উইকিলিকসের তৎপরতার রহস্য

তৎপরতা সম্পর্কিত আড়াই লাখেরও বেশি গোপন দলিল বা নথি ফাঁস করেছে। উইকিলিকসের এসব তৎপরতা নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যেমন-

১. এসব নথি প্রকাশের মাধ্যমে আসলে কি ফাঁস করা হচ্ছে ?
২. কখন এবং কিভাবে উইকিলিকস এসব তথ্য পেয়েছে?
৩. এসব দলিল প্রকাশের উদ্দেশ্য কি?
৪. উইকিলিকসের পর্দার আড়ালে কারা রয়েছে?
৫. এসব দলিল প্রকাশের ঘটনা কি কূটনৈতিক ক্ষেত্রে গোপনীয়তার নীতি স্বচ্ছ করে তোলার বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নতুন অধ্যায় সূচিত করবে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে বলা যায় উইকিলিকস বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মার্কিন কূটনীতিকদের নানা তৎপরতা সংক্রান্ত গোপন নথি ফাঁস করায় অন্য দেশগুলোর সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের নানা দিক প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। একটি ফরাসী ওয়েব সাইটে বলা হয়েছে উইকিলিকস বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মার্কিন কূটনীতিকদের নানা তৎপরতা সংক্রান্ত ত্রিশ লক্ষ গোপন নথি সংগ্রহ করেছে। অন্য দেশের কর্মকর্তাদের সাথে মার্কিন কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বৈঠক সম্পর্কে বিশ্লেষণমূলক রিপোর্ট ছাড়াও বিভিন্ন নোট বা মেমো এসব নথির অন্তর্ভুক্ত। মার্কিন দৈনিক নিউ ইর্য়ক টাইমস, বৃটিশ দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ান, জার্মান সাময়িকী ডার স্পাইগেল, ফরাসী দৈনিক লা মন্ডে ও এল পাইস ২৮ নভেম্বর রাতে এসব নথির ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রাথমিক বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মার্কিন দূতাবাস গোয়েন্দা তৎপরতা চালাচ্ছে বলে এসব নথির সূত্রে প্রমাণিত হয়েছে।

উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিগুলোতে কেবল ফ্রান্স সরকার ও তার পররাষ্ট্র সম্পর্ক বিষয়ে ৫০০ থেকে এক হাজার গোপন নথি রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব নথির অংশ বিশেষে ইরাকে তৎপর আলকায়দার কর্মীদের প্রতি তুরস্কের সহায়তা এবং তুরস্কের পি কে কে গেরিলাদের প্রতি মার্কিন সরকারের সহায়তার কথা স্থান পেয়েছে। ইরাকের সীমান্ত ব্যবহার করে পি কে কে’র কূর্দী সন্ত্রাসীরা তুর্কী সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত। এসব দাবি এমন সময় করা হল যখন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ দাউদ ওগলু সন্ত্রাসী আলকায়দা গ্রুপের প্রতি আংকারার সমর্থনের কথা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেছেন, পি কে কে’র বিদ্রোহীদের ব্যাপারে ওয়াশিংটন ও আংকারার দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন।

চলতি সপ্তায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারী ক্লিন্টন চারদিনের এক রাষ্ট্রীয় সফরে তুরস্কে আসবেন বলে কথা রয়েছে। উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যে রাশিয়া, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের আর্থিক দূর্নীতির কথা এসেছে। ফলে এ বিষয়টি মার্কিন সরকারের জন্য আরেকটি কলংকে পরিণত হবে। কোনো কোনো সরকার এসব নথি ফাঁসের পরিণতির ব্যাপারে চিন্তিত। অতীতে উইকিলিকস তার ফাঁস করা নথিগুলো আলজাজিরাসহ বিভিন্ন টেলিভিশন এবং মার্কিন দৈনিক নিউ ইর্য়ক টাইমস, বৃটিশ দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ান, জার্মান সাময়িকী ডার স্পাইগেল ও ফরাসী দৈনিক লা মন্ডের মত সংবাদপত্রগুলোকে সরবরাহ করেছে।

কেবল মার্কিন সরকারের ব্যবহারের জন্য যেসব বিশেষ গোপনীয় নথি তৈরি করা হয়েছে সেসব নথি ফাঁস হয়ে পড়ায় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছে, এসব দলিলপত্র যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিপদাপন্ন করবে।

বৃটেনের ডেইলি মিরর শনিবার লিখেছে, বৃটেন সংক্রান্ত গোপনীয় নথি প্রকাশের ঘটনা আতঙ্ক সৃষ্টি করবে। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের সরকার সেদেশের জাতীয় নিরাপত্তাকে আরো বিপদাপন্ন না করার লক্ষ্যে আরো নতুন গোপন তথ্য প্রচার না করতে বৃটেনের গণমাধ্যমগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। বৃটেনের গণমাধ্যম সেদেশের সামরিক ও গোয়েন্দা অভিযান সংক্রান্ত স্পর্শকাতর নথিগুলো না ছাপাতে রাজি হয়েছে বলে একজন বৃটিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন। উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিতে মধ্যপ্রাচ্য, ইরান ও আফগানিস্তান সম্পর্কিত অতি গোপনীয় তথ্য রয়েছে বলে জানা গেছে।

কখন এবং কিভাবে উইকিলিকস এসব তথ্য পেয়েছে-এমন প্রশ্নের বিভিন্ন উত্তর দেখা যায়। অনেকে বলছেন, মার্কিন ক্ষমতাসীন কর্মকর্তাদের মধ্যে বিরোধ তথা আন্তঃ রাষ্ট্রীয় প্রতিশোধের ঘটনা হিসেবে এসব নথি ফাঁস হচ্ছে। অতীতে মার্কিন সেনা-গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞ ব্রাডলি ম্যানিংকে এ ধরনের নথি ফাঁস করার জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছে। উইকিলিকস বাগদাদে মার্কিন বিমান হামলার একটি ভিডিও প্রকাশ করার পর চলতি বছরের মে মাসে ব্রাডলিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ভিডিওতে দেখা গেছে, ২০০৭ সালে একটি মার্কিন সামরিক হেলিকপ্টার একদল বেসামরিক ইরাকী নাগরিককে কোনো উস্কানী ছাড়াই ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে। ব্রাডলি বর্তমানে ওয়াশিংটনের কাছে একটি কারাগারে আটক রয়েছেন। উইকিলিক্সকে তথ্য দেয়ার অভিযোগ সত্য বলে প্রমাণিত হলে ব্রাডলিকে বহু বছরের জন্য কারাগারে থাকতে হবে। আবার অনেকে বলছেন, মার্কিন নথিগুলোয় উল্লেখিত দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য পরিকল্পিতভাবেই উইকিলিকসের মাধ্যমে কথিত গোপন তথ্য ফাঁস করা হচ্ছে। ডেমোক্রেটিকদের মাধ্যমে রিপাবলিকানদের পরাজয়ের মূল্য হিসেবে এইসব গোপন নথি ফাঁস করা হয়েছে। কিন্তু পররাষ্ট্র সংক্রান্ত বিষয়ের ক্ষেত্রে মার্কিন কর্মকর্তারা রাজনৈতিক কারণে প্রতিদ্বন্দ্বি দেশগুলোকে অভিযুক্ত করতে অভ্যস্ত। আর বর্তমানে অভিযোগ তোলা ওই ধারাকেই ভিন্ন বা নতুন রূপ দেয়া হয়েছে গণমাধ্যমে কথিত গোপন নথি প্রচারের মাধ্যমে।
যদি এ ধারণা সত্যও হয়ে থাকে যে ওবামার প্রশাসনই উইকিলিকসের মাধ্যমে কথিত গোপন তথ্য ফাঁস করার সাথে জড়িত, কিংবা মার্কিন কর্মকর্তাদের বিরোধকে কাজে লাগিয়ে উইকিলিক্স এসব নথি হাতিয়ে নিচ্ছে, সর্ববস্থায় নথি ফাসেঁর ঘটনা থেকে বিশ্বের সাধারণ মানুষেরই বিজয় হয়েছে। কারণ, এসব নথি ফাঁসের ফলে সাধারণ মানুষ ওয়াশিংটনের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠছে। এইসব নথি ফাঁসের ঘটনা ওবামা সরকারের জন্য সমালোচনা ও কলংকের কারণ হওয়ায় এমন সম্ভাবনা কম যে ওবামা প্রশাসনই এসব নথি ফাঁসের সাথে জড়িত।

গত অক্টোবর মাসে উইকিলিকস ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কিত যুক্তরাষ্ট্রের চার লক্ষ সামরিক নথি প্রকাশ করেছে। এসব নথিতে দেখা গেছে, মার্কিন কর্মকর্তারা ইরাকী বন্দিদের ওপর বিদেশী সেনাদের নির্যাতন ঠেকানোর জন্য কিছুই করে নি।

অনেক বিশেষজ্ঞ এখন এ প্রশ্ন তুলছেন যে, মার্কিন সামরিক কর্মকর্তারা একদিকে উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিগুলোকে গুরুত্বহীন বা অগুরুত্বপূর্ণ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে তারাই কেন এ ওয়েব সাইটের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন?

এর উত্তর হল, মার্কিন কর্মকর্তারা একটা বড় রকমের বা পরিপূর্ণ সংকট এড়ানোর জন্য উইকিলিকসের ফাঁস করা নথিগুলোকে অগুরুত্বপূর্ণ বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু মার্কিন নীতির বিরোধী দেশগুলো সম্পর্কিত উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্যগুলোকে রাজনৈতিক লক্ষ্যে ব্যবহার করতে চায়। যেমন, ইরান সম্পর্কিত তথ্য।
কেবলমাত্র এ উদ্দেশ্যেই উইকিলিকসের মাধ্যমে নানা বিষয়ের নথি ফাঁস করা হচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন। উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা হলেন অস্ট্রেলিয়ান হ্যাকার জুলিয়ান পল অ্যাসাঞ্জে। ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার যুদ্ধ-বিরোধী আন্দোলনগুলোর মাধ্যমে চলতি বছর এ সাইটটি ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করে।

ফার্সী প্রবাদে বলা হয়, ছুরি কখনও নিজ হাত কাটে না। তাই উইকিলিকস একটি নিরপেক্ষ তথ্য-সরবরাহকারী সংস্থা – এমন ধারণা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। যদিও সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা তার সংস্থাকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কাঠামোর মূল ধারা থেকে আলাদা দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়েই উইকিলিকস বিচিত্রময় তথ্য ফাঁস করছে।
উইকিলিকসের প্রচারিত বা ফাঁস করা নথির বিপুল সংখ্যাও সন্দেহজনক। আলজাজিরা টেলিভিশন, মার্কিন দৈনিক নিউ ইর্য়ক টাইমস, বৃটিশ দৈনিক দ্যা গার্ডিয়ান, জার্মান সাময়িকী ডার স্পাইগেল, ফরাসী দৈনিক লা মন্ডে ও এল পাইসের মত সংবাদ মাধ্যমে উইকিলিকসের ফাঁস করা নথি প্রচারিত হবার ফলে বিশ্বের বাম ও নমনীয় ডান ধারার মধ্যে চিন্তাগত ঐক্য গড়ে উঠছে। আর এটা সত্য যে, বর্তমান যুগে গণমাধ্যম প্রচলিত রাজনৈতিক সমীকরণকে প্রভাবিত করে থাকে।

মার্কিন সরকার যখন বলেন যে, এসব গোপন নথি ফাঁস হওয়ায় জাতীয় নিরাপত্তা ও কিছু লোকের জীবন হুমকিগ্রস্ত হয়েছে, এর অর্থ এই নয় যে, তারা এসব তথ্য ফাঁসের ব্যাপারে ভীত। আসলে তারা এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত মার্কিন কূটনীতিকদের আরো সতর্ক হবার সংকেত দিচ্ছে। কারণ, তারা গণমাধ্যমের নজরদারীর আওতায় রয়েছেন এবং সব কিছু স্ফটিকের মত স্বচ্ছ হয়ে উঠলে তাতে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠবে।
উইকিলিকস নিরপেক্ষ হোক বা না হোক, সংস্থাটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ জাতিগুলোর প্রকাশ্য ও গোপন কূটনীতির ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। একজন ভালো কূটনীতিক যা বলেন তা করেন না, বরং তিনি যা বলেন না তার ভিত্তিতেই কাজ করেন।

এ রকম খোলামেলা পরিবেশে আলোচনা বা দরকশাকশির ব্যাপারে কূটনীতিকদের নতুন করে প্রশিক্ষণ নিতে হবে, যাতে তাদের আলোচনা প্রকাশ হয়ে গেলেও জাতীয় নিরাপত্তা বিপদাপন্ন না হয়।
বর্তমান যুগে রাজনীতিবিদরা কোনো কোন বিষয় জনগণের কাছে গোপন রাখতে চান। তাই বর্তমান যুগে গণমাধ্যমের দায়িত্ব অতীতের তুলনায় বেড়েছে। এ কারণেই একবিংশ শতককে গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে কঠিন যুগ বলে মনে করা হচ্ছে। #

সূত্রঃ http://bangla.irib.ir/index.php/2010-04-21-08-15-03/67-2010-05-05-07-20-49/23116-2010-11-29-12-13-01.html