গ্রামীণফোনের ৭০ কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি!

প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণফোন লিমিটেড। মাত্র ৫ মাসে প্রতিষ্ঠানটির ৩২টি আমদানি পণ্যের চালান আটক করে ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ জরিমানাসহ ৬৯ কোটি ৮৪ লাখ ২২ হাজার ১২৭ টাকা শুল্ক ফাঁকির চাঞ্চল্যকর ঘটনা উদঘাটন করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গ্রামীণফোন শুল্ক ফাঁকি ও শুল্ক আইন লংঘনের অপরাধ স্বীকার করে। শুল্ক আইনে দাবিনামা জারির পর প্রতিষ্ঠানটিকে ব্যক্তিগত শুনানির সুযোগ দেয়া হয়। এতে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আমদানি করে প্রতারণা, উচ্চ শুল্কের এইচএস কোডের পণ্য নি শুল্কে আমদানির মাধ্যমে শুল্ক ফাঁকির অপচেষ্টা, বাধ্যতামূলক পিএসআই সত্ত্বেও শুল্ক ফাঁকির অসৎ উদ্দেশ্যে তা না করা, শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে জাল কাগজপত্র প্রদর্শনসহ গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে সরকারের বিপুল অংকের রাজস্ব আÍসাতের অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। গ্রামীণফোনকে আÍপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে শুল্ক আইনে ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার বিচারাদেশে এসব অপরাধের জন্য সর্বমোট ২৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা জরিমানা করে। সংশ্লিষ্ট সূত্র বহুজাতিক গ্রামীণফোনের একের পর এক অনৈতিক কর্মকাণ্ডে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি সুস্পষ্টভাবে এদেশে মোবাইল অপারেটর ব্যবসার লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে চলেছে। এর আগে দুই দফায় অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকা প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটিকে প্রথম দফায় ১৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় আড়াইশ’ কোটি টাকা জরিমানা করে বিটিআরসি। এখন একের পর এক শুল্ক ফাঁকি এবং মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি এদেশে ব্যবসা করার নৈতিকতা হারিয়েছে।


আইন লংঘন : নথিপত্র পর্যালোচনা করে জানা গেছে, ঢাকা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের পৃথক বিচারাদেশে গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইন, কাস্টমস আইন, আমদানি-রফতানি (নিয়ন্ত্রণ) আইন, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন লংঘনের অভিযোগ ভঙ্গ করার অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। এজন্য কাস্টমস কমিশনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই গ্রামীণের আমদানি পণ্য রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করা হয়। কিন্তু আমদানিকারক শুল্ক ফাঁকির অপরাধ স্বীকার করায়, দেশের একটি বড় টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এবং আমদানি পণ্য নিষিদ্ধ না হওয়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ নমনীয়তা প্রদর্শন করে সংক্ষিপ্ত বিচারাদেশে শুধু বিভিন্ন অংকের জরিমানা দণ্ড দিয়ে পণ্য খালাসের সুযোগ দেয়। এর মধ্যে ১১টি আমদানি চালানে শুল্ক ফাঁকির ১৮ কোটি টাকা পরিশোধ সরকারি কোষাগারে জমা দিতে বাধ্য হয় খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানটি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে ওয়াদা করেও বাকি ২১ চালানের অর্থ জমা না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালে আপিল মামলা দায়ের করে, যা এখন বিচারাধীন রয়েছে বলে জানা গেছে।

পুরস্কারের বদলে শাস্তিমূলক বদলি : এদিকে গ্রামীণসহ অন্যান্য মোবাইল ফোন অপারেটরদের আরও অর্ধশতাধিক আমদানি চালানেও একই পন্থায় শুল্ক ফাঁকির অভিযোগের তদন্ত শুরু হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করে গ্রামীণফোন। এর আগে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়া হয় কমিশনারসহ সংশ্লিষ্টদের। কিন্তু তাদের তারা তোয়াক্কা না করে সাহসিকতার সঙ্গে গ্রামীণফোনসহ একাধিক মোবাইল অপারেটরের শুল্ক ফাঁকির তদন্ত কাজ চলতে থাকে। এরই একপর্যায়ে নিয়োগের মাত্র ১৪ মাসের মাথায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আকস্মিকভাবে প্রশংসা বা পুরস্কারের বদলে শাস্তিমূলক বদলি করে ঢাকা কাস্টম হাউসের সাবেক কমিশনার ফিরোজ শাহ আলমকে। তদন্তের সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও অন্যত্র খারাপ পোস্টিং দেয়া হয়। এভাবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তৎকালীন নীতিনির্ধারকরা সরকারের রাজস্ব আÍসাৎকারীদের শেল্টার দিয়ে এক ঘৃণ্য নজির স্থাপন করেন বলে জানা গেছে। তবে এর আগেই কাস্টমস কমিশনার ফিরোজ শাহ আলম গ্রামীণফোন, ওয়ারিদ টেলিকম, সেবা টেলিকম (বর্তমানে বাংলালিংক) ও টিএম ইন্টারন্যাশনালের (বর্তমানে রবি) প্রায় শত কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকির এক ভয়াবহ চিত্র উদঘাটন করেন। ফাঁকি উদঘাটনকারী কমিশনারের ওপর শাস্তির খড়গ নেমে আসায় এরপর থেকে আর কোন কাস্টমস কমিশনার পরে মোবাইল অপারেটরদের শুল্ক ফাঁকি উদঘাটনে ন্যূনতম কোন পদক্ষেপ নেয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

শুল্ক ফাঁকির কৌশল : মেসার্স গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই শুল্ক ফাঁকি দিয়ে আসছিল বলে কাস্টম সূত্র দাবি করেছে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশ করেই ফাঁকি অব্যাহত থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু কমিশনার হিসেবে ফিরোজ শাহ আলমকে নিয়োগ দেয়ার পরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। তিনি যে ৩২টি চালান আটক করে বিপুল অংকের শুল্ক ফাঁকি উদঘাটন করেন তার প্রায় প্রতিটিতেই মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানি এবং উচ্চ শুল্কের পণ্য  শুল্কের এইচএস কোডে আমদানির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘটনা হচ্ছে, আমদানিকারক মেসার্স গ্রামীণফোনস লিমিটেড ২০০৬ সালে এলসি নং ৫৬৩৬২৯০৫১২ ও ইনভয়েস নং ৭২০৭০০৪৮৪৩-এর মাধ্যমে ১৩ লাখ ২১ হাজার ৬১৭ মার্কিন ডলার মূল্যের gateway PRS Support Node Ges Serving PRS Support Node পণ্য আমদানি করে। চালানটি খালাসের জন্য সিএন্ডএফ এজেন্ট মেসার্স বাদল অ্যান্ড কোং ২৭/১ কাকরাইল রোড ঢাকা কাস্টম হাউসে বিল অব এন্ট্রি দাখিল করে। পণ্য চালানটি আমদানিকারকের ঘোষণা অনুযায়ী ঐ.ঝ. ঈড়ফব ৮৫২৫.২০.৯০ এর আওতায় ১৫ শতাংশ মূসক ও ৪ শতাংশ আইডিএসসি মুক্ত হিসেবে ৫ শতাংশ রেয়াতি হারে শুল্কায়ন করা হয়। আমদানিকারক এ হিসেবে শুল্ক বাবদ ৩৭ লাখ ৭৫ হাজার ৮৮২ টাকা পরিশোধ করে চালানটি খালাস নিয়ে যায়। কিন্তু পরে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ খালাসোত্তর পর্যালোচনা করে দেখতে পায়, আলোচ্য চালানটি মিথ্যা ঘোষণায় খালাস নেয়া হয়েছে। পণ্যটি ঐ.ঝ. ঈড়ফব ৮৫২৯.১০.০০ এর আওতায় খালাসযোগ্য ছিল। এই এইচএস কোড অনুযায়ী চালানটিতে ১৫ শতাংশ মূসক, ২৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক, ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর এবং ৪ শতাংশ অবকাঠামো উন্নয়ন সারচার্জ প্রযোজ্য। এছাড়া এইচএস কোড অনুযায়ী চালানটিতে পিএসআই করানো বাধ্যতামূলক ছিল এবং এজন্য শুল্কায়ন মূল্যের ১ শতাংশ ফি পরিশোধযোগ্য। এ হিসেবে চালানটির পুনঃশুল্ক করের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ কোটি ৩৪ লাখ ৪৭ হাজার ২৬৩ টাকা। এভাবে গ্রামীণফোন একটি চালানে ২ কোটি ৮৯ লাখ ২ হাজার ৭৯৮ টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়ে খালাস নিয়ে গেছে।

কাস্টম কমিশনারের বিচারাদেশ : কারণ দর্শানো নোটিশ এবং আÍপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে ঢাকা কাস্টম হাউসের কমিশনার প্রকাশ দেওয়ান ২০০৮ সালে এ অপরাধের জন্য যে বিচারাদেশ দেন তাতে বলা হয়, ‘আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান মেসার্স গ্রামীণফোনস লিমিটেডের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত শুল্ক ফাঁকি, কাস্টমস আইন লংঘন ছাড়াও আমদানি-রফতানি (নিয়ন্ত্রণ) আইন, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন লংঘনের অভিযোগ ভঙ্গ করার অভিযোগ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এজন্য ২৮ লাখ ৯০ হাজার ২৮০ টাকা জরিমানা ও ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা পিএসআই জরিমানা আরোপ করলাম। একই সঙ্গে কম পরিশোধিত শুল্ককর বাবদ ২ কোটি ৮৯ লাখ ২ হাজার ৭৯৮ টাকা আদায়ের নির্দেশ দিলাম। মোট ৪ কোটি ৫৪ লাখ ৯৩ হাজার ৭৮ টাকা আদেশ জারির ৩০ দিনের মধ্যে ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জমা প্রদানপূর্বক ট্রেজারি চালানের কপি এ দফতরে দাখিল করার জন্য মেসার্স গ্রামীণফোনস লিমিটেড, সেলিব্রেশন পয়েন্ট, প্লট-৩ ও ৫, রোড-১১৩/এ, গুলশান, ঢাকাকে নির্দেশ প্রদান করলাম।


তথ্যসূত্র : দৈনিক যুগান্তর