মাফিয়া চুন্নি যেভাবে কোটিপতি

এখন সে রাজধানী ঢাকার মাদক সম্রাজ্ঞী। সবুজবাগ-খিলগাঁওয়ের আতঙ্ক। আর এভাবেই হয়ে ওঠে কোটিপতি। প্রয়োজন হলে খুন, গুমও করতে দ্বিধা করে না। এজন্য অস্ত্র বেচাকেনায়ও হাত পাকিয়েছে সে। রয়েছে তার ভাড়াটে খুনিও। অস্ত্র, মাদক সংক্রান্ত গুরুতর অভিযোগে বিভিন্ন থানায় মামলাও হয়েছে। অপরাধ জগতে চুন্নির উত্থান চুরি দিয়ে। চুরি দিয়ে শুরু করলেও সবুজবাগের লোকজন তাকে সমীহ না করে চলার উপায় নেই। তার নৈরাজ্যের প্রতিবাদ করায় ঈদের দিন রাতে প্রাণ দিয়েছেন সাবেক ব্যাংকার মাহফুজুল হক খান। চুরির টাকায় এখন সে সম্পদশালীও। চুরি রপ্ত করতে করতে সে এক সময় জড়িয়ে পড়ে অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায়। এভাবেই হয়ে ওঠে আসল মাফিয়া চুন্নি।


৩৫ বছর আগে কুমিল্লার মেঘনা থানার মালিহিল গ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিল চুন্নি। প্রথমে শুরু করে কাজের বুয়া সাপ্লাইয়ের কাজ। বুয়া সাপ্লাই দিতে গিয়েই সে চুরিতে হাত পাকায়। তার দেয়া কাজের বুয়াদের মাধ্যমেই নিয়মিত খবরাখবর নিতো বিভিন্ন বাসার। এভাবে শুরু হয় বাসাবাড়িতে চুরি। উত্তরা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার থেকে মতিঝিল, খিলগাঁও, সবুজবাগ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে চুরি। এ চুরি থেকে দেদারছে টাকা আসায় সে পরিচিত কাজের বুয়া ছাড়াও অপরিচিত কাজের বুয়াদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। তাদেরও নিয়ে আসে তার নেটওয়ার্কে। এভাবে চুরি এক সময়ে তার কাছে ডাল-ভাত হয়ে ওঠে। বাসায় ঢুকে সোনাদানা, গয়নাগাটি, ঘটি-বাটি, টাকা-পয়সা, কাপড়চোপড় মুহূর্তের মধ্যে সরিয়ে ফেলে। আত্মীয়-স্বজনের বাসাবাড়িতে গিয়েও চুরি করতো সে। সবুজবাগ থানা ছাড়াও খিলগাঁও, মোহাম্মদপুর ও মতিঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে অনেক চুরির মামলা আছে বলে জানান সবুজবাগ থানার ওসি এজাজ শফি। এজাজ শফি বলেন, মাফিয়া চুন্নি ধুরন্ধর চোর। সে হাত দিলেই তালা খুলে যায়। তিনি জানান, আমি মতিঝিল থানায় এসআই থাকার সময় তাকে ৪০ ভরি সোনাসহ আটক করেছিলাম। তখন থেকেই আমি তাকে চিনি। ২০০৮ সালের ৭ই জুন তাকে ৩ মাসের ডিটেনশন দেয়া হয় সবুজবাগ থানার বিভিন্ন মামলা ও জিডির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়। এ ছাড়া ২০০৬ সালে ৩৬৬ পূর্ব গোরান থেকে মাদক, বিস্ফোরক ও অস্ত্রসহ খিলগাঁও থানা পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। এভাবে একের পর এক মামলায় তাকে জেলহাজতে পাঠানো হলেও সে জামিনে বেরিয়ে আসে। ৪ মাস না যেতেই সে এসব মামলা থেকে জামিনে মুক্তি পায় বলে পুলিশ জানায়। এ ছাড়া সে সবুজবাগ থানা এলাকায় একবার গোলাগুলি করে পুলিশের হাতেও ধরা পড়েছিল। এ রকম তার বিরুদ্ধে সবুজবাগ থানায় মামলা আছে ১৫টি। তবে মাফিয়া চুন্নিকে কোন মামলাতেই ২-৩ মাসের বেশি জেলে রাখা সম্ভব হয়নি। এসআই এজাজ শফি জানান, এ পর্যন্ত তাকে অন্তত ২০ বার জেলে দেয়া হয়। কোন লাভ হয়নি।

যে কারণে কারাগারে রাখা সম্ভব হয় না চুন্নিকে
সবুজবাগ এলাকা ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ ও র‌্যাবের অনেক বড় কর্মকর্তাই মাফিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল। এমনকি মাফিয়ার অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য সবুজবাগ এলাকাবাসী অনেক সময় তাকে গণপিটুনি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল। এ খবর পেয়ে সবুজবাগ থানা পুলিশ তার জন্য র‌্যাবের সহায়তায় পাহারা বসিয়েছিল। সূত্র জানায়, ১/১১-এর পরে তার বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালান র‌্যাব-৩ এর তৎকালীন সিও সুলতান মাহমুদ নুরানী। এ অভিযানে তাকে কোণঠাসা করা হলেও গোপনে র‌্যাবের অনেক কর্মকর্তার সঙ্গেও হাত করে ফেলে চুন্নি। এরপর থেকে আরও দুর্ধর্ষ হয়ে ওঠে মাফিয়া চুন্নি। সূত্র জানায়, সবুজবাগ থানার অনেক পুলিশ কর্মকর্তা বদলি হওয়ার পরও চুন্নিকে সহায়তা দেয়ার জন্য বদলি বাতিল করে আবার সবুজবাগ থানায় ফেরত আসেন। এভাবে পুলিশ ও র‌্যাবের মধ্যেও বিশাল নেটওয়ার্ক তার। অস্ত্র, মাদক, চুরির জন্য আছে একেকটি বাহিনী। ৩ শতাধিক সদস্য নিয়ে বাহিনী চলে। আছে অনেক মহিলা সদস্যও। এরা সবুজবাগের দীপশিখা স্কুল থেকে শুরু করে মাদারটেক, উত্তর বাসাবো, কদমতলা পর্যন্ত টহলে থাকে। রাত হলেই শুরু হয় তার বাহিনীর অপরাধের ঝাঁপি খোলা। বিভিন্ন স্পটে ইয়াবা বিক্রি থেকে শুরু করে গ্যাং র‌্যাপ সবকিছুই ঘটে রাতের সবুজবাগে। ভয়ে এলাকার মানুষ মুখ খুলতেও পারে না। ডানে বাঁয়ে মোড়ে মোড়ে ইয়াবার ছড়াছড়ি। ব্যাংকার হত্যার ঘটনায় চুন্নিকে অস্ত্র ও ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে পুলিশ। থানায় ৪ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। থানায় বসে চুন্নি এ প্রতিবেদককে বলেছে, আমি কাউকে খুন করিনি। লোকটি অসুস্থ ছিল, তাই মারা গেছে। নিহত শিল্পপতি ও ব্যাংকার মাহফুজুল হকের ছেলে রিয়াজ জানান, বিচার পাব কিনা সন্দেহে আছি। আতঙ্কেও আছি।

মাফিয়া চুন্নির বাহিনী
মাফিয়া চুন্নি অপরাধ সাম্রাজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছে তার গোটা পরিবারকে। নিজের ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে তো আছেই। এরপর দূর সম্পর্কের যারা আত্মীয়-স্বজন আছে, তাদের কাউকে বাদ দেয়নি। দীপশখা স্কুলের পর থেকে যেসব দোকানপাট আছে সেখানে প্রায় দোকানদার তার বাহিনীর লোক বলে সূত্র জানায়। তাদের মাধ্যমে এলাকায় কি হচ্ছে, না হচ্ছে সব খবর পৌঁছে যায় মাফিয়া চুন্নি ও তার ৩শ’ সদস্যের কানে। তাদের সঙ্গে থাকে পুলিশের সহযোগিতা। ৩ শতাধিক সদস্যের বাহিনীর মধ্যে দেড় শতাধিক বেতনভুক্ত বলে জানা গেছে।

অপরাধের ধরন-

রাতে গার্মেন্টস ছুটির পর মেয়ে শ্রমিকরা বাসায় ফেরার পথে তাদের টাকা কেড়ে নেয়া, টাকা না দিলে এসব মেয়েদের পার্শ্ববর্তী শাহ আলমের প্রজেক্ট, ৩৬ নম্বর উত্তর বাসাবোর পেছনের গ্যারেজ, আলাউদ্দিন পার্কে নিয়ে গ্যাং র‌্যাপ করারও অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে পথে পথে বিক্রি হয় ইয়াবা। কেউ ১০ পিস ইয়াবা বেচতে পারলে ৩টি ফ্রি দেয়া হয়। এ ৩টি ফ্রি ইয়াবা দিয়ে নানা অপরাধ করে রাতের আঁধারে। রাতের বেলা এসব অপরাধে কেউ টুঁ শব্দ করলেই নেমে আসে মহাবিপদ। এভাবেই প্রাণ দিয়েছেন সাবেক ব্যাংকার ও শিল্পপতি মাহফুজুল হক। আসলে এ অপরাধের মাধ্যমে রাতের বেলা মাফিয়া বাহিনীকে বিনোদনের সুযোগ করে দেয়া হয়। এ ফাঁকে চলে মাদক ব্যবসা। বড় মাদকের চালান এলাকার এক স্থান থেকে অন্যস্থানে পাঠানো হয় হরহামেশাই। এ জোনের মধ্যে ২০-২৫টি থানা এলাকা রয়েছে। সূত্রমতে, একটি ইয়াবার বিক্রি মূল্য ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। এভাবে প্রতিদিন কয়েক হাজার পিস ইয়াবা বিক্রি করে বলে সূত্র জানায়। শুধু মাফিয়া চুন্নি নয় তার ছেলে, ভাই ও সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মামলাও হয়েছে। এরপরও থেমে থাকেনি তাদের অপরাধ। এ রকম অসংখ্য মামলার মধ্যে মাফিয়া চুন্নি ও তার ছেলে ছামিন আহম্মেদ হিরনের বিরুদ্ধে ২০০৯ সালের ১৭ই ডিসেম্বর সবুজবাগ থানার দ্রুত বিচার আইনে, ৩রা সেপ্টেম্বর মামলা হয় মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে। তার ভাই মিন্টুর বিরুদ্ধে মাদক অপরাধে ৬-৭টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া মাফিয়া চুন্নির ভাইঝি জামাই রাজু, মাফিয়া চুন্নির একান্ত সহযোগী ফরিদ আহম্মেদের বিরুদ্ধে সবুজবাগ থানায় মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধে ৬-৭টি মামলা আছে।

মাফিয়ার সম্পত্তি

ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে নামে-বেনামে ১০-১২টি প্লটের মালিক চুন্নি। সবুজবাগেই আছে তার ২টি বাড়ি ও ৩টি প্লট। ৫৫/৭-এর ৩ নম্বর সবুজবাগে তার চার তলার আলীশান বাড়ি। সেখানে ভাড়াটিয়ার নামে যারা বসবাস করে সবাই তার বাহিনীর লোকজন। এ ছাড়া ওহাব কলোনির ৩৮২ নম্বর বাড়িটিও সমপ্রতি চারতলা পর্যন্ত শেষ হয়েছে। ওহাব কলোনির এ বাড়িতে থাকে তার ভাই মাদক বিক্রেতা মিন্টুর শাশুড়ি। তার শাশুড়ির নাম বকুলি। তিনি মানুষের বাসা-বাড়িতে কাজ করলেও এখন চারতলা বাড়ির মালিক। তার ছেলের পেশা রিকশা চালানো। রিকশা চালক হয়েও তার রয়েছে চারতলা বাড়ি। গতকাল এ বাড়িতে গিয়ে কথা হয় শফিকের স্ত্রী খোদেজার সঙ্গে। তিনি তার স্বামী ও শাশুড়ির পেশার কথা স্বীকার করে বলেন, বাড়ি বানিয়েছি লোন করে। এখনও অনেক টাকা পাওনাদার আছে। কত টাকা ধার করে এ বাড়ি করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ বর্তমান বাজার মূল্যে যে বাড়ির নির্মাণ ব্যয় ৫০-৬০ লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে তিনি ২০ হাজার টাকায় এ বাড়ি নির্মাণ করেছেন বলে জানান। এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, বকুলি হচ্ছে মাফিয়া চুন্নির খালা। তিনি মাদক সম্রাজ্ঞী মাফিয়া চুন্নির অন্যতম সহযোগী। এ বাড়ি মাফিয়া চুন্নির হলেও তিনি তা শফিকের পিতার বাড়ি বলে সবাইকে জানান। এ ছাড়া মাদারটেকে আছে ৩টি প্লট। উত্তরায় তার একটি বাড়ি আছে বলে এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে। এ ছাড়া সোনারগাঁও থানায় শতাধিক বিঘা জায়গা আছে বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে সাভারে ৩টি প্লট, ধানমন্ডি ও উত্তরায়ও তার প্লট রয়েছে। ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেও তার সম্পত্তি রয়েছে। গ্রামের বাড়ি দাউদকান্দিতে রয়েছে ২০ বিঘা জমি।

Source : WatchDog – and DailyManabZamin