১৬ বছর ধরে কারাগারে গৌরনদীর মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী

পেরথোম (প্রধান) আসামিরে ছাইরা দেলেও মোর স্বামী আইজ ১৬ বছর ধইরা জেলখানায় (কারাগারে) পছতাছে। এইয়ার লাইকি মোর স্বামী নিজের জীবন বাজি রাইখা দ্যাশটা স্বাধীন করছেলো। হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে বলে ওঠেন-মোর নির্দোষ স্বামীরে ছাইড়া দ্যান। বলেই বাকরুদ্ধ হয়ে পরেন দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে কারাঅভ্যন্তরে থাকা বাংলার গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাসুদেবপাড়া গ্রামের ইসাহাক আলী মৃধার বৃদ্ধা স্ত্রী রওশন আরা বেগম (৫৩)। মুক্তিযোদ্ধার অসহায় পরিবারটি আগামি ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বর্তমানে ৮৪ বছরের বয়স্কা মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুল শিক্ষক ইসাহাক আলীকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ও তার বয়সের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় মুক্তি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।


বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে নিহত হন গৌরনদী উপজেলার বাসুদেবপাড়া গ্রামের রাজাকার ওহাব আলী সরদার। ৮০’র দশকে ওহাব আলীর পুত্র শাহ আলম সরদার সর্বহারা জিয়া গ্র“পের আঞ্চলিক নেতা রেজাউল করিম আকন্দের দলে যোগদান করে চাঁদাবাজি, লুন্ঠন, জুলুমবাজি, নারী নির্যাতনসহ এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ওই সময় সে (শাহ আলম) ও তার সহযোগীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে একই গ্রামের মৃত মোনাছেব বেপারীর স্ত্রী সুফিয়া বেগমকে তার ১২ বছরের একমাত্র পুত্র সন্তান আব্দুর রব বেপারীর সম্মুখ বসেই বিবস্ত্র করে গণধর্ষণ করে। একপর্যায়ে তার (সুফিয়ার) যৌনাঙ্গে ধারালো অস্ত্র (চাক্কু) দিয়ে কুপিয়ে ক্ষত বিক্ষত করা হয়। বিধবা সুফিয়া স্থানীয়দের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও এর কোন বিচার না পেয়ে দেশত্যাগ করে ঢাকায় গিয়ে ওঠেন। সে সময় অর্থাভাবে সুফিয়া তার ক্ষত বিক্ষত স্থানের চিকিৎসা করাতে না পেরে ধুকে ধুকে কয়েকদিন পর মারা যান। এ সুযোগে বিধবা সুফিয়ার বাড়ি-ঘরসহ জমাজমি দখল করে নেয় শাহ আলম ও তার বোনজামাতা শামসুল হক ফরাজী।


স্থানীয় ছালাম মোল্লা (৫২) জানান, সুফিয়ার পুত্র আব্দুর রব বেপারীর বয়স যখন ২০ বছর ঠিক সে সময় সে (রব) এলাকায় ফিরে প্রতিশোধের নেশায় তার মায়ের ইজ্জত হরনকারী সর্বহারা জিয়া গ্র“পের প্রভাবশালী নেতা ও দুর্ধর্ষ ডাকাত সর্দার শাহ আলমের দলেই যোগদান করে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই ডাকাত শাহ আলমের দলের সকল প্রকার অপরাধমূলক কর্মকান্ডে রব অল্পদিনেই শাহ আলমের বিশ্বাসতা অর্জন করে। এরইমধ্যে মায়ের ইজ্জত হরনের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রব সুযোগ খুঁজতে থাকে। শাহ আলমের বোন জয়তুন নেছা (৫৬) বলেন, হেইদিন (১৯৮৮ সালের ৫ নবেম্বর বিকেল চারটার দিকে) মোগো জমির আমন ধান রব কাইড্যা লইয়া যাইতাছে, এই খবর পাইয়া মুই আর মোর ভাই শাহ আলম সরদার ভুঁইর (জমির) দিকে যাইতে আছিলাম। মোর আগে ভাই শাহ আলম দৌঁড় দিয়া সামনে যাওয়ার সাথে সাথে রব বেপারী এট্টা গাছকাটা দাও দিয়া মোর ভাইর মাথায় কোপ দিয়া মস্তক বাইর কইরা হালায়। সাথে সাথে মোর ভাই শাহ আলম ভূঁইর (জমির) মধ্যে হুইয়া পইরা মইরা যায়। মুই সামনে যাওয়ার আগেই রব দৌঁড়াইয়া পলাইয়া যায়। তিনি আরো বলেন, মোর ভাইর খুনী হইছে রব বেপারী। এ ঘটনার সময় ইসাহাক মাষ্টার (মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী মৃধা) আছিলোনা।


স্থানীয়দের সাথে আলাপকালে জানা গেছে, শাহ আলম খুনের ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে সর্বহারা জিয়া গ্র“পের আঞ্চলিক নেতা ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতা রেজাউল করিম আকন্দ নিহত শাহ আলমের ভাই আঃ সোবহান সরদারকে বাদি করে গৌরনদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে (যার নং-৯০/৯১)। ওই মামলায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুল শিক্ষক ইসাহাক আলী মৃধাসহ ১১ জনকে আসামি করা হয়। বাসুদেপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা (মুক্তি বার্তার ১৪৪ পৃষ্টায় ক্রমিক নাম্বার-০৬০১১০০২৭৮) ইসাহাক আলী মৃধার বড়পুত্র দিনমজুর ইসমাইল মৃধা (৩৮) জানান, রবের হাতে যখন ডাকাত শাহ আলম খুন হয় তখন তার বাবা স্কুলে কর্মরত ছিলেন। তার পরেও মামলা দায়েরের পর ১৯৯৪ সালে তার পিতা মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী মৃধা আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। বিচারক তার আবেদন না মঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে অদৃশ্য কারনে ১৯৯৬ সালের ৩০ আগস্ট বরিশালের দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ মমিন উল্লাহ শাহ আলম হত্যা মামলার ১১ নাম্বার আসামি মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীসহ ওই মামলার ৯ জন আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন। পরবর্তীতে নিয়মতান্ত্রিক ভাবে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টের শরনাপন্ন হয়েও ব্যর্থ হন।


মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর ছোট পুত্র মিজানুর রহমান (৩২) জানান, শাহ আলম হত্যা মামলার প্রধান আসামি কাঞ্চন আলী মৃধার পরিবার বিএনপির সমর্থক হওয়ায় বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে স্থানীয় বিএনপি দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য এম. জহির উদ্দিন স্বপন তদবির করে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি এয়ার ভাইস মার্শাল আলতাফ হোসেন চৌধুরীকে দিয়ে রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় হত্যা মামলার ১ নাম্বার আসামি কাঞ্চন আলী মৃধাকে বেকসুর খালাস করে আনেন। মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর অসহায় পরিবার, দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে বর্তমানে ৮৪ বছরের বয়স্কা মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুল শিক্ষক ইসাহাক আলীকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ও তার বয়সের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় মুক্তি দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রিসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।