গান্ধী পরিবারের হাত ধরে ভারতে রাজতন্ত্রই ফিরে এসেছে – রিয়া

নেই, কিন্তু গণতন্ত্রের লেবেল লাগিয়ে রাজতন্ত্র আছে ভারতে। বিগত ইউপিএ-১ সরকারের আমল থেকেই আছে। এখন ইউপিএ-২ সরকারের আমলেও বহাল তবিয়তে রাজতন্ত্র কায়েম আছে ভারতে। লুকিয়ে লুকিয়ে আগেও ছিলো। সত্যি বলতে কি, স্বাধীনতার দিন থেকেই ছিলো। জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীদের হাত ধরেই দিনে দিনে পাকাপোক্ত ভাবে বাসা বেঁধে নিয়েছে রাজতন্ত্র।

nehru and indira

 

এই রাজতন্ত্র কায়েমে সাহায্য করেছেন ভারতের প্রচুর নামীদামী রাজনীতিবিদ। কিভাবে ভারতে রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে সেই বিষয়টা বেশ লক্ষ্য করার মতোই। ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রে জনতার রায়ে নির্বাচিত হন প্রতিনিধিরা। সেই প্রতিনিধিরা মিলেমিশে তাদের দলের নেতা বেছে নেন। হিসেবটা শুনতে বেশ ভালোই, তবে এই গণতান্ত্রিক উপায় ধরেই রাজতন্ত্র কায়েম হয়েছে ভারতে। কংগ্রেস দলের হাত ধরে।

 

নেহেরু, গান্ধী এদের নেতৃত্বে অনেক প্রভাবিত হয়ে কংগ্রেস দলের অন্যান্য নেতারা অলিখিতভাবে চিরকালের জন্য গান্ধী পরিবারকেই নেতৃত্বের সর্বোচ্চ উপযোগী ভেবে নিয়েছেন। ১৯৮৪ সালের ৩১’শে অক্টোবর তারিখে সকালে ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর গুলিতে নিহত হওয়ার পরে পরেই কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত হয়েই যায় যে তাঁর সন্তান শ্রী রাজীব গান্ধীই হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।

 

ঘটনার দিন রাজীব ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে সফররত। মা আততায়ীর গুলিতে আহত, তিনি সেই খবর পান হেলিকপ্টারে বসা অবস্থায়। তাঁকে সেই হেলিকপ্টারেই উড়িয়ে আনা হয় দমদম বিমানবন্দরে, সেখান থেকে সোজা দিল্লিতে আনা হয় তাঁকে। যে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে আততায়ী গুলি করে, তাতেই বোঝা গিয়েছিল যে ইন্দিরা আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই। নতুন দিল্লির AIIMS হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, দেশের মানুষ যখন এই কথাই জানে, তখন সকাল ১০-১০’শে বিবিসি ঘোষণা করে দিয়েছে ইন্দিরা মৃত। ভারত সরকার সেই সংবাদ জানিয়েছে সন্ধ্যাবেলায়।

 

দিল্লিতে সারা দিনভর চলেছে রাজনৈতিক চাপানউতোর। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিং বেশ কয়েকবার মিটিং করেন রাজীবের সঙ্গে। রাজীবের স্ত্রী সোনিয়া আপত্তি করেছিলেন স্বামীর প্রধানমন্ত্রীত্বের ব্যাপারে। অবশেষে AIIMS-এর এক কক্ষে রাজীব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে রাজী হয়ে যান, কারন ভারতের তখন একজন নেতার প্রয়োজন, রাষ্ট্রনেতার গদি বেশীক্ষণ ফাঁকা ফেলে রাখা সম্ভব ছিলোনা।

 

indira, rajiv and sanjay gandhi

 

সেই রাজীবও একদিন আততায়ীর আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ হারালেন। অনেক সকালে খবর এলো রাজীব’জী আর নেই। ১৯৮৪ সালের সেই ৩১’শে অক্টোবর তারিখের মতোই এবারেও সেই ১৯৯১ সালের ২১’শে মে তারিখে ভারত তোলপার হলো।

 

না, সেবার আর গান্ধী পরিবারের কেউ উপযুক্ত বয়সে ছিলেন না প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য। সোনিয়া রাজী হলেননা। কারন পুত্র রাহুল ও কন্যা প্রিয়াঙ্কার খুবই অল্প বয়স। আর, ততোক্ষণে সোনিয়া বুঝে গেছেন যে পরিবারের দুইজন নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে, একই পরিনতি হয়তো তার এবং তার সন্তানদের ভাগ্যেও আছে। কে জানে! কে বলতে পারে!

 

কিন্তু না, থেমে যায়নি কংগ্রেস নেতাদের প্রচেষ্টা। মাঝে অন্যান্য নেতারা কিছুদিনের নেতৃত্ব দিলেও সোনিয়ার উপরে যথেষ্ট চাপ ছিলো যাতে উনি রাজনীতিতে আসেন, সাথে পুত্র রাহুলকেও ভারতের রাজসিংহাসনের জন্য উপযুক্ত করে তোলার চাপ ছিলো। এইভাবে পরে একদিন সোনিয়া’জী এলেন রাজনীতিতে, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হয়ে। এই নিয়ে চতুর্থবার তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের পদে নির্বাচিত হলেন।

 

বুঝতেই পারছেন, কেউ প্রতিদ্বন্দীতাই করছেননা। কেন? কারন একটি রাজনৈতিক ছাতার নিচেই সব কংগ্রেস নেতারা নিশ্চিন্তে একটি ব্র্যাণ্ডনেম বানিয়ে রাজনৈতিক শাসন চালিয়ে যেতে চান। এটাই রাজনন্ত্র কায়েমের পথে এগিয়ে চললো। আর হ্যাঁ, এখন সেইদিনের ছোট্ট রাহুল বড় হয়েছেন, প্রিয়াঙ্কাও বিয়ে করেছেন। প্রিয়াঙ্কা রাজনীতিতে না এলেও রাহুলকে সযত্নে রাজনীতিতে আনা হলো। সাথে এও নিশ্চিত করা হলো যাতে উনি সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন।

 

অবাক হচ্ছেন? সোনিয়া কিন্তু রাজীবের সংসদীয় কেন্দ্র থেকে নির্বাচন লড়েই জিতেছেন। সেই নির্বাচনী কেন্দ্রেই রাহুলকেও দাঁড় করানো হলো এবং বহু বছরের পারিবারিক কেন্দ্রের সুবিধা নিয়েই রাহুলকেও জেতানো হলো। সোনিয়া সেই কেন্দ্র ছেড়ে দিলেন ছেলের জন্য। ধীরে ধীরে বেসরকারী ভাবে রাহুলকে crown prince of India নামেই পরিচিত করানো শুরু হয়ে গেলো। এইজন্যই ‘রাজসিংহাসন’ কথাটা লিখেছি উপরে। আগেকার দিনে ঠিক যেমন করে রাজার ছেলে রাজপুত্র অভিষেক হতো, সেইভাবেই রাহুলকেও ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রচার শুরু হয়ে গেলো।

 

রাহুল জনদরদী দেশনেতা, এইটা প্রচারের জন্য চললো নানা মজাদার খেলা। দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জাতির সুতা ধরেই এগোনোর চিরকালীন নিয়ম গণতন্ত্রে। রাহুলের ক্ষেত্রেও একই পথ অনুসরণ করা হয়েছে। রাহুল নিজে কিছুই করেননি, তাকে চালিত করা হয়েছে জনপ্রিয়তার পথে। তাই রাহুল হঠাৎ করে চলে যান দরিদ্রদের কুঁড়েঘরে, সেখানে তিনি নাটক করে রাত কাটান, তাদের রান্না করা খাবার তিনি খান, তাদেরই খাটিয়াতে তিনি বিশ্রাম নেওয়ার পাবলিসিটি করেন।

 

এইসবই রাজতন্ত্র কায়েমের উদ্দেশ্যেই। ইউপিএ-১ ও ইউপিএ-২ এই দুই সরকারেই তাকে মন্ত্রীত্বের ডাক দেওয়া হয়। রাজপুত্র রাজী হননি। আসলে সেটাও গেমপ্ল্যান। এইটা দেখানো যে উনি মন্ত্রীত্বের লোভী নন। উনি জনদরদী। তার এখন অনেক কাজ। কাজ মানে ওইসব নাটকের অভিনয়ের কাজ। তাই এখন ওনার মন্ত্রীত্ব করার মতো সময় নেই।

 

অন্যদিকে আসল কাজ চালিয়ে যাবেন তার মা সোনিয়া এবং কংগ্রেসের বড় বড় নেতারা যেমন মনমোহন সিং, প্রণব মুখার্জ্জী, পি. চিদাম্বরম, এ.কে. এ্যন্টনীরা। আরোও আছে, সব নাম করতে গেলে আরেকটা ব্লগ বানাতে হবে!

 

অনেক তো কথা হলো! রাজপরিবারের বাসভবনের কথা হোক একটু? জানেন দিল্লিতে এরা যে বাংলোতে থাকেন, সেই বাংলোর দাম কতো? দুই বছর আগের হিসাব অনুযায়ী গান্ধী পরিবারের বাংলোর দাম ২০৬ কোটি টাকা। প্রধানমন্ত্রীর বাংলোর দামও এর চেয়ে কম, ১৯০ কোটি টাকা। এই রাজপ্রাসাদেই এসে হাজিরা দেন তাবর তাবর নেতারা। এখানেই বসে রাজদরবার। তবে হ্যাঁ যেহেতু এইটা গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বানানো রাজতন্ত্র, তাই এখানে প্রজার প্রবেশ নিষেধ, এখানে আসতে পারেন কেবল প্রজাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই। তাও সবাই না! ‘হাই কম্যান্ড’-এর খুব কাছের লোকরাই আসতে পারেন এখানে।

 

এই রাজপরিবার ভারতে বিশেষ নিরাপত্তা পান। না আমি জেড সিকিউরিটি কিম্বা জেড প্লাস ক্যাটাগরির সিকিউরিটির কথা বলছিনা। অন্যান্য রাষ্ট্রনেতাদের জন্য যে সিকিউরিটি প্রোটোকল আছে, ঠিক সেই প্রোটোকল এদের ক্ষেত্রেও পালন হয়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, ভারতের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত উচ্চস্তরের মন্ত্রীরাও যে প্রোটোকলের নিরাপত্তা পাননা, এরা সেটাই উপভোগ করেন। এর পরেও গরীবদের কুঁড়েঘরে দুইদিনের নাটক করতে হাজির হয়ে যান রাজীব।

 

rahul gandhi

 

আরও হাস্যকর সব প্রসঙ্গ আছে। এদের তামাশার গল্প করতে গেলে এই একটা ব্লগ পোস্ট যথেষ্ট নয়। তবুও সামান্য বলি। ২০০৯ সালের নির্বাচনে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির হিসাবে সোনিয়া জানিয়েছেন তার বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, এবং ব্যাংকে টাকার পরিমান শুনলে সবাই কেঁদে ফেলবে কারন তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আমার আপনার একাউন্টে আছে। রাহুল, তিনিও জানিয়েছেন প্রায় একই কথা, তবে তিনি সামান্য সৌজন্য প্রকাশ করেছেন এই বলে যে দিল্লিতে তার দুইটি দোকান আছে।

 

আসলেই এদের বাড়ি গাড়ি কিছুই নেই। কারন সবটাই ভারতের জনতার টাকায় চলছে। এই ছিলো সামান্য গল্প, যেবভাবে ভারতে গণতন্ত্রের নামে কার্যত রাজতন্ত্রই কায়েম হয়ে গেছে। আগামী দিনে আরো অনেক খোরাক মিলবে এদের কার্যকলাপে। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে ভারতীয়রা সব জেনেও কিছুই করতে পারছেনা বা করছেনা।


লিখেছেন- রিয়া, নিউ আলীপুর, কোলকাতা, ইন্ডিয়া