আলীকদমে প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল অবস্থা

শিক্ষকদের স্কুলে অনুপস্থিতি, বর্গা শিক্ষক দিয়ে স্কুল পরিচালনা, শিক্ষা অফিসের মনিটরিং দুর্বলতার কারণে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা ভেস্তে যেতে বসেছে। এসব স্কুলে শিক্ষকদের গরহাজির থাকার বিষয়টি সম্প্রতি কয়েকটি বিদ্যালয় আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পেয়েছেন খোদ উপজেলা চেয়ারম্যান। এ উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষার বিভিন্ন অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় মুরুং অধিবাসীরা সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন মহলে পত্র দিয়েছে।

উপজেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী ২৯০ নং মাংগু মৌজার থোয়াইচিং হেডম্যান পাড়া রেজি: প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকার বাসিন্দা পাপ্প মুরুং, চংবট মুরুং ও মেনওয়াই মুরুংসহ ১৪ জন অভিভাবকের লিখিত অভিযোগে জানা গেছে, এ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম চলে আসলেও গত ২০০৯ সাল থেকে অজ্ঞাত কারণে বিদ্যালয়টির শ্রেণী কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু উপজেলা শিক্ষা অফিসের হিসাবে বিদ্যালয়টি নিয়মিত খোলা রাখা হয়েছে মর্মে দেখানো হয়েছে। এমনকি বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক উথোয়াইচা মার্মা ও সহকারী শিক্ষক ফারুক আহামদ সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসের সাথে যোগসাজশ করে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সীল স্বাক্ষর জাল করে নিয়মিত মাসিক বেতনভাতাও তুলে আসছিল। শুধু তাই নয়, শিক্ষকরা উপজেলা শিক্ষা অফিসের সাথে যোগসাজশ করে ভূয়া ছাত্র/ছাত্রী দেখিয়ে নিয়মিত উপবৃত্তির টাকাও উত্তোলন করে আত্মসাত করেছেন।

স্থানীয় মুরুং নেতা মেনদন জানান, ওই স্কুলের সহকারী শিক্ষক ফারুক আহমদ আলীকদমের বাসিন্দা নয়। তিনি নিয়মিত চকরিয়ায় থাকেন। কিন্তু থোয়াইচিং হেডম্যান পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে মাসের পর মাস ধরে বেতন ভাতা উত্তোলন করে আত্মসাত করে চলেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, মাস্টার ফারুকের চাকুরী আলীকদমে হলেও তিনি চকরিয়া উপজেলায় একটি এনজিওতে নিয়মিত চাকুরী করেন। এ স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক উথোয়াইচা মার্মা মাসের পর মাস স্কুলে না গিয়েই অফিসের সাথে যোগসাজশ করে বেতন ভাতা তুলে নিচ্ছেন। এসব বিষয়ে স্থানীয় মুরুং নেতা ইয়োংলক মুরুং গত ১৭ ডিসেম্বর উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বাসুদেব কুমার সানাকে অভিযোগ করলেও কোন সুরাহা করা হয়নি। স্থানীয় মুরুংরা শিক্ষা নিয়ে বাণিজ্যকারী চক্রের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী জানিয়েছেন।

এদিকে, আলীকদম উপজেলা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ের পত্র নং- উপকা/আক/শিক্ষা/পাঁচ-৫/২০১১-৭৬ তারিখ : ০৭/০২/২০১১ খ্রি: মূলে জানা গেছে, উপজেলা চেয়ারম্যান মো: আবুল কালাম কলারঝিরি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন বিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে ছাড়াই অনুপস্থিত রয়েছেন। কর্তৃপক্ষের কোন প্রকার তদারকি না থাকায় দিনের পর দিন এ প্রধান শিক্ষক স্কুল ফাঁকি দিয়ে থাকেন। পরিদর্শনের দিন বিদ্যালয়টিতে মাত্র ১৫ জন ছাত্র-ছাত্রী উপস্থিত ছিল। যদিও ছাত্র হাজিরায় বিদ্যালয়টির মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা রয়েছে ৪২ জন। স্কুলের নষ্ট হওয়া জাতীয় পতাকাটিতে ৩/৪টি সেলাই করা। স্থানীয় জনসাধারণ জানায়, বাস্তবে বিদ্যালয়টিতে কোন ম্যানেজিং কমিটি নেই। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মাসের অধিকাংশ সময় স্কুলে উপস্থিত থাকেন না। মাঝে মধ্যে এসে স্কুলের শিক্ষক হাজিরায় নিজের মর্জি মাফিক স্বাক্ষর করে দেন। তারা আরো জানান, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কাঠ ব্যবসাসহ নানা ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যস্ত থাকেন। কর্মস্থলে না থেকে চকরিয়ায় বসবাস করেন। উপজেলা চেয়ারম্যান তার পত্রে আরো উল্লেখ করেন, বিদ্যালয়টির লেখাপড়া মান অত্যন্ত নাজুক। এসএমসি ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বহীনতার কারণে ওই এলাকার শতাধিক ছাত্র-ছাত্রী পড়ালেখা বঞ্চিত ও ঝরে পড়েছে। এলাকাবাসী জানায়, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্কুলে নিয়মিত না গিয়েও উপজেলা শিক্ষা অফিসের সাথে আঁতাত করে ভেতন ভাতা উত্তোলন করে নিচ্ছেন। উপজেলা চেয়ারম্যান তার পত্রে পাহাড়ি এলাকার ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিতের জন্য চলমান অনিয়ম দুর্নীতি দুরিকরণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

স্থানীয় সচেতন মহল জানান, এ উপজেলার দুরবর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকরা কোনদিন ক্লাস না করেও নিয়মিত বেতন ভাতা নিচ্ছেন। দুরবর্তী কয়েকটি স্কুলগুলোতে বর্গা শিক্ষক দিয়ে জোড়াতালি দিয়ে চলছে শ্রেণী কার্যক্রম। কোনদিন স্কুলে না গিয়েও কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে বছরের পর বছর ধরে কতিপয় ব্যক্তি শিক্ষকতাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে সরকারী বেতন ভাতা গ্রাস করে চলেছেন। সংশ্লিষ্ট অফিসের তদারকি না থাকায় উপজেলার কয়েকটি প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকরা দিব্যি ব্যবসা-বাণিজ্যসহ স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন।

এ ব্যাপারে জানতে সোমবার বিকেলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার নাসরিন সুলতানার মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে জানান, থোয়াইচিং হেডম্যান পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দুরে অবস্থিত হওয়ায় আমার পক্ষে পরিদর্শন করা সম্ভব হয়নি। শিক্ষকরা স্কুলে না যাওয়ায় স্কুলটি বন্ধ করে দেয়ার চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে। উপজেলা ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা অফিসার বাসুদেব কুমার সানা জানান, এ বিদ্যালয়টির শ্রেণী কার্যক্রম আবার শুরু হয়েছে এবং অভিযুক্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে অঙ্গীকার নেয়া হয়েছে। বর্গা শিক্ষকের ব্যাপারে তার কাছে সুনির্দ্ধিষ্ট কোন অভিযোগ নেই বলেও জানান।

আলীকদম (বান্দরবান) প্রতিনিধি।