বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

স্বাধীনদেশে বাবা-মাকে দেখতে যাবো। কতো মা তার পুত্রকে হারাচ্ছে, কতো বোন-ই-তো তার ভাইকে হারাচ্ছে। তাদের কথা একটু চিন্তা করো। সেখানে আমাকে নিয়ে তোমরা এতো ভাবছো কেন। তোমরা সবাই আমার জন্য দোয়া করো, আমি দেশটাকে স্বাধীন করে বিজয় পতাকা উড়াবোই। এ সময় তার দু’চোখ দিয়ে অঝড় ধারায় অশ্র“ ঝড়ছিলো। আর এটাই ছিলো করাচীর বাসায় বসে তার বড় বোনের সাথে শেষ কথা ও শেষ দেখা। সেইদিনের কথা বর্ননা করতে গিয়ে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পরেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লড়াকু সৈনিক শহীদ ক্যাপ্টেন বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর (ইঞ্জিঃ)-এর বড় বোন রাহানু বেগম আলো (৭০)। আজ মঙ্গলবার এ বীর সেনানির ৩৯ তম মৃত্যুবার্ষিকী।

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরবরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার আগরপুর ইউনিয়নের রহিমগঞ্জ গ্রামের সম্ভ্র্যান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৯ সালের ৭ মার্চ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা বিশিষ্ট সমাজসেবক মৌলভী আব্দুল মোতালেব হাওলাদার, মাতা সাফিয়া খাতুন। ৩ ভাই ও ৫ বোনের মধ্যে তিনি (মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর) ছিলেন মেঝ। ১৯৬৭ সনে পাকিস্তানী মিলিটারী একাডেমিতে (কাকুলে) তিনি জেন্টলম্যান ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন।

বীরশ্রেষ্ঠ মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর-এর ছোট ভাই মঞ্জুর রহমান বাচ্চু (৫৫) বলেন, দেশ থেকে সবশেষ ১৯৬৯ সালের ২৮ অক্টোবর দাদা কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানের ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। সে সময় আমি ও আমার মা সাফিয়া খাতুন নানাবাড়ি বরিশালের মুলাদীর নন্দিরবাজার ষ্টীমার ঘাট থেকে দাদাকে ষ্টিমারে তুলে দিতে গিয়েছিলাম। সেময় আমি নবম শ্রেনীর ছাত্র। দাদা মাকে বলেছিলো মা ছুটি পেলে আগামি বছর শীতের মৌসুমের দেশে এসে খেজুর রসের পায়াস ও পিঠা খাবো। তুমি আমাকে একটু দোয়া করে দাও। এসময় দাদার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়ছিলো। আর দাদা আমাকে বলেছিলো ভালো করে লেখাপড়া করিস। এটাই ছিলো দাদার সাথে আমার ও মায়ের শেষ দেখা। পরবর্তীতে ছুটি না পাওয়ায় দাদা আর দেশে আসেননি। তবে তৎকালীন করাচীর শেফা রোডের বড় বোনের বাসায় মাঝে মধ্যে এসে দাদা দেখা করতো। এরপর দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বন্দিত্বের নাগপাশ ছিন্নকরে এসে দাদা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। তিনি রাজশাহী জেলার চাঁপাইনবাগঞ্জের সীমান্ত এলাকার ৭ নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন। ১৪ ডিসেম্বর প্রত্যুযে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রেহাইচরের মধ্য দিয়ে নৌকাযোগে মহানন্দা নদী পাড় হয়ে অর্তকিত ভাবে আক্রমন চালিয়ে পাকসেনাদের কয়েকটি ট্রেঞ্চ দখল করে নেন। এসময় উভয়পক্ষের মধ্যে মুখোমুখী যুদ্ধে শত্রু পক্ষের একটি গুলি দাদার কপালে আঘাত করে। এর কিছুক্ষনের মধ্যেই দাদা (ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর) শাহাদাতবরন করেন। ১৫ ডিসেম্বর দাদাকে ঐতিহাসিক সোনামসজিদ প্রাঙ্গনে সমাহিত করা হয়। দাদা শহীদ হওয়ার প্রায় একমাস পর ১০ জানুয়ারি আমরা দাদার মৃত্যুর খবর পাই। বাবা-মা এমনকি আমাদের পরিবারের কেউই শেষবারের মতো দাদার লাশও দেখতে পারিনি। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে বীরোচিত ভূমিকা ও আত্মত্যাগের স্বীকৃতি স্বরূপ দাদাকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয়।

২০০৮ সালে স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে এ বীরশ্রেষ্ঠর পিতৃভূমি বাবুগঞ্জ উপজেলার রহিমগঞ্জ গ্রামে সর্বমোট এককোটি পনের লক্ষ টাকা ব্যয়ে “বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর” নির্মান করা হয়। ওই বছরের ২১ মে গ্রন্থাগার ও জাদুঘরের উদ্বোধন করা হয়েছে। সে সময় আগরপুর ইউনিয়নকে বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নগর ইউনিয়ন হিসেবে ঘোষনা করা হয়।

গতকাল সোমবার দুপুরে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নির্মানকাল থেকে গ্রন্থাগারে বেশ কিছু বই থাকলেও জাদুঘর হিসেবে এখানে কিছুই নেই। গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে যাতায়াতের রাস্তাটির অবস্থা খুবই নাজুক। গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান হারুন-অর রশিদ জানান, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে কোন কর্মসূচীই গ্রহন করা হয়নি। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সিদ্দিকুর রহমান খান, কবির শরীফ, মোজ্জামেল হোসেন, হাকিম হাওলাদার বলেন, একজন বীরশ্রেষ্ঠর গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে তার নিজের জন্মবার্ষিকী ও শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে সরকারি ভাবে কোন কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়নি এটা একটি লজ্জাজনক বিষয়। তারা আগামি বছর থেকে গ্রন্থাগার ও জাদুঘরে বীরশ্রেষ্ঠর জন্মবার্ষিকী, শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় দিবস পালনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি আক্ষেপ করে বলেন, বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে আসার জন্য রাস্তার অবস্থা নাজুক থাকায় দশনার্থীদের যাতায়াত করতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। তারা অবিলম্বে জাদুঘর থেকে জয়শ্রী বাসষ্ট্যান্ড পর্যন্ত ৮ কিলোমিটার সড়কের কাঁচা দু’কিলোমিটার রাস্তা পাকা করনসহ বীরশ্রেষ্ঠ’র জাদুঘরের প্রবেশদ্বার মহাসড়কে সরকারি উদ্যোগে তোরন নির্মানের জন্য জোড়দাবি জানিয়েছেন।