বঙ্গবন্ধুর চিঠি নিয়ে আজো কাঁদেন মোমেনা

উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ-মাতৃকার মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে পাক-হানাদার দস্যুবাহিনীর হাতে গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। এই দুঃসাহসিক ঝুঁকি নেয়ার জন্য আপনাকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। আপনার মতো নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমিক বীর সন্তনরাই উত্তরকালে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের নিশ্চয়তায় এক অত্যুজ্জ্বল আদর্শ হিসেবে প্রেরণা যোগাবে। প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল থেকে আপনার ও আপনার পরিবারের উপকারর্থে আপনার সংশ্লিষ্ট (বরিশাল) মহকুমা প্রশাসকের নিকট ৫’শ টাকার চেক প্রেরিত হল (চেক নম্বর-ফিএ-০৩৮১৫০)। আমার প্রাণভরা ভালবাসা ও সংগ্রামী অভিনন্দন নিন। ইতি-শেখ মুজিব।

দেশ স্বাধীনের পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতার স্থপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজহাতে স্বাক্ষর করে উল্লেখিত চিঠিটি দিয়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকসেনাদের গুলিতে পঙ্গুত্ব বরনকারী যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা বরিশালের গৌরনদী উপজেলার আশোকাঠী গ্রামের কালু সরদারকে। তৎকালীন বরিশাল জেলা প্রশাসকের কাছে (স্মারক নং প্রত্রাক ৬-৪-৭২/সিভি- ৪৫৫, তারিখ: ২৪-০২-১৯৭২ ইং) চিঠিটির নিচেই ছিলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ব-হস্তের স্বাক্ষর।
বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরিত ওই চিঠিটিকে বুকে নিয়ে আজো কাঁদেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম কালু সরদারের স্ত্রী মোমেনা বেগম (৭৪)। নানারোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় শষ্যাশয়ী মোমেনা বেগম হাউমাউ করে জনকন্ঠের এ প্রতিনিধির কাছে বলেন-“মোর সোয়ামি (স্বামী) দ্যাশের বীর আছিলো। যুদ্ধ করতে যাইয়া হ্যার বাও (বাম) পায়ে ১১ ডা গুলি ল্যাগছেলো। হেইয়ার লাইগ্যা শেখ সাইবে (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান) খুশি অইয়া মোর সোয়ামীরে একখান কাগজ (সনদ) দেছে। মোর সোয়ামি মরার পর পোলাপান লইয়া মুই আছি না মইরা গেছি, কেউই মোর খবর ন্যায় নায়। কেউই ইট্টু (একটু) সাহায্যও করে নায়। চিঠিটি দেখিয়ে বলেন, শেখ সাইবের এই চিঠিডা লইয়া যে কতো মেম্বার-চেয়ারম্যানগো ধারে গেছি সাহাষ্যের লাই¹া। সাহাষ্যতো দূরের কতা কেউ মোর কোন কতাই হোনেনায়। শেখ সাইবের এই চিঠিটাই হইছে মোর শ্যাষ ভরসা। বলেই চিঠিটি বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীরের বিধবা স্ত্রী মোমেনা বেগম।

দীর্ঘক্ষন বিধবা মোমেনা বেগমের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তার স্বামী কালু সরদার রিকসা চালিয়ে আট সদস্যর পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করতেন। দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্ত্রী ও ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের কথা না ভেবেই দেশ স্বাধীনের জন্য তিনি নিজের জীবন বাঁজি রেখে পাক হানাদার প্রতিরোধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। স্ত্রী, ৫ পুত্র ও ১ কন্যাকে নিয়েই ছিলো কালু সরদারের সংসার। যুদ্ধ চলাকালীন সময় তার বড়পুত্র রাজ্জাক সরদারের বয়সছিলো মাত্র ১৩ বছর আর ছোট পুত্র ফরহাদের বয়স ছিলো মাত্র দু’বছর। ১৯৭১-এর আগষ্ট মাসের শেষের দিকে উজিরপুরের জয়শ্রী এলাকায় পাক হানাদারদের সাথে সম্মুখ যুদ্ধে তার (কালু সরদারের) বাম পায়ে ১১ টি গুলি বৃদ্ধ হয়।

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কালু সরদারের মেঝ পুত্র হতদরিদ্র দিনমজুর আব্দুস সাত্তার সরদার বলেন, অভাবের সংসারে অর্থাভাবে বাবাকে (কালু সরদারকে) সু-চিকিৎসা করাতে পারিনি। দেশের জন্য যে নিজের জীবন বাঁজি রেখে ছিনিয়ে এনেছিলেন সবুজে রক্তে লাল বিজয় পতাকা, সেই বীর সৈনিক আমার বাবা কালু সরদার বিনাচিকিৎসায় ধুকে ধুকে ১৯৯৩ সালের ৭ আগস্ট মৃত্যুবরন করেছেন। 

তিনি আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর চিঠিটি নিয়ে মোর রোগাক্রান্ত বৃদ্ধা মা মোমেনা বেগম (৭৪) একটা বিধবা অথবা বয়স্ক ভাতার কার্ডের লাই¹া কতো মেম্বার-চেয়ারম্যানগো হাতে পায়ে যে ধরছে হেইয়া কইয়া শ্যাষ করা যাইবো না। কিন্তু মোরা গরিব দেইখা কেউই মোর মার আর্তনাতে কর্নপাত করেনি। বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান বাবার বীরত্বের প্রতি সম্মান দিয়ে চিঠি ও অনুদান দিলেও বর্তমান সমাজের কর্তা ব্যক্তিরা মোর রোগাক্রান্ত মার প্রতি একটু সহানুভুতি পর্যন্ত দেখায়নি। এইয়ার লাই¹া কি মোর বাপে নিজের জীবন বাঁজি রাইখা দ্যাশটা স্বাধীন করছে। বয়স্ক ও বিধবা ভাতা বঞ্চিত মোমেনা বেগমের হতদরিদ্র দিনমজুর পুত্র সাত্তার সরদার আক্ষেপ করে বলেন, আর কতো বয়স হইলে মোর মায় বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতার কার্ড পাইবে।
বর্তমানে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অর্থাভাবে ও অনাহারে বিনাচিকিৎসায় শষ্যাশয়ী রয়েছেন যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম কালু সরদারের স্ত্রী মোমেনা বেগম। আজো তার ভাগ্যে জোটেনি মরহুম স্বামীর মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি ভাতা কিংবা বিধবা ও বয়স্ক ভাতার কার্ড। কালু সরদারের পুত্র সাত্তার সরদার তার রোগাক্রান্ত মায়ের সু-চিকিৎসার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও সমাজের মহানুভব ব্যক্তিদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।