ধ্বংষের মুখে সম্ভাবনাময় বেনারশী পল্লী

বিদ্যুতের অভাবে এখন আর আগের মত সেই শব্দ শোনা যায় না। ইতোমধ্যে অনেকেই বিদ্যুতের অভাবে পেশা পরিবর্তন করেছেন। ফলে এ পেশায় নিয়োজিত শতাধিক পরিবার বর্তমানে বেকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

সরেজমিনে গিয়ে এলাকাবাসির সাথে আলাপকালে জানা গেছে, পয়সারহাট গ্রামের মৃত মিলন খানের পুত্র হুমায়ুন খান (৩৫) ঢাকার মিরপুর ১০ নাম্বারের একটি বেনারশী কারখানায় ১৪ বছর শ্রমিকের কাজ করেন। একপর্যায়ে হুমায়ুন নিজ এলাকার গ্রামীণ নারীদের বেনারশীর স্বাদ দিতে ২০০৪ সালে ধারদেনা ও ব্যাংক থেকে ঋণ উত্তোলন করে কয়েক লক্ষ টাকা ব্যয়ে নিজ বাড়িতে ৫টি বেনারশীর তাঁত মেশিন বসান। বছর যেতে না যেতেই ক্রমেই তার কাজের সুনাম ছড়িয়ে পরে। তার দেখাদেখি পাশ্ববর্তী বাড়িতে একাধিক বেনারশীর তাঁত মেশিন স্থাপন করা হয়। একপর্যায়ে পয়সারহাট গ্রামটি বেনারশী পল্লী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। হুমায়ুনের তৈরিকৃত বেনারশী শাড়ি চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকাসহ গৌরনদী ও পাশ্ববর্তী এলাকার পাইকাররা এসে নিয়ে যেতো। তার একেকটি শাড়ি তৈরিতে প্রায় ৩ হাজার টাকা খরচ হলেও বাজারে বিক্রি করা হতো ৫ থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত।

হুমায়ুন জানান, আমদানি নির্ভর বেনারশী শিল্পের কাঁচামাল পাকিস্তান ও কোরিয়া থেকে সংগ্রহ করা হতো। বেনারশীর তাঁত মেশিন বসিয়ে শাড়ি তৈরির সময় পাশ্ববর্তী বাড়ি থেকে বিদ্যুতের সাইড লাইন আনা হয়। ব্যবসায়ীক প্রতিযোগীতার কারনে কয়েকদিন পর বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়। একপর্যায়ে তিনি পল্লী বিদ্যুতের গৌরনদী জোনাল অফিসে নতুন সংযোগের জন্য আবেদন করেন। কর্তৃপক্ষ বিদ্যুতের খুঁটিস্থাপন করলেও রহস্যজনক কারনে গত এক বছরেও সংযোগ দিচ্ছেন না। শাড়ির নকশা, ডিজাইন ও চুমকি বসাতে একান্তই বিদ্যুতের প্রয়োজন। বিদ্যুৎ না থাকার কারনে কাজ কমে যাওয়ায়  কর্মচারীরা চাকুরি ছেড়ে অন্যপেশায় জড়িয়ে পরেন।

ঢাকার বাবুবাজারের পাইকার সুভাষ মন্ডল জানান, ভারতের বেনারশীর শাড়ির চেয়ে হুমায়ুনের বেনারশীর গুনগতমান অনেক ভাল, তাই ক্রমেই ক্রেতা বিক্রেতারা হুমায়ুনের বেনারশী শাড়ির ওপর আস্তা রাখছেন। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী শাড়ি সরবরাহ করতে না পারায় বিকল্প হিসেবে অন্যকোন স্থান থেকে শাড়ি আমদানি করা হয়। 
শাড়ি ক্রয় করতে আসা আগৈলঝাড়ার নগরবাড়ি গ্রামের গৃহবধূ মিসেস সাথী রহমান বলেন, বাহারি শাড়ি পছন্দ করেন না এমন বাঙ্গালি নারী খুঁজে পাওয়া যায় না, শাড়িতেই ফুটে ওঠে বাঙ্গালি নারীর প্রকৃত রুপ। অভিজ্যাতের প্রতিক হিসেবে বেনারশী শাড়ির প্রচলনও এদেশে অনেক আগ থেকেই। সে সময় অনেকের ভাগ্যে বেনারশী শাড়ি জুটতোনা বলেই আটপৌরে শাড়িতে জীবন বাঁধা নারীর কাছে বেনারশী ছিল একটি স্বপ্ন। শুধু বাঙ্গালীই নয়, বিশ্ব ললনারাও এর শিল্পের সুষমায় মোহিত। হুমায়ুনের বাহারি ডিজাইনের বেনারশী শাড়ি রয়েছে গ্রামীণ নারীদের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে।

হুমায়ুন জানান, ২০০৩ সালে ঢাকার টিএ্যান্ডটি মাঠে অনুষ্ঠিত তাঁত বস্ত্র মেলায় তার বেনারশী শাড়িতে বাহারি কাজ করে ৪২ হাজার টাকায় বিক্রি করায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রি তাকে পুরস্কৃত করেন। আত্মনির্ভরশীল হুমায়ুন আক্ষেপ করে বলেন, আমি সরকারি ও বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা চাইনা। শুধুমাত্র বিদ্যুতের সমস্যায় আজ এ শিল্পটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। নানা প্রতিকুলতার মাঝে প্রাণপন চেষ্ঠা চালিয়ে সম্ভবনাময় এ শিল্পকে বাঁচাতে ও সম্প্রসারন করে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করার জন্য তিনি বেনারশী পল্লীতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উধ্বর্তন কর্মকর্তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছেন। নতুবা সম্ভবনাময় এ শিল্পটি অচিরেই বিদ্যুতের অভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে।