নোবেল বিজয়ী ইউনুসের একি কান্ড!

নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত একটি প্রামাণ্যচিত্রে অভিযোগ করা হয়েছে। নরওয়ের ওই টেলিভিশনে প্রথমবারের মত প্রচারিত ‘ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে’ নামে এই প্রামাণ্যচিত্রটি নির্মান করেছেন ডেনমার্কের চলচ্চিত্র নির্মাতা টম হাইনম্যান।

১৯৯৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের দরিদ্র ঋণ গ্রহীতাদের জন্য আসা এই অর্থসাহায্য তার মালিকানাধীন আরেকটি কোম্পানিতে স্থানান্তর করেছে ড. ইউনুস। প্রামাণ্যচিত্রটিতে বলা হয়, ড. ইউনুস তার বিখ্যাত গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামের বহু দরিদ্র নারীকে ৩০ ভাগ সুদের হারে ঋণ দিয়ে ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলেছেন। বিষয়টি নিয়ে নির্মাতা টম হাইনম্যান কয়েকবার বাংলাদেশেও এসেছেন এবং বিভিন্ন দেশের বিশেষজ্ঞদের সাথে কথাও বলেছেন। নির্মাতা অভিযোগ করেছেন, প্রায় ছয় মাস ধরে তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা এবং বিষয়টি সম্পর্কে কথা বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ড. ইউনুস তাকে কোনো সময় দেননি। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের যে ইতিবাচক চিত্র মানুষের মনে আছে এই প্রামাণ্যচিত্র সম্পূর্র্ণ তার বিপরীত একটি চিত্র তুলে এনেছে। প্রামাণ্যচিত্রে সুদের ফাঁদে গ্রামীণ দরিদ্র নারীদের অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে ফেলার চিত্র তুলে ধরা হয়। এছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ সংগ্রহের নিষ্ঠুর প্রক্রিয়া সম্পর্কেও এতে বলা হয়েছে। ব্যাংকটি ক্ষুদ্র ঋণের জন্য এ পর্যন্ত নরওয়ে থেকে ৪০০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পেয়েছে। ‘গরীবের জন্য ব্যাংক’-এই শ্লে­াগান নিয়ে ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু করে গ্রামীণ ব্যাংক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী জোবরা গ্রামের ৪২ জন নারীর কাছ থেকে প্রায় ১৮ শ’ টাকা নিয়ে ব্যাংকটি ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। ড. মুহাম্মদ ইউনুস সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করতেন। বাংলাদেশে এবং সারাবিশ্বে ক্ষুদ্র ঋণের প্রবর্তক বলে পরিচিত ব্যাংকটিতে বর্তমানে ৮৫ লাখ গ্রাহক রয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী। ঋণ ফেরতের হার ৯৭ থেকে ৯৮ ভাগ বলে গ্রামীণ ব্যাংক সবসময়ই গর্ব করে প্রচার করে এবং এটাকে তারা তাদের সফলতা বলে মনে করে। এই সফলতা দেখিয়ে তারা প্রচার করে গ্রামীণ ব্যাংক নারীদের স্বাবলম্বী করেছে যে কারনে তারা ঋণ ফেরত দেয়। কিন্তু প্রামাণ্যচিত্রটিতে বিশেষজ্ঞরা তথ্য, উপাত্ব ও অভিজ্ঞতাসহ ভিন্ন আরেকটি চিত্র উপস্থাপন করা হয়।

উচ্চ সুদের হার ২ হাজার ৫ শ’ দরিদ্র মানুষের ওপর ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায় এদের তিনভাগেরও বেশি লোক গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। বাংলাদেশে গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ২৬ থেকে ৩১ ভাগ যেখানে অন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের সুদের হার আরও অনেক বেশি। গবেষণায় দেখা যায়, সারা বিশ্বে ক্ষুদ্র ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুদের হার কোথাও কোথাও ১০০ এমনকি ২০০ ভাগও রয়েছে। ঋণ ফেরতের প্রক্রিয়া নিয়ে গ্রামীন ব্যাংকের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রটিতে সেই চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। ঋণের টাকা পরিশোধের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কি অমানবিক আচরণ করেছেন সে কথাই বলেন ঋণ গ্রহীতা হাজেরা। তিনি বলেন, ‘এক পর্যায়ে আমি ঋণের টাকা ফেরত দিতে পারছিলাম না। তখন গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন আমার বাড়িতে এসে নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করে। তারা আমাকে হুমকি দিয়ে বলে ঘরের চালা বিক্রি করে দেবে। যদি আমি ঋণ পরিশোধ না করি তাহলে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলবে। আরও অনেক নোংরা নোংরা কথা বলে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি ভয় পেয়ে আমার সবকিছু বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করি।’ সাক্ষাৎকারে হাজেরা আরো জানান, তার কেহ নেই। এখন ঘরের চালায় ফুটো। ঘরটা যে কোনো সময় ভেঙ্গে যেতে পারে। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংকে মোট ৪০ কোটি ডলার অর্থ সাহায্য দেয়। তবে মূল বিষয় হলো নোরাডের অর্জনের সবটুকুই ছিল গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে। ৯০ এর দশকের শুরুতে নোরাডের কর্মকর্তারা গরিব মানুষজন ঋণের চক্রে ফেঁসে যাচ্ছে বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন।

প্রামাণ্যচিত্রে উল্লে­খ করা হয়, ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বর নোরাডের এক চিঠিতে বলা হয়, ‘১০ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য এমন ৪০ নারীর ওপর ডেভিড গিবনস ও হেলেন টডের এক জরিপে দেখা গেছে ওই নারীদের প্রত্যেকেই গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে গিয়ে পুনরায় ঋণ নিয়েছেন।’ ১৯৯৪ সালের ১ জুন আরেক চিঠিতে বলা হয়, ‘ঋণের যে ধারণার প্রবর্তন করা হয়েছে তার মাধ্যমে চলতি ঋণ পরিশোধের জন্য আবারো ঋণ গ্রহণের উর্বর ভিত্তির সূচনা হয়েছে।’ ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ইয়াছমিন নামে অপর এক নারী বলেন, ‘প্রথম ঋণ নেওয়ার পর সেই ঋণ পরিশোধ করতে আমাকে চাপ দেওয়া হলো। শেষমেশ আমি আবারো লোন নেই আগের ঋণ পরিশোধের জন্য। এভাবে আমি এক এক করে পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছি।’ ‘ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে’ এই প্রামাণ্যচিত্রে এছাড়াও বেশক’জন বিশেষজ্ঞ, গবেষক ও সমাজ বিজ্ঞানীর মতামত নেওয়া হয়েছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হা-সুন চ্যাং বলেন, ‘ভালো মানুষরা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে সাহায্য করে। আর তারা বোকার মত মনে করে যে এটা হচ্ছে দারিদ্র্য দূরীকরণের আদর্শ সমাধান।’


আরেকজন বিশেষজ্ঞ ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেমোক্রেসির ডেভিড রুডম্যান বলেন, ‘যারা আমাদের সামনে সবচেয়ে ভালো গল্প ফাঁদতে পারে এবং আমাদেরকে বোঝাতে পারে যে টাকা ভালো জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে আমরা তাদেরকেই টাকা দেই।’ ডেভিড রডম্যান, জোনাথন মারডক, টমাস ডিক্টার ও মিলফোর্ড বেটম্যানের মতো সমাজবিজ্ঞানীদের সবার মুখেই এক সুর-‘ক্ষুদ্র ঋণ চালু হওয়ার ৩৫ বছরে এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যা দেখে মনে হতে পারে এই ঋণ দরিদ্রদের দারিদ্র্য  থেকে মুক্তি দিয়েছে।’- সূত্র: এফএনএস ডট কম।