রাজাকার পুত্রকে ‘বীর সন্তান’ দাবি করে আ’লীগের সাংবাদিক সম্মেলন!

সমবেত হয় মাদারীপুরের কালকিনি সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাঠে। উপজেলা প্রশাসন থেকেও ব্যবস্থা নেয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেয়ার। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সূর্য উঠার পূর্ব হতেই মুক্তিযোদ্ধারা আসার সময় শুনতে পায় আসন্ন কালকিনি পৌরসভা নির্বাচনে এক রাজাকার পুত্রকে যোগাযোগমন্ত্রী আ’লীগের প্রার্থী হিসেবে সমর্থন দিয়েছেন। এ খবরে প্রায় ৭শতাধিক মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। এমতাবস্থায় বিজয় অনুষ্ঠানে সাড়ে ১২টায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনার এক পর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যান মীর গোলাম ফারুক পৌরসভার মেয়র পদে আ’লীগের প্রার্থী হিসেবে ১৯৭১সালের শান্তি কমিটির সভাপতি লতিফ বেপারীর পুত্রকে পরিচয় করিয়ে দিতে গেলে উপস্থিত মুক্তিযোদ্ধারা ‘যুদ্ধাপরাধীর ছেলেকে মেয়র পদে চাইনা, আ’লীগের এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে’ স্লোগান দিতে থাকে। পরে মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাস ও উপজেলা চত্ত্বর প্রদক্ষিণ করে। বিষয়টি উপজেলার সর্বত্র টক অব দ্যা টাউনে পরিনত হওয়ায় রাজারকার পুত্রের পক্ষে সাফাই গাইতে ও ‘বীর সন্তান’ বলে দাবী করে উপজেলা ও পৌর আ’লীগ শুক্রবার বিকালে কালকিনি প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। এতে স্থানীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা আনন্দ মিছিলও করেছে।    মনোনায়ন সিদ্ধান্তে উপজেলা আ’লীগ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

জানা গেছে, নির্বাচনী তফশিল ঘোষণা করা হলেই আ’লীগের প্রায় এক ডজন নেতা দলীয় মনোনায়ন যুদ্ধে নেমে পড়ে। পৌর নির্বাচনের এ মনোনায়ন যুদ্ধে অংশ নেয় উপজেলা আ’লীগের সহসভাপতি ও শান্তি কমিটির সভাপতির পুত্র খায়রুল আলম খোকন বেপারী, আ’লীগের যুগ্নসম্পাদক ও সাবেক মেয়র তৌফিকুজ্জামান শাহীন, কেন্দ্রীয় কৃষকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিলুর রহমান সোহাগ, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মনির হাওলাদার, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য মীর মামুন-অর-রশীদ, পৌর আ’লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দুলাল, উপজেলা আ’লীগের সদস্য সরদার লোকমান হোসেন, পৌর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এনায়েত হোসেন, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মশিউর রহমান সবুজ ও আ’লীগে যোগদানকারী সাবেক পৌর প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ। একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে ১২ডিসেম্বর উপজেলা আ’লীগের কার্যকরী পরিষদের এক জরুরী সভা সার্কিট হাউসে বসে এবং একটি মনোনায়ন কমিটি গঠন করে।

সূত্র জানায়, কেন্দ্রীয় নির্দেশ মোতাবেক একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে না পারায় স্থানীয় সাংসদ ও যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সম্ভব্য প্রার্থী ও মনোনায়ন কমিটিকে ঢাকায় ডেকে নিয়ে ২দিন বৈঠকে বসেন। সৈয়দ আবুল হোসেন নানা দিক বিবেচনা করে খায়রুল কবির খোকন বেপারীকে সমর্থণ দেন এবং মনোনায়ন কমিটি এই সমর্থণকেই চুরান্ত একক প্রার্থী হিসেবে নির্ধারণ করে। বর্তমান সরকার যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সোচ্চার ঠিক সেই মূহূর্তে রাজাকার পুত্রকে সমর্থণ দিলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে আশঙ্গায় অন্য প্রার্থীরা এর প্রতিবাদ জানায় এবং ক্ষুদ্ধ হয়ে এলাকায় ফিরে আসে। বুধবার ঢাকায় বসে নেয়া এই সিদ্ধান্ত রাতেই এলাকায় নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার বিজয় দিবসে আ’লীগের এই দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হলে মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।

মুক্তিযোদ্ধা ও উপজেলা আ’লীগের সদস্য আঃ মালেক হাওলাদার সাংবাদিকদের জানান, ‘৭১এর পিস কমিটির সভাপতি ও পাকিস্তানী আর্মী বাহিনীর দোসর লতিফ বেপারীর ছেলে আ’লীগ থেকে পৌরসভার নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনায়ন পেতে পারে না। আমরা তা মানি না, প্রয়োজনে আবারো যুদ্ধ হবে। মনোনায়ন প্রত্যাহার করা না হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে’। এ ছাড়াও একাধিক মুক্তিযোদ্ধা জানিয়েছেন তাদের ক্ষোভ ও দুঃখের কথা।
চুরান্ত প্রার্থী ঘোষণা ও রাজাকার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় এর জবাব দিতে উপজেলা ও পৌর আ’লীগ প্রেসক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করে উক্ত সমালোচনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায় এবং উক্ত প্রার্থীর বাবা শান্তি কমিটির সভাপতি থাকলেও তাকে ‘বীর সন্তান’ বলে দাবী করা হয়। এতে এক প্রশ্নের জবাবে উপজেলা চেয়ারম্যান ও আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মীর গোলাম ফারুক বলেন, ‘তার (খোকন বেপারীর) বাবার কথা আমরা শুনেছি, এতে কিছু যায় আসে না। সবচেয়ে যোগ্যতম ও দায়িত্ববান প্রার্থী হওয়ায় তাকে প্রার্থী হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নিয়ে একটি স্বার্থন্বেসী মহল অপপ্রচার করছে’। কেন্দ্রীয় কৃষকলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাকিলুর রহমান সোহাগ বলেন, ‘তিনি ছাত্রলীগ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একজন ব্যক্তি। তিনি জাতীর বীর সন্তান’। এক প্রশ্নের জবাবে উপজেলা আ’লীগের সভানেত্রী তাহমিনা সিদ্দিকী বলেন, ‘কেন্দ্রীয় নির্দেশ মোতাবেক একক প্রার্থী নির্ধারণ করতে গিয়ে মনোনায়ন কমিটি তাকে যোগ্য বিবেচনা করায় প্রার্থী হিসেবে চুরান্ত করা হয়েছে’। পৌর আ’লীগের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দুলাল বলেন, ‘রাজাকার পুত্র বলে অপপ্রচার করায় পৌরবাসী মর্মাহত হয়েছে’।

পৌর নির্বাচনে একক প্রার্থী নির্ধারণ ও এই সময়ের আলোচিত শব্দ ‘রাজাকার’ স¤পর্কে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের ভূমিকা জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান ও আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক মীর গোলাম ফারুক বলেন, ‘এতে যোগাযোগমন্ত্রীর কোনো ভূমিকাই নেই। মনোনায়ন কমিটিই প্রার্থী চুরান্ত করেছে’।

আ’লীগের নির্ধারণকৃত প্রার্থী খায়রুল আলম খোকন বেপারীর বাবার স¯প্রর্কে জানতে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সাংসদ কমান্ডার এসকান্দার সিকদারের বাড়িতে গেলে তিনি উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, ‘তার বাবা শান্তি কমিটিতে ছিলেন কিন্তু আমাদের তেমন কোনো ক্ষতি তিনি করেননি’।