মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জন্ম জয়ন্তী আজ

বিনিময়ে আটকোটি তফসিলীর সার্বভৌম মুক্তি আসিবে। তবে আমি সে মৃত্যুকে তিলে তিলে বরণ করিতে পারিব। যাদি সমুদ্রে ঝাঁপ দিলে অথবা জলন্ত অগ্নিকুন্ডে আমাকে নিক্ষেপ করিলে সে মুক্তি মেলে, তবে আমি দুর্বার আকাঙ্খা লইয়া তাহাতেই ঝাঁপাইয়া পড়িব।” বানীটি লিখেছিলেন মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।

মহৎ কাজের জন্য তিনি আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। তাইতো তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে “মহাপ্রান”র খেতাব দিয়েছেন। অবিভক্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রী সভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী সোহয়ারর্দীর মন্ত্রী সভার বিচার ও পূর্ত মন্ত্রী, ভারতের অন্তবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী এবং পাকিস্তান সরকারের আইন ও শ্রম মন্ত্রী ছিলেন বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মৈস্তারকান্দি গ্রামের যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। তিনিই প্রথম সাশনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেন। এছাড়াও অবিভক্ত ভারত বাংলা প্রদেশের সাধারন আসন বৃহত্তর বাকেরগঞ্জের পূর্ব-উত্তর এলাকায় ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রথম এমএলএ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল।

আমৃতু পর্যন্ত তিনি, নির্যাতিত-নিপীরত, শোষিত-অনুন্নত, শিক্ষা-দীক্ষায় পশ্চাদপদ, সামাজিক ভাবে অবহেলিত, দরিদ্র-অর্থক্লিষ্ট ও রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত মানুষের সার্বিক উন্নয়ন এবং অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। ফলশ্র“তিতে তিনি ভারত সরকারের দেয়া মহাপ্রান’র খেতাব অর্জন করেছেন। মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ১০৮ তম জন্ম জয়ন্তী উৎসব আজ শনিবার। এ উপলক্ষে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মৈস্তারকান্দি গ্রামের মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জন্মভূমিতে এলাবাসির উদ্যোগে দু’দিনব্যাপী (২৯ ও ৩০ জানুয়ারি) নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। 

গতকাল শুক্রবার গৌরনদী উপজেলার বার্থী ইউনিয়নের প্রত্যন্ত মৈস্তারকান্দি গ্রামের মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের স্মৃতিবিজরীত জন্মভূমি ঘুরে জানা গেছে নানা অজানা তথ্য। মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদের ইতিহাস ও গবেষনা বিষয়ক সম্পাদক এবং বাংলার গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মজিদ জানান, ১৯০৪ সনের ২৯ জানুয়ারি মৈস্তারকান্দি গ্রামের কৃষক রাম দয়াল মন্ডল ও সন্ধ্যা দেবীর ঘর আলোকিত করে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এ ধরায় (জন্মগ্রহন করেন) আসেন। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। স্থানীয় বালাবাড়িতে গ্রাম্য পাঠশালার মাধ্যমে তার বাল্য শিক্ষার জীবন শুরু হয়। পরবর্তীতে চতুর্থ শ্রেনীতে বার্থী তাঁরা ইনষ্টিটিউশনে ভর্তি হন। সেখান থেকে ১৯২৪ সনে প্রবেশিকা (মেট্রিকুলেশন) পাশ করেন। ওই বছরেই বরিশাল বিএম কলেজে আই.এ ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে আইএ ও ১৯২৯ সনে বিএ পাশ করেন। ১৯৩৪ সনের জুলাই মাসে কোলকাতা আইন কলেজ থেকে এল.এল.বি পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সনে প্রথমে কোলকাতায় ও একই বছরে বরিশালে আইনজীবি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৩৭ সনে অবিভক্ত ভারতের আইনসভার একটি মাত্র সাধারন আসনে তফসিলী জাতির একমাত্র প্রার্থী হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এমএলএ নির্বাচিত হন। এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রী সভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ১৯৪৬ সনের নির্বাচনে পূর্ণরায় এমএলএ নির্বাচিত হয়ে সোহয়ারর্দীর মন্ত্রী সভার বিচার ও পূর্ত মন্ত্রীর গুরু দায়িত্ব পরে তার কাঁধে। শেষভাগে অবিভক্ত ভারতের অন্তবর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ভারতের নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সাথে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ছিলো গভীর সম্পর্ক। সবশেষে সোহয়ারর্দীর অনেক অনুরোধের পর ১৯৪৭ সনে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রী সভার আইন ও শ্রম মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই (যোগেন্দ্রনাথ) প্রথম সাশনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেন। ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৫০ সনে দেশের রায়ট শেষে তিনি (যোগেন্দ্রনাথ) রায়ট উপদ্রত্য অঞ্চল পরিদর্শন করেন। একপর্যায়ে তিনি তার স্ব-জাতি, অনুন্নত জনসাধারনের জানমাল ও অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় রাজধানী করাচীতে ফিরে তিনি মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। কিন্তু তার এ পদত্যাগের বিষয়টি কোন ভাবেই মেনে নিতে রাজি হননি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। একপর্যায়ে বীরের বেশে পাকিস্তান থেকে ট্রেনযোগে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন মন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ভারতে ফিরে আট পৃষ্টায় কারন দশীয়ে মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করে পাকিস্তান সরকারের কাছে পদত্যাগ পত্র প্রেরন করা হয়। তৎকালীন সময়ে ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় এ রির্পোটটি ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছিলো। পরবর্তী সময়ে শরনার্থীদের কল্যানে বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে তার পৃষ্ঠপোষকতা করেন যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ১৯৬৮ সনে ভারতের চব্বিশ পরগনার স্ব-জাতি বন্ধুর বাড়িতে খাবার খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে পরেন তিনি। তড়িঘড়ি করে ভারতে ফেরার পথিমধ্যে মহাপ্রনয়ন ঘটে মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের। চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙ্গা এলাকায় সমাহিত করা হয় যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে। তার মৃত্যুর পর ভারত সরকার তাকে (যোগেন্দ্রনাথকে) মহাপ্রানের খেতাব দিয়েছেন।

সূত্রমতে, মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের একমাত্র পুত্র জগদ্বীশ মন্ডল (৮০) পরিবার-পরিজন নিয়ে ভারতেই বসবাস করছেন। মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথের জন্মভূমিতে এখন তার পৌত্রদ্বয় (নাতীরা) বসবাস করছেন। যোগেন্দ্রনাথের বড়ভাই মহানন্দ মন্ডলের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ, তার পুত্র দ্বিজেন্দ্রনাথ মন্ডল ওরফে ঝন্টু ও প্রদ্বীপ কুমার মন্ডল ওরফে মন্টু তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে মৈস্তারকান্দি গ্রামে বসবাস করছেন। দিনমজুরের কাজ করেই চলছে ঝন্টু ও মন্টুর সংসার।

স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক মনোজ কুমার গোমস্তা জানান, দীর্ঘদিন থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে পারিবারিক ভাবে মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জন্ম জয়ন্তী পালন করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে গ্রামের সকল ধর্মের লোকজন একত্রিত হয়ে মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি পরিষদ নামের একটি সংগঠন তৈরি করে। এ বছরই কেবল বৃহৎ পরিসরে স্থানীয় সেবা আশ্রম প্রাঙ্গনে মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের ১০৮ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে ব্যাপক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। 

অনুষ্ঠান সূচীর মধ্যে রয়েছে ২৯ জানুয়ারি সকালে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ, মহাপ্রান যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের প্রতিকৃতিতে পূস্পার্ঘ অর্পন ও মাল্যদান, শ্রীমদভগবত গীতা পাঠ, দুপুরে ভক্তি গীতির অনুষ্ঠান, মহাপ্রান যোগেন্দ্র নাথ মন্ডলের জিবনী ও সংগ্রামী কার্যক্রমের ওপর আলোচনা সভা এবং ২৯ ও ৩০ জানুয়ারি দু’দিন রাতেই কবি গানের আয়োজন করা হয়েছে। আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য এডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন গৌরনদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব শাহ আলম খান, গৌরনদী পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র মোঃ হারিছুর রহমান হারিছ, গৌরনদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন, গৌরনদী থানার অফিসার ইনচার্জ ওসি মোঃ নুরুল ইসলাম-পিপিএম, দেশবরেন্য জিতেন লাল ভৌমিক, পঙ্কজ সরকার, অসীম কুমার বাড়ৈ, বিনয় ভূষন হালদারসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন।

স্থানীয় লক্ষি কান্ত বৈদ্ধ, মনোতোষ সরকার, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সামসুল হক সরদারসহ অনেকেই জানান, মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এতদাঞ্চলে শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে অসংখ্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কর্মস্থলের সুযোগ করে দিয়েছেন সহস্রাধীক বেকার-যুবকদের। এছাড়াও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের পাশ্ববর্তী বেতগাতি-বাশাইল ভায়া মৈস্তারকান্দির জনগুরুতপূর্ণ খালটি খনন করানো হয়েয়ে যোগেন্দ্রনাথের সময়েই।

গ্রামবাসি মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের স্মৃতিবিজরীত জন্মস্থান মৈস্তারকান্দি গ্রামে মহাপ্রানের নামানুসারে স্মৃতিজাদুঘর, পাঠাগার, গবেষনা কেন্দ্র ও একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মানের জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে জোড় দাবি জানিয়েছেন।