পের আঞ্চলিক নেতা রেজাউল করিম আকন্দের রোষানলে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়ার অপরাধে সে আবেদনে আর সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন সুপারিশ করেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শাহ আলম হত্যা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আরেক আসামি খুনী রব বেপারীর শশুড় মঙ্গল খান (৮৫) কারাঅভ্যন্তরে বিভিন্নরোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত মঙ্গলবার (৮ ডিসেম্বর) সকালে মারা যান।   
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর অসহায় স্ত্রী রওশনআরা বেগম জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তার ৮৩ বছর বয়স্কা মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুল শিক্ষক স্বামী ইসাহাক আলী পেয়াদা (মৃধা) বরিশালের কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাভোগ করছেন (কয়েদি নাম্বার-১৯৪৩/এ)। ষড়যন্ত্রমূলক ভাবে সাজানো মামলায় ৮৩ বছর বয়স্কার পক্ষে জেলখাটা এখন কোন রকমই সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরো জানান, তার স্বামী ইসাহাক আলীর অনুপস্থিতে দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনি তার ৩ পুত্র ও ১ কন্যাকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ও বয়সের কথা বিবেচনা করে তিনি তার স্বামীকে রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় মুক্তি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি করেছেন।
শুধু মুক্তিযোদ্ধার পরিবারই নয় বাসুদেবপাড়া গ্রামের সর্বস্তরের জনসাধারন ও গৌরনদী উপজেলার মুক্তিযোদ্ধারা মহান বিজয় দিবসে রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় বাংলার গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী পেয়াদা (মৃধা) কে মুক্তি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে জোড় দাবি জানিয়েছেন।