দর্শক নন্দিত ইরানী চলচ্চিত্র মুলকে সোলায়মান

পবিত্র গ্রন্থগুলোতে আল্লাহর নবীদের জীবন এবং কর্ম নিয়ে বহু কিসসা কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। এইসব গল্প কিন্তু চিত্তবিনোদনের জন্যে বর্ণিত হয় নি বরং নবী-রাসূলগণের আদর্শ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাঁদের মানসিকতা, তাঁদের মহান মিশন বা ঐতিহাসিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। কোরআনেও

এরকম বহু নবীর জীবন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। তাঁদেরই একজন হযরত সোলায়মান (আ)। হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবন কাহিনী নিয়ে চমৎকার একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে ইরানে। মহাগ্রন্থ আল কোরআনে অনেক নবীরই জীবন কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এসব কাহিণীর মধ্যে আদম (আ), নূহ (আ), ইব্রাহিম (আ), মূসা (আ), ইসা (আ) এবং হযরত মুহাম্মাদ (সা) এর প্রয়োজনীয় অনেক প্রসঙ্গ উঠে এসেছে । এসব গল্পে সাধারণত মহান সব ব্যক্তিত্বের জীবনের এমন সব ঘটনা এবং তাঁদের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, যেসব পদক্ষেপ মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। কোরআনে কারিমে মানবতার মহান এইসব শিক্ষকের জীবনের উত্থান-পতনের প্রসঙ্গগুলোকেই গল্পের আঙ্গিকে চিত্রায়িত করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, আল্লাহ পাক হযরত ইউসূফ (আ) এর ঘটনাকে অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে কোরআনে বর্ণনা করেছেন এবং ঐ জীবন-কাহিনীকে আহসানুল কেসাস বা সুন্দরতম গল্প বলে অভিহিত করেছেন।

কোরআনে কারিমে এরকম আরো একজন নবীর জীবন কাহিনী এবং তাঁর শিক্ষার কথা বর্ণিত হয়েছে। তিনি হলেন হযরত সোলায়মান (আ)। সূরায়ে নামলে হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবনকে বিচিত্র দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরা হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হযরত সোলায়মান (আ) কে যে বিচিত্র ক্ষমতা দিয়েছেন তার বর্ণনা দিয়ে এই আয়াতগুলো শুরু করা হয়েছে। সোলায়মান এবং দাউদ (আ) এর কাহিনীতে আমরা দেখবো, তাঁরা খুব দ্রুততার সাথে অংশীবাদ এভং মূর্তিপূজার সংস্কৃতির শেকড় উপড়ে ফেলেছেন এবং আল্লাহর শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছেন যেই শাসনব্যবস্থার মূলে ছিল শিক্ষা, সচেতনতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মতো উপাদানগুলো। হযরত সোলায়মান (আ) শাসন কিন্তু সাধারণ কোনো শাসন ছিল না বরং তাঁর শাসন ছিল অলৌকিকতা বা মুজেযাবহুল। পশুপাখি, জ্বিন বায়ু ইত্যাদিকে শাসন বা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ছিল হযরত সোলায়মান (আ) কে আল্লাহর দেওয়া তেমনি এক অলৌকিক শক্তি।

এই অলৌকিক ক্ষমতা বা শক্তি ব্যবহার করে হযরত সোলায়মান (আ) বিশাল একটি সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন এবং শক্তিশালী একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। তিনি আল্লাহর বিধি-বিধান এবং একত্ববাদ প্রচার প্রসারের স্বার্থে বা এক আল্লাহর ইবাদাত করার আহ্বান জানানোর লক্ষ্যে তাঁর সেনাবাহিনীর সাথে বহু অঞ্চল সফর করেছিলেন। হযরত সোলায়মান (আ) তাঁর নবুয়্যতকালে সাবা গোত্রসহ আরো বহু গোত্রকে এবং সাবার রাণীকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন অর্থাৎ হেদায়েত করেছেন। চমৎকার এই ইতিহাস অবলম্বনে যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার এবং শিল্পীগণ বহু কিসসা কাহিনী, বহু নাটক-নোবেল, বহু কবিতা বহু চিত্র অঙ্কণ করেছেন। তবে সোলায়মান (আ) এর জীবনী নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরির প্রয়াস খুব বেশি একটা লক্ষ্য করা যায় নি। বিংশ শতাব্দিতে এসে এই প্রচেষ্টার সূচনা হয়েছিল। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে স্টুয়ার্ট বালকেতান জাজমেন্ট অব সলোমন নামে সাদা-কালো একটি ফিল্ম নির্মাণ করেছিলেন। এটিই হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবনী নিয়ে সর্বপ্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রয়াস।

জাজমেন্ট অব সলোমন ফিল্মটিতে হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবনের ক্ষুদ্র একটি অধ্যায় চিত্রিত হয়েছে। নির্মাণশৈলীর দিক থেকে চলচ্চিত্রটি যে সফল ছিল তা খুব একটা বলা যাবে না। এরপর সোলায়মান (আ) এর জীবনী নিয়ে কিং ভিদোর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। সলোমন অ্যান্ড সাবা নামের এই ফিল্মটি নির্মিত হয় ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে। সোলায়মান (আ) এর বাদশাহীতে তাঁর ভাইয়ের হিংসার বিষয়টি এই চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। এই ফিল্মে অবশ্য তৌরাতের বর্ণনাকে কিছুটা বিকৃতভাবে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে রজার ইয়াং সলোমন নামে একটি টেলিফিল্ম নির্মাণ করেন। এই ফিল্মটিতেও আগের ফিল্মটির মতোই সোলায়মান (আ) এর জীবনী সম্পর্কে ইহুদিদের বর্ণনাগুলোর প্রভাব প্রতিফলিত হয়েছে। এই চলচ্চিত্রে সোলায়মান (আ) এর আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের বিষয়টির প্রতি খুব কমই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এই ফিল্মগুলোর অধিকাংশেই সোলায়মান (আ) কে কেন্দ্রিয় চরিত্রে রাখা হয় নি এমনকি ইতিহাসের অনেক বিকৃতিও লক্ষ্য করা যায়।

মুলকে সোলায়মান বা কিংডোম অব সলোমন ফিল্মটি নির্মাণ করেছেন ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার শাহরিয়র বাহরনি। সম্প্রতি চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে এবং সিনেমা হলগুলোতে পর্দায়িত হয়েছে। হযরত সোলায়মান (আ) এর জীবনের অংশবিশেষ চিত্রিত হয়েছে ফিল্মটিতে। তবে কোরআনের বর্ণনার আলোকেই পুরো গল্পটি সাজানো হয়েছে বলে এর কাহিনী সম্পূর্ণ অবিকৃত এবং প্রকৃত ইতিহাস নির্ভর হয়েছে। ফিল্মের কাহিনী অনেকটা এরকমঃ পিতা হযরত দাউদ (আ) এর মৃত্যুর পর হযরত সোলায়মান (আ) বাদশাহীর দায়িত্বে অভিষিক্ত হন। এসময় কিছু কিছু পূবার্ভাস পাওয়া যায় যে শয়তান এবং জ্বিনেরা মানব পৃথিবীর ওপর আক্রমণ চালাতে চায়। তিনি তখন ইহুদি পুরোহিতসহ বনী ইসরাইলের বড়ো বড়ো মনীষী ও বিদ্বানদের কাছে তাদের হামলা প্রতিহত করার জন্যে সহযোগিতা কামনা করেন। কিন্তু তারা ছিল ঘুষখোর এবং অত্যাচারী। সোলায়মান (আ) এর কথা শুনে তারা উল্টো তাঁকে মূর্খ বলে ভর্ৎসনা করলো। নিরুপায় হয়ে সোলায়মান (আ) তাঁর ভাইদেরকেসহ নিকট আত্মীয় স্বজনদের ওপর জনগণকে বিপদ থেকে সুরক্ষা করার দায়িত্ব অর্পণ করেন। শয়তান এবং জ্বিনেরা তো জনগণের ওপর ঠিকই হামলা করে বসে। অসংখ্য মানুষকে অসুস্থ করে ফেলে, এমনকি সোলায়মান (আ) এর স্ত্রীকেও তারা মেরে ফেলে। অবশেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সোলায়মান (আ) এর দিকে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। আল্লাহ বাতাস দিয়ে জ্বীন এবং শয়তানদেরকে পরাস্ত করেন। শেষ পর্যন্ত সোলায়মান (আ) জ্বিন এবং শয়তানী শক্তিগুলোর আক্রমণ দমন করে বিজয় লাভ করতে সক্ষম হন। তাঁর হাতে যে শক্তি সামর্থ দেওয়া হয়েছে তার সাহায্যে তিনি এবার শক্তিশালী এবং বৃহৎ একটি রাষ্ট্র গঠন করে আল্লাহর ফরমানগুলো বাস্তবায়ন করার জন্যে প্রস্তুতি নেন।

এই হলো মুলকে সোলায়মান ফিল্মের প্রথম পর্বের কাহিনী। আরো কয়েকটি পর্ব এই কাহিনীকে নিয়ে অতি শীঘ্রই নির্মাণ করবেন পরিচালক শাহরিয়র বাহরনী। তিনি অবশ্য ইতোপূর্বে হযরত ঈসা (আ) এর মা মারিয়াম (সা) র জীবন কাহিনী অবলম্বনে একটি টিভি সিরিয়াল তৈরি করেছিলেন। বড়ো বড়ো অভিনয় শিল্পীদেরকে এই ফিল্মে তিনি কাজে লাগিয়েছেন এবং ব্যবহার করেছেন সি জি আই বা কম্পিউটার জেনারেটেড ইমেইজারি সিস্টেম নামের উন্নত ও অত্যাধুনিক টেকনোলজি। এতো উন্নত ডিজিটাল সিস্টেমের প্রয়োগ ইরানী চলচ্চিত্রে এটাই প্রথম। মুলকে সোলায়মান নিয়ে তিনি ২০০৫ সাল থেকে গবেষণা শুরু করেন। বড়ো বড়ো সেট নির্মাণ করতেই অনেক সময় লেগে যায়। তারপরও গেলো ২৮তম আন্তর্জাতিক ফাজ্‌র ফিল্ম উৎসবে এই চলচ্চিত্রটি অংশ নিতে সক্ষম হয় এবং ৯টি পুরস্কারে ভূষিত হয়ে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে। ক্যামেরার কাজ, সেট ডিজাইন, কস্টিউম ডিজাইন, মেক-আপ, দৃশ্য পরিকল্পনা প্রভৃতি ক্ষেত্রেই ইরানী চলচ্চিত্রের জন্যে মুলকে সোলায়মান অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। গত ৬ অক্টোবর থেকে সমগ্র ইরানের বিভিন্ন শহরে চলচ্চিত্রটির প্রদর্শনী শুরু হয়েছে এবং দর্শকদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিক্রির দিক থেকে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করা ছাড়াও দর্শকের সংখ্যা বিচারে ইরানে সবোর্চ্চ রেকর্ড করেছে। যারা সাধারণত ফিল্ম দেখতে সিনেমা হলে যান না সেইসব দর্শকও এই ফিল্মটি দেখার জন্যে সিনেমা হলগুলোতে ভিড় করেছেন। স্বয়ং চলচ্চিত্রটির পরিচালক শাহরিয়র বাহরনী বলেছেনঃ ‘মুলকে সোলায়মান চলচ্চিত্রটিতে কাহিনীর বিন্যাস কিংবা ঘটনার বর্ণনায় কোনোরকম অস্পষ্টতা নেই এবং এই ফিল্মটি নিয়ে কাজ করার সময় আমরা চেষ্টা করেছি তৎকালীন ইতিহাসের তথ্যগুলোর আলোকে ফিল্মটিকে প্রামাণ্য ও ইতিহাস নির্ভর করে তুলতে। আমার মনে হয় সমগ্র বিশ্বব্যাপী এই চলচ্চিত্রটির কোটি কোটি দর্শক রয়েছে যারা চায় হযরত সোলায়মান (আ) জীবনচিত্র সিনেমার পর্দার দেখতে।’

তিনি আরো বলেছেনঃ ‘বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতি সুদ-আক্রান্ত এবং আর্থিক দুর্নীতির বিশ্বের অন্যতম সংকটে পরিণত হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে পবিত্র এবং হালাল সম্পদ হচ্ছে সুস্থ-সুন্দর জীবনের মূল ভিত্তি আর সুদ-ঘুষ এসব জীবনকে দূষিত করে তোলে। আমি তাই এই চলচ্চিত্রটিতে দেখানোর চেষ্টা করেছি যে সুদ-ঘুষ এগুলো অতীতেও ছিল এবং অতীতেও সমাজ থেকে নৈতিকতা কিংবা আধ্যাত্মিকতাকে দূরীভূত করেছে এই সুদ-ঘুষ প্রথা। আর হযরত সোলায়মান (আ) এই সুদ-ঘুষ প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন।’

মুলকে সোলায়মান ফিল্মটি বিষয়বস্তুর দিক থেকে যেমন তেমনি ফিল্মি টেকনিকের দিক থেকেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বিশ্বব্যাপী এই ফিল্মটি প্রদর্শন করার ইচ্ছে রয়েছে পরিচালক এবং প্রযোজকের। এরিমধ্যে অবশ্য বেশ কয়েকটি দেশ ফিল্মটি প্রদর্শনীর জন্যে কিনে নিয়েছে। এদিক থেকে বিচার করলে বলা যায় মুলকে সোলায়মান ফিল্মটি কেবল জাতীয়ই নয় বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র। যার ফলে বিশ্বব্যাপী ইরানের সাংস্কৃতিক দূতের দায়িত্ব পালন করতে পারে এই চলচ্চিত্রটি। আমরা চলচ্চিত্রটির উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করছি এবং পরবর্তী পর্বগুলো যেন দর্শকদের সামনে দ্রুত আসতে পারে লক্ষ্যে পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সবার একনিষ্ঠ প্রচেষ্টা প্রত্যাশা করছি। তাঁদের এই মহতী প্রচেষ্টা আল্লাহ কবুল করুন।
http://bangla.irib.ir/index.php/2010-04-21-08-15-03/2010-10-25-07-52-15/23543-2010-12-17-08-21-09.html