বিভিন্ন বস্তিতে অগ্নিকান্ডের নেপথ্য কারণ

উচ্ছেদের শিকার হওয়ার আগে প্রত্যেকবারই অগ্নিকান্ডের শিকার হন বস্তিবাসীরা। এটিই সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এছাড়াও সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে বস্তির নিয়ন্ত্রণ হাতবদলের ধারাবাহিকতায় আগুন লাগিয়ে দেয় একপক্ষ। এতে নিঃস্ব এ মানুষগুলোর তলানীতে জমে থাকা শেষ সঞ্চয়গুলো পর্যন্ত হারাতে হয়। ফলে আতংকিত বস্তিবাসীরা নেতৃত্বের পরিবর্তনকে মেনে নেন।

প্রতিটি সরকারের আমলেই এভাবে অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন দেশের বস্তিবাসীরা। রাজধানীর বেশ কয়েকটি বস্তি উচ্ছেদের আগেও বারবার আগুন লাগিয়ে তাদের বিতাড়িত করা হয়েছে। জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন হলে তারা আগুনের পর সেখানে ভবন তুলছেন। আর সরকারী জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদের পর সেখানে সরকারী সুদৃশ্য ভবন তৈরী হয়েছে। সর্বশেষ ৮ জানুয়ারী তেজগাঁয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ি এলাকায় আগুনের পেছনেও উচ্ছেদের সম্পর্ক রয়েছে বলে সেখানকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের হিসেবে ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে সারা দেশের বস্তিতে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা ১২৩টি। এর মধ্যে ২০০৫ সালে বস্তিতে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা ১৯টি। এতে ক্ষতির পরিমান এক কোটি ৭০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। ২০০৬ সালে বস্তিতে অগ্নিকান্ড ঘটে ৩০টি । এত ক্ষতি হয় এক কোটি ১০ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ২০০৭ সালে বস্তিতে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা ২৮টি। এসব অগ্নিকান্ডে এক কোটি ৮৬ লাখ ৬০ হাজার টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। ২০০৮ সালে এ ধরনের অগ্নিকান্ডের সংখ্যা ২৫টি। এতে ক্ষতি হয়েছে চার কোটি ৯৫ লাখ ৭৪ হাজার টাকার সম্পত্তি। আর গত বছর এ ধরনের অগ্নিকান্ডের সংখ্যা ছিল ২১টি। এতে দুই কোটি ৫৭ লাখ ৩৯ হাজার টাকা ক্ষতি হয়েছে। সরকারী হিসাবেই গত পাঁচ বছরে আগুনের কারণেই ১৩ কোটি টাকার সম্পদ হারিয়েছেন বস্তিবাসী। এসময় ১৩ লাখ টাকারও কোরন সরকারী সাহায্য তাদের মিলেনি।
রাজধানীর কয়েকটি বস্তিতে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে সেখানের প্রায় সকল বাসিন্দাদের ভাড়া পরিশোধ করতে হয়। কতিপয় লোক বস্তিতে জায়গা দখল করে বাড়ির মালিক সেজে বসেছেন। তারা ওইসব ঝুপড়ি ঘর বস্তিবাসীদের কাছে ভাড়া দেন। তবে কোন বস্তিতে অগ্নিকান্ড হলে শুধু বস্তিবাসীরাই ক্ষতিগ্রস্থ হন। বস্তি থেকে বের হওয়ার কোন প্রশস্ত রাস্তা না থাকার দরুন আগুন লাগলেই তাদের সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিচালক মেজর এমএম মতিউর রহমান বলেন, আমরা বস্তির আগুন মোকাবেলা ও উদ্ধার করতে গেলে এ ধরনের অভিযোগ পাই। তবে কারা আগুন দিয়েছেন এটা পুলিশী তদন্তের ব্যাপার। আর তাদের অভিযোগ সত্য হলেও তা বের করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কোন দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করলে অবশ্য তা বের করা সম্ভব। তবে কোন বস্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের কোন পরীক্ষা করা হয়নি। এছাড়াও বস্তিগুলোতে আগুন লাগলেও ফায়ার সার্ভিসের অগ্নি নির্বাপক গাড়িগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেখানে পৌছতে পারেনা। কেননা ওইসব জায়গা গাড়ি চলাচলের জন্য উপযুক্ত নয়। ফলে এরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

পাঁচ বছরে রাজধানীর বস্তিতে আগুন
২০০৯ সালে রাজধানীতে রাজধানীর ছয়টি বস্তি অগ্নিকান্ডের শিকার হয়েছে। এ বছরের ২৭ জানুয়ারী ২৪৯ উত্তর জুরাইন, শ্যামপুরের বস্তিতে আগুন লাগে। পানির ওপর বাশের খুটির ওপর এসব বস্তি ছিল। আগুনে একশটি ঘর পুড়ে যায়। ৬ এপ্রিল মিরপুর-২, জনতা হাউজিং এর সামনের বস্তিতে আগুন লেগে ৮৫টি ঘর পুড়ে যায়। ৮ এপ্রিল পশ্চিম রায়ের বাজার সিকদার মেডিকেলের উত্তর পাশে ৩০টি বস্তিঘর পুড়ে যায়। গত ২২ নভেম্বর মগবাজার রেল গেট ওয়ারলেস বস্তিতে আগুন লঅগে। এতে অনেক এলাকা জুড়ে ডোবার ওপরে নির্মিত ৮০০ টংঘর পুড়ে যায়। এসময় সম্পদ রক্ষঅ করতে গিয়ে আলয়া বেগম নামের একজন বস্তিবাসী ট্রেনের আঘাতে নিহত হন। পরে তার পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। এসব অগ্নিকান্ডে বস্তির নিয়ন্ত্রণও বদল হয়েছে। বর্তমানে সকল বস্তিই ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের দখলে রয়েছে।

২০০৮ সালে রায়ের বাজারে নিমতলী বস্তির দেড় হাজার ঘর পুড়ে যায়। ২ ফেব্রুয়ারী গ্যান্ডারিয়া রেল লাইন বস্তির দুইশ ঘর ভষ্মিভূত হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারী মোহাম্মদপুর টিক্কাপাড়া বস্তির ৮০টি ঘর পুড়ে যায়। এ অগ্নিকান্ডকে অজ্ঞাত কারণ হিসেবে দেখিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ৯ এপ্রিল গেন্ডারিয়ার বস্তিতে ছুড়ে দেয়া অব্যবহৃত সিগারেট হতে আগুন লেগে ২২টি ঘুপরি ঘর পুড়ে যায়। ৪ জুন তেজগাঁও রেলওয়ে ১ নং গেট বস্তিতে আগুন লাগে। ফয়ার সার্ভিসের হিসেবে জ্বলন্ত সিগারেট থেকে এ আগুনের উদ্‌ভব। তবে বস্তিবাসীরা জানিয়েছে, মাদকের ব্যবসা ও বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিতেই এ আগুন দিয়েছে মাদকাসক্তরা। ২২ অক্টোবর মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানের ঢালের বেরিবাধে ৫০ টি ঘর পুড়ে যায়। উচ্ছেদের জন্য এদের ঘরে আগুন দেয়া হলেও ফায়ার সার্ভিস বলছে কারণ অজ্ঞাত। ১৬ নভেম্বর কামরাঙির চরের নিজামবাগ টংঘর বস্তিতে আগুন লেগে ৫২টি ঘর পুড়ে যায়।

২০০৭ সালে রাজধানীর ১০টি বস্তিতে অগ্নিকান্ড হয়। ১১ জানুয়ারী গেন্ডারিয়ার নামাপাড়া বস্তিতে আগুন লাগে। পরদিন মগবাজার দিলু রোডের রেল লাইন বস্তিতে আগুন লাগে। এ বস্তি হাতির ঝিল প্রকল্পের নামে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এর আগে বেশ কয়েকবার এ বস্তিতে আগুন দেয়া হয়। ১৯ জানুয়ারী মিরপুর ২ নং হাজীরোড, ঝিলপাড় শিয়ালবাড়ি বস্তিতে আগুন দেয়া হয়। এছাড়াও এবছরের ২২ জানুয়ারী মেহাম্মদপুর বাসবাড়ি বস্তি, ১৩ ফেব্রুয়ারী মোহাম্মদপুর জেনেভো ক্যাম্প বস্তি, ১৯ মার্চ মহাখালির সিএন্ডবি কলোনি বস্তি, ১৯ এপ্রিল কচুক্ষেত বস্তি, ৩০ মে দক্ষিণ রসুলপুর কামরাঙির চর বস্তি, ৮ জুলাই গুদারাঘাট, মিরপুর-১ বস্তি আগুনে ভষ্মিভূত হয়।

২০০৬ সালে ১০ জানুয়ারী লালবাগের শহীদনগন বস্তি, ২৪ জানুয়ারী দয়াগঞ্জের করাটিটোলা বস্তি, ২৫ জানুয়ারী ডেমরার কমারগব বাজার বস্তি, ১৩ জুলাই তেজগাঁয়ের সমিতিবাজার বস্তি, ২৭ জুলাই মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামের পাশের বস্তি আগুনে ভস্মিভূত হয়। এছাড়াও ওই বছর ১৫ অক্টোবর, ১০ অক্টোবর, ২ ডিসেম্বর ও ১০ ডিসেম্বর রাজধানীতে বেশ কিছু বস্তি পুড়ে যায়।
২০০৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারী ১০ নং পশ্চিম ভাষানটেক বস্তি নিয়ন্ত্রণ নিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ১০ ফেব্রুয়ারী মেহাম্মদপুরের জেনেভাক্যাম্প বস্তিতে আগুন লাগে। ১৫ ফেব্রুয়ারী খিলগাঁেয়র মিরের টেক, হাজীপাড়া বস্তিতে আগুন লাগে। ১১ এপ্রিল পুরান ঢাকার আরমানিয়া স্ট্রিটের পাশের বস্তিতে আগুন লাগে। ২৮ এপ্রিল মিরপুর -১৪ এর ৩ নং দামালকোট বস্তিতে আগুন লাগে। ১৩ অক্টোবর মিরপুরের বেগুন টিলা বস্তিতেও অগ্নিকান্ড ঘটে। তবে এর কোন অগ্নিকান্ডেরই পূর্ণ তদন্ত হয়নি।

কোন মামলা হয়নিঃ
বস্তির অগ্নিকান্ড নিয়ে কোন মামলা হয়নি। বস্তিবাসীদের নেতারা জানিয়েছেন, মামলা করতে গেলে পুলিশ আগুনদাতার নাম পরিচয় জানতে চায়। ফলে আমরা আর মামলা করতে পারিনা। বস্তিবাসী সংগ্রাম পরিষদের নেতা মহির উদ্দিন জানান, আমার ঘরে অগ্নিকান্ডের পর পুলিশ নামধাম জানতে চায়। এটাতো পুলিশের তদন্ত করার কথা ছিল। তারা তা করেনি। উল্টো তারা কোন আগুন লাগলেই বলে সর্ট সার্কিটের কথা। বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকলে বলে সিগারেটের আগুন থেকে আগুন লেগেছে। ফলে এসব ঘটনা রহস্যাবৃত থেকে যায়। তিনি বলেন, সব সরকারই বস্তিবাসীদের বিরুদ্ধে কার্যক্রম হাতে নেয়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই বিচারপতি লতিফুর রহমান বস্তি উচ্ছেদকে অবৈধ বলে আদেশ দিলেন। পরে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার পর ফের উচ্ছেদের শিকার হই। অন্যদিবে বেগুনবাড়ি বস্তিতে সাম্প্রতিক অগ্নিকান্ডে কোন মামলা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো� ওমর ফারুক বলেন, ওই আগুনকে নাশকতা হিসেবে কেউ অভিযোগ করেনি। সেজন্য কোন মামলাও হয়নি। তবে আমরা একটা সাধারণ ডায়রি করেছি। এ বিষয়ে থানা পুলিশ ও সিআইডি অনুসন্ধান করে দেখছে। বিষয়টি তদন্তাধিন। পুলিশ এ মামলাটিকে তদন্তাধিন বললেও আগের কয়েকটি অগ্নিকান্ডের তদন্তের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে তারা এসব অগ্নিকান্ডকে কোন নাশকতা হিসেবে দেখেনি।

বেগুনবাড়ির আগুনের নেপথ্যেঃ
বেগুনবাড়ি বস্তির আগুনের কারণ হিসেবে বলা হয়েছে গ্যাসের পাইপ ফেটে আশপাশের ভবনে আগুন লেগে যায়। তবে এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন অন্যকথা। তারা বলছেন, হাতিরঝিল লেক প্রকল্পের বাধা দূর করতেই পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ ওই প্রকল্পের ফলে বেগুনবাড়ি এলাকা থেকে কয়েক হাজার বাড়ি উচ্ছেদ করা হয়েছে। তবে অগ্নিকান্ড সংলগ্ন এলাকায় ৫০ থেকে ৬০টি বাড়ির মালিকরা উচ্ছেদের বিরুদ্ধে উচ্চাদলতের দারস্থ হন। আদালত উচ্ছেদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এতে প্রকল্পের কাজও ওই এলাকায় থেমে গেছে। এরপরপরই প্রকল্পের লোকজন ভেকো মেশিন দিয়ে গ্যাস পাইপ তুলে ভেঙ্গে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পরই পাইপের ভাংগা স্থানে আগুন ধরে যায়। আগুনে ক্ষতিগ্রস্থ বাড়ি ৫/১ডি/১ এর মালিক সালাহউদ্দিন জানান, আমার ভবনের পাশেই ওই গ্যাসের পাইপ ছিল। প্রকল্পের লোকজন সেখানে গিয়ে ভোকো মেশিন নিয়ে কাজ করে। এসময় তাদের পাইপের ব্যাপারে সতর্ক থাকার জন্য অনুরোধ করি। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে ভেকো মেশিন দিয়ে ওই পাইপ টান দেয়। এতে আমার ভবনের পাশে পাইপটি ভেঙ্গে গিয়ে গ্যাস বের হতে শুরু করে। এসময় গ্যাস যাতে বের হতে না পারে সেজন্য ওই মেশিন দিয়েই কিছু মাটিচাপা দিতেও অনুরোধ করি। কিন্তু তারা কোন কথা না শুনে চলে যায়। এরপরই প্রচন্ড বিষ্ফোরণের সঙ্গে আগুন লাগে। ৫/৭, বি দক্ষিণ বেগুনবাড়ির বাসিন্দা সৈয়দ বেলাল হোসেন বলেন, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও প্রকল্পের প্রবেশ পথে ২০ মিনিট ধরে আটকে রাখা হয়েছিল। এর মধ্যেই সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ওই এলাকার ফারুক জানান, আমরা অধিগ্রহনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। কারণ সরকার আমাদের কাঠাপ্রতি জমির মূল্য চার লাখ টাকা করে দিচ্ছে। অথচ এ এলাকার জমির কাঠাপ্রতি মূল্য ৫০ লাখ টাকার ওপর। আদালতও বিষয়টি অনুধাবন করে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। এরপরও গ্যাস বিদ্যুৎ লাইন কেটে দিয়ে আমাদের উচ্ছেদের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। সবকিছু ব্যর্থ হওয়ারপরই এ অগ্নিকান্ড। এর কারণ উচ্ছেদ বলেই আমরা মনে করছি।

পাল্টে গেছে নিমতলী বস্তির চেহারা
২০০৮ সালের ১১ জানুয়ারী রাজধানীর রায়ের বাজার এলাকার নিমতলী বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছিল। ওই ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের হিসাবেই দেড় হাজার টংঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। পানির ওপর বাশের সাহায্যে ওইসব টংঘর তৈরী করা হয়েছিল। ওই বস্তিবাসীরা ওই আগুনকে নাশকতা বলেই উল্লেখ করেছিলেন। আগুনে ক্ষতিগ্রস্থরা যারা এখানো ওই এলাকায় রয়েছেন তারাও একই অভিযোগ করেছেন। ২৫২, সুলতানগঞ্জ রোডের বাসিন্দা মো� হারুন চৌকিদার বলেন, এ বস্তিতে অগ্নিকান্ডের আগে ২০ হাজার টংঘর ছিল। ওই সময় এ এলাকাটি ট্যানারির বর্জের কারণে মারত্মক দুষিত ছিল। ট্যানারির বর্জ� ও ময়লা পানির ওপরেই বাশতুলে তৈরী করা হয়েছিল এসব বস্তি। লোকজন নৌকায় চড়ে বস্তিতে গিয়ে উঠতো। তবে ২০০৩ সালের পর থেকে এলাকায় উন্নয়নের ছোয়া লাগে। এরপরই সবার নজর পড়ে বস্তি উচ্ছেদের দিকে। অগ্নিকান্ড দক্ষিণ- পশ্চিম দিকের তানভীর হাসান প্রিন্সের বাড়ি থেকে শুরু হয়। ওই ঘরে ছুড়ে দেয়া পেট্রোলের ফোটা একজন বাসিন্দার গায়েও গিয়ে লেগেছিল। আগুনে বস্তির উত্তরের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ওই বস্তিতে বিসমিল্লাহ ফ্যাশন কারখানা কাজ করতেন মো� শরীফ। তিনি জানান, অগ্নিকান্ডের পর সবাই উদ্ধার আর ক্ষয়ক্ষতি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এলাকাটিও লোকে লোকারন্য হয়ে যায়। গণমাধ্যমও ওই সময় এসে চলে যায়। ফলে কারা আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল তা ঢাকা পড়ে যায়।
দেখা গেল নিমতলীর ওই এলাকার বেশিরভাগ অংশেই এখন মাটি ভরাট করা হয়েছে। প্লট করে তার মধ্য দিয়ে সড়ক করা হয়েছে। সেখানে উঠে গেছে বহুতল ভবন। বস্তিবাসীদের আশংকা এ বছরের মধ্যেই পুরো এলাকা একটি আবাসিক এলাকায় পরিণত হবে। আর আগুন লাগানোর কারণটাও এখন পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে।

টিক্কাপাড়া বস্তি উচ্ছেদে তিনবার আগুন
মোহাম্মদপুরের বিজলি মহল্লায় ছিল টিক্কাপাড়া বস্তি। এটি গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে উচ্ছেদ করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারী ওই বস্তিতে আগুন দেয়া হয়। পরে লোকজন ঘর তুলতে গেলে তাদের তা করতে দেয়া হয়নি। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ওই এলাকা ছাড়া করা হয়।
টিক্কাপাড়া বস্তির একজন বাসিন্দা গোলাম রব্বানী বাবুল বলেন, আমি এই এলাকায় ৩০ বছর ধরে বাস করে আসছিলাম। এখানে কম হলেও ১০ হাজার বস্তি ঘর ছিল। কিন্তু ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা নেয়ার কিছু দিন পরেই বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। হাতবদল হয় বস্তির নিয়ন্ত্রণ। এরপর গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ফের উচ্ছেদের নোটিশ দেয়। বস্তিবাসী এ নোটিশকে কোন পরোয়া না করে বস্তিতে থাকারই সিদ্ধান্ত নেয়। এর কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় একদল যুবক আগুন লাগিয়ে দেয়।

বস্তির পাশে খাইরুল সাহেবের বাড়িতে থাকেন বৃদ্ধা রাজিয়া খাতুন। তিনি বলেন, �সরকার আমগোরে প্রথম আগুন দিছে। আমরা ফের ঘর তুলবার গেলাম। এবার পুলিশ দিয়া ভাইঙা আমসাগো এলাকা ছাড়া করলো।� ২০/৬,এ বিজলি মহল্লায় বাস করেন আয়শা বেগম। তিনি বলেন, এখন সরকার এ জায়গায় বহুতল ভবন তুলতে চায়। আগুন দিয়ে আমাদের যে সম্পদের ক্ষতি করছে তার কোন ক্ষতিপূলণ সরকার দেননি। সরকার ওয়াদা করেছিল এ জায়গায় আমাদের স্থান দেয়া হবে। এখন সবাই প্রতিশ্রতি ভুলে গেছে। এ বস্তির সাবেক বাসিন্দা হাসিনা আক্তার বর্তমানে ২০/১৬ বিজলি মহাল্লায় থাকেন। তিনি বলেন, আমি এই বস্তিতে ৪০ বছর ধরে বসবাস করে আসছিলাম। ওই সময় এখানে পানি ছিল। আমরা আস্তে আস্তে জায়গাটা ভরাট করে উচু করার পরই সরকারের নজরে পড়ে। আমাদের উচ্ছেদ করার জন্য এমন কোন পন্থা নেই যে সরকার তা গ্রহণ করেনি। আমরা প্রতিবাদ করায় আগুন লাগিয়ে আমাদের সর্বহারা করে খেদিয়ে দিয়েছে। ২১/৭, বিজলি মহল্লার বাসিন্দা সেলিনা আক্তার বলেন, আগুন যেখানে শুরু হয়েছিল সেখানেই আমার বাড়ি ছিল। আমি নিজেই পেট্রোলের গন্ধ পেয়েছি।

আগুন দিয়েই উচ্ছেদ আগারগাঁও বস্তি
আগারগাঁও বস্তি উচ্ছেদের আগে তিনটি সরকার দশ বছর ধরে তাদের উচ্ছেদ করতে চেষ্টা চালিয়েছে। অবশেষে আগুনই উচ্ছেদকে সম্ভব করেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পরই একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ পঙ্গু হাসপাতালের সামনের অংশে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় গিয়ে এ বস্তিটি উচ্ছেদে জোর প্রচেষ্টা চালায়। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের কয়েকদফা সংঘর্ষও হয়। পরে তাদের উচ্ছেদ করতে পুরানো কায়দায় আগুন লাগানো হয়। ২০০১ সালের ১১ মার্চ রাত তিনটায় এ বস্তিতে আগুন দেয়া হয়। এ আগুনেই কাবু হয় বস্তিবাসী। ১৪ মার্চ পরিবেশ ভবনের দক্ষিণ পাশে বস্তিবাসী সংগ্রাম পরিষদের নেতা মহির উদ্দিনের ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। ওই সময় তিনি এজন্য পুলিশকে দায়ী করেছিলেন। বস্তিবাসী ইউনিয়নের নেতা মহির উদ্দিন বলেন, জায়গা দখলের জন্যই এ আগুন দেয়া হয়। এ আগুন কারা দেয় তাদের ধরতে পারিনি। তবে আগাঁরগায়ে পুলিশ ও তাদের সোর্সরাই আগুন দিয়েছিল। এ পর্যন্ত কড়াইল বস্তিসহ রাজধানীর বেশিরভাগ বস্তি থেকেই আগুন দিয়ে বস্তিবাসীদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এদিকে আগারগাঁও বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, একপাশে সরকারী বিভিন্ন ভবন তৈরী করা হলেও কিছু বস্তিঘর রয়ে গেছে। অনেক পরিবার খালি জায়গায় স্থায়ী কোন ঘর তৈরী না করলেও রাতে পলিথিন টাঙিয়ে শুয়ে থাকেন। এদের একজন মো� আবদুল কুদ্দুস (৬৫) বলেন, আমাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। কোন সম্পদও অবশিষ্ট নেই। জীবনে যা আয় করেছিলাম তা তিনটি আগুনেই শেষ হয়ে গেছে। বস্তিতে থেকে গতর খেটেও জীবনের শেষে আর কোন সঞ্চয় রইলনা।


 

কাজী সায়েমুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতোকত্তোর। জন্ম ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়ায়। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের বাউফলের ঐতিহ্যবাহী জমিদার কাজী পরিবার। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখিতে হাতে খড়ি। তবে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত হন। তিনি যুগান্তর স্বজন সমাবেশের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহবায়ক। ২০০৪ সালে তিনি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। বর্তমানে ইংরেজী দৈনিক নিউ এজ এর বাংলা প্রকাশনা সাপ্তাহিক বুধবারের সিনিয়র প্রতিবেদক হিসেবে কর্মরত। তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজী, আরবী, উর্দ্দু ও হিন্দী ভাষা জানেন। ছোটবেলা থেকেই কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে পরিচিত। স্কুল জীবনে তার লেখা বেশ কিছু ছড়া ও কার্টুন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়।