বিবেকানন্দ, এক অনন্য জীবন

‘তিনি ত্যাগের প্রতিমূর্তি-ত্যাগস্বরূপ৷’ মিসেস সেভিয়ার বলনে, স্বামীজী যোগে প্রতিমূর্তি৷ মিসেস কুককে মিস ম্যাকলাউড বলেছিলেন, স্বামীজী ছিলেন মুক্তির প্রতিমূর্তি৷ উইলিয়াম জেমস বললেন, ‘Vivekananda is an honour to the humanity.’ কে এই সন্ন্যাসী, এত চিন্তা, এত ধ্যান, এত উত্সাহ, এত আলোড়ন? এ-প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের বিবেকানন্দ-জীবনে মহাপরিক্রমা করতে হবে৷ শিশু নরেন্দ্রনাথ যেদিন ভূমিষ্ঠ হলেন, সেসময়েই বারাণসীর দিক থেকে এক অভূতপূর্ব আলোকচ্ছটা সিমলার মাটি সম্পর্শ করল৷ শ্রীরামকৃষ্ণ চিনলেন সেই অচিন দ্যুতিপ্রভাবে৷ এই জ্যোতিঃপ্রভাকে তিনি আগেও দেখেছেন৷ অখণ্ডের ঘরে৷ তাই নরেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হতেই বললেন, তুমি সেই পুরাতন ঋষি, নররূপী নারায়ণ৷ পূজনীয় সারদানন্দজী এর একটি অনিন্দ্যসন্দুর অভিব্যক্তি দিয়েছেন ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’ এ৷ সংপে তাঁর বর্ণনাটি হচ্ছে- শ্রীশ্রীঠাকুর স্বয়ং বলেছেন, একদিন দেখিতেছি- মন সমাধিপথে জ্যোতির্ময় বর্ত্মে উচ্চে উঠিয়া যাইতেছে; চন্দ্র-সূর্য-তারকামণ্ডিত স্থথলজগত্ সহজে অতিক্রম করিয়া উহা প্রথমে সূক্ষ্ম ভাবজগতে প্রবিষ্ট হইল৷ ঐ রাজ্যের উচ্চ উচ্চতর স্তরসমূহে উহা যতই আরোহণ করিতে লাগিল, ততই নানা দেবদেবীর ভাবঘন বিচিত্র মূর্তিসমূহ পথের দুই পার্শ্বে অবস্থিত দেখিতে পাইলাম৷ ক্রমে উক্ত রাজ্যের চরম সীমায় উহা আসিয়া উপস্থিত হইল৷ সেখানে দেখিলাম এক জ্যোতির্ময় ব্যবধান (বেড়া) প্রসারিত থাকিয়া খণ্ড ও অখণ্ডের রাজ্যকে পৃথক করিয়া রাখিয়াছে৷ বিস্মিত হইয়া ইহাদিগের কথা ও মহত্ত্বের বিষয় চিন্তা করিতেছি, এমন সময়ে দেখি সম্মুখে অবস্থিত অখন্ডৈর ঘরের ভেদমাত্রবিরহিত, সমরস জ্যোতির্মণ্ডলের একাংশ ঘনীভূত হইয়া দিব্য শিশুর আকারে পরিণত হইল৷ ঐ দেব-শিশু ইহাদিগের অন্যতমের নিকটে অবতরণপূর্বক নিজ অপূর্ব সুললিত বাহুযুগলের দ্বারা তাঁহার কণ্ঠদেশ প্রেমে ধারণ করিল; পরে বীণানিন্দিত নিজ অমৃতময়ী বাণী দ্বারা সাদরে আহ্বানপূর্বক সমাধি হইতে তাঁহাকে প্রবৃদ্ধ করিতে অশেষ প্রযুত্ন করিতে লাগিল৷ সুকোমল প্রেমসম্পর্শে ঋষি সমাধি হইতে ব্যুত্থিত হইলেন এবং অর্ধস্তিমিত নির্নিমেষ লোচনে সেই অপূর্ব বালককে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন৷ তাঁহার মুখের প্রসন্নোজ্জ্বল ভাব দেখিয়া মনে হইল, বালক যেন তাঁহার বহুকালের পূর্বপরিচিত হৃদয়ের ধন৷ অদ্ভূত দেব-শিশু তখন অসীম আনন্দ প্রকাশপূর্বক তাঁহাকে বলিতে লাগিল, ‘আমি যাইতেছি, তোমাকে আমার সহিত যাইতে হইবে৷’ ঋষি তাঁহার ঐরূপ কোন কথা না বলিলেও তাঁহার প্রেমপূর্ণ নয়ন তাঁহার অন্তরের সম্মতি ব্যক্ত করিল৷ পরে ঐরূপ সপ্রেম দৃষ্টিতে বালককে কিছুক্ষণ দেখিতে দেখিতে তিনি পুনরায় সমাধিস্থ হইয়া পড়িলেন৷ তখন বিস্মিত হইয়া দেখি, তাঁহারই শরীর মনের একাংশ উজ্জ্বল জ্যোতির আকারে পরিণত হইয়া বিলোমমার্গে ধরাধামে অবতরণ করিতেছে! নরেন্দ্রকে দেখিবামাত্র বুঝিয়াছিলাম, এ সেই ব্যক্তি৷’ শ্রীরামকৃষ্ণ অন্যত্র বছেন, শিবের অংশাবতার তিনি৷ সেই স্বামীজীকে শ্রীরামকৃষ্ণ আহ্বান করলেন৷ স্বামীজী সেই আহ্বানে সাড়া দিলেন৷ কিন্তু ১৮৬৩ থেকে ১৮৮১-এই সময়ে সপ্তর্ষিমণ্ডল থেকে আসা অন্যতম ঋষি নরেন্দ্রনাথের মানসিক অবস্থাটি কেমন ছিল? শ্রীরামকৃষ্ণের সেই বিখ্যাত উপমাটি মনে পড়ে৷ একটি বিহঙ্গ দিশাহারা৷ সে উত্তর দিকে উড়ে যায়, উত্তর দিল না কোন উত্তর৷ দক্ষিণে গেল, দক্ষিণ দেখাল না কোন দাক্ষিণ্য৷ একইভাবে পূর্বে গেল, পূর্ব দেখাল না কোন আলোর দিশা৷ গেল পশ্চিমে, পশ্চিম দিল না কোন দিগ্‌্‌দর্শন৷ শ্রান্ত, ক্লান্ত সেই বিহঙ্গ তখন ভ্রাম্যমাণ একটি জাহাজের মাস্তলে এসে বসল৷ এবার নিশ্চিন্ত৷ নরেন্দ্রনাথের মনের অবস্থাও অনেকটা এরকম ছিল এই সময়ে৷ ১৮৮১ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ-পদপ্রান্তে তিনি উপনীত হন৷ একদিন শ্রীরামকৃষ্ণ একটুকরো কাগজে লিখে দিলেন : ‘নরেন শিক্ষে দিবে৷’ আকেদিন ঠাকুরের ঘর থেকে স্বামীজী বেরিয়ে এনে, শরত্ মহারাজকে বললেন, ভগবান যদি কখনো দিন দেন তো আজি যাহা শুনিলাম এই অদ্ভুত সত্য সংসারে সর্বত্র প্রচার করিব৷ কী সেই অদ্ভূত সত্য? শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, জীবে দয়া-জীবে দয়া? দূর শালা! কীটানুকীট তুই জীবকে দয়া করবি? দয়া করবার তুই কে? না, না, জীবে দয়া নয়- শিবজ্ঞানে জীবের সেবা৷’ কাশীপু েঠাকুরের মহাসমাধির দু-তিনদিন আগেকার কথা৷ ঠাকুর যাঁকে ‘কালী’ ব েডাকতেন, তাঁকে তিনি নরেনের শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দিলেন৷ পরবর্তী সময়ে স্বামীজী স্বয়ং একথা শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলেন৷ শ্রীরামকৃষ্ণের মহাসমাধির পর অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, যে মহাজীবনের যাত্রা শুরু কামারপুকুরে পঞ্চাশ বছর আগে, সেই মহাজীবনটি নিঃশেষ হয়ে গেল ধূম্রাকারে নভোচারি হয়ে৷ কিন্তু নরেন্দ্রনাথ জানতেন, এই ধূম্রমণ্ডলীর ভেতর আছে প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি এবং এই ধূম্রমণ্ডলী বাষ্পাকারে ঊর্ধ্বায়মান হয়ে নিছক নভোচারি হয়ে থাকার নয়, আজকের গঙ্গার এপারের ধুম্র কাল শান্তিবারি হয়ে প্রত্যাবর্তন করবে গঙ্গার ওপারে বেলুড় গ্রাম৷ কারণ, দেহত্যাগের আগে এই নরেন্দ্রনাথকেই শ্রীরামৃকষ্ণ একবার বলেছিলেন, তুই কাঁধে করে আমায় যেখানে নিয়ে যাবি, আমি সেখানেই যাব ও থাকব, তা গাছতলাই কি, আর কুটিরই কি! পরবর্তী কালে স্বামীজী নিজ স্কন্ধে বহন করে আত্মারামকে নিয়ে এলেন বেলুড়ে৷ শ্রীজী’র প্রতিষ্ঠা হল৷ শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ হল৷ সেই মরে ভূলোক, দ্যুলোক সর্বত্র শ্রীরামকৃষ্ণ চাষই তিনি করলেন, কারণ শ্রীরামকৃষ্ণ যে তাঁর ‘পূর্ণম্‌ এব অবশিষ্যতে৷’ আর গৃহী ও সন্ন্যাসী উভরে জন্য এক মহামন্ত্র- বলা যেতে পারে বীজমন্ত্র- রেখে গেলেন : ‘আত্মনো মোক্ষার্থং ভগদ্বিতায় চ’৷ শ্রীরামকৃরে মহাসমাধি ও বেলুড় মঠ……… প্রতিষ্ঠার মাঝখানের দিনগুলোয় সিমলের ‘নরেন’, বরানগর মরে ‘স্বামী বিবিদিষানন্দ’ এবং ভাবিকারে বিবেকানন্দ পরিব্রজ্যায় বেরিয়েছিলেন৷ পরিব্রজ্যাক্রমে গেছেন দেওঘরে, গেছেন কাশীতে, আরো অনেক জায়গায়৷ গাজীপুরে পওহারী বাবাকে দর্শন করেন৷ তিনি দেখলেন এক পবন-আহারী বাবাকে, কিন্তু এরপর তিনি যেখানেই গেছেন, বলা যেতে পারে গাজীপুর থেকে কন্যাকুমারি পর্যন্ত রাজপথের ধারে লাখ লাখ পওহারী বাবাকেই দেখলেন৷ ওরা পবন-আহারী হয়েছিল, কারণ ওরা ছিল ঐ ‘হম্‌ ভুঁখে হ্যায়’ দরে লোক৷ স্বামীজী বললেন, The Old Gospel says-‘মাতৃদেবো ভব’, The New Gospel says-‘দরিদ্রবো ভব’, মূর্খবো ভব’৷ স্বামীজী আাে বললেন, যে ধর্ম বুভুক্ষের মুখে এক টুকরো রুটি তুলে দিতে পারে না, আর্তের কাছে ওষুধ ও পথ্য পৌঁছে দিতে পারে না, অজ্ঞের কাছে শিক্ষার আলোকবর্তিকা তুলে ধরতে পারে না, বিধবার অশ্রুমোচনে সক্ষম নয়, অনাথের ক্রন্দন রোধ করতে পারে না- সে ধর্ম ধর্ম নয়৷’ স্বামীজী দিব্যদৃষ্টিতে দেখেছিলেন ভাররে ভাবী অভ্যুদয়কে৷ তিনি বললেন, India must rise. সাথে সাথে একথাও বললেন, ভারতকে শ্রীরামকৃষ্ণের নির্দেশিত পথে চলতে হবে৷ শ্রীরামকৃষ্ণের পথটি কী? ত্যাগ, সেবা, ঈশ্বরপ্রণিধান, ‘যত মত তত পথ’ অর্থাত্ সর্বধর্মসমন্ববয় এবং প্র্যেক মানুষের মধ্যে দেবত্বের অস্তিত্ব স্বীকার৷ স্বামীজী বলছেন, ‘আমি এত তপস্যা করে এই সার বুঝেছি যে, জীবে জীবে তিনি অধিষ্ঠান হয়ে আছেন; তাছাড়া ঈশ্বর-ফিশ্বর কিছুই আর নেই৷ – জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর৷ ১৮৯৪ সালে আলমবাজার মঠস্থিত গুরুভ্রাতাদের আমেরিকা থেকে তিনি লিখেছেন : I only tell you this, that whoever reads this letter will imbibe my spirit! তারপর লিখছেন, Whoever will be ready to serve him-no, not him but his children- the poor and the downtrodden, the sinful and the afflicted… in them he will manifest himself. আর স্বামীজীর চিরন্তন আহ্বান-সবার কাছে- প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্য উভয়ের কাছে- ‘ত্বমসি নিরঞ্জন’ – Each soul is potentially divine. তুমি রামই হও অথবা রহিম বা জোফে, জেনে রেখো তুমি স্বরূপথ ঈশ্বর৷ তাই সকলের কাছে তাঁর চরম ও পরম বার্তা হল- The goal is to manifest the divinity within. এর জন্যই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের আগমন৷ এখানেই রামকৃষ্ণের বিবেকানন্দ-সাধনা ও বিবেকানন্দের রামকৃষ্ণ-সাধনার তাত্পর্য৷ তাই জীবনের শেষ অধ্যায়ে মাক্যলাউডকে স্বামীজী লিখেছেন, Mother, I come- a spectator, no more an actor. শ্রীরামকৃষ্ণ কালীকে অনুপ্রবিষ্ট করেছিলেন নরেনের মধ্যে৷ সেই কালী তাঁকে দিয়ে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠিত করালেন৷ এবার বিদায়ের পালা৷ দক্ষিণেশ্বরে কথামৃত পানরত নরেনের ভূমিকায় তিনি ফিরে যেতে চান- ও come, my beloved lord, I come. স্বামীজীর কাছে করজোড়ে প্রার্থনা করি- ‘আমরা যেন শ্রদ্ধাবান হই, বীর্যবান হই, আত্মজ্ঞান লাভ করি এবং পরহিতায় জীবনপাত করতে পারি৷’

 

Source : www.weeklyekushey.com