গৌরবময় দুই দশক পেরিয়ে – আজ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় দিবস

শ্যামলিয়া ঘেরা নয়নাভিরাম সবুজ ক্যাম্পাস। অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৯১ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি, বাংলা ১লা ফাল্গুন। SUSTবাংলা বর্ষ মোতাবেক প্রতিবছর ১লা ফাল্গুনকে বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালন করা হয়। ৩২০ একর ভূমিতে মাত্র তিনটি বিভাগ ও ২০৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে কার্যক্রম শুরু হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি বাংলাদেশের প্রথম ও বৃহত্তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। ক্যাম্পাসের ৫টি অনুষদে পঁচিশটি বিভাগে বর্তমানে দশ হাজারও অধিক শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে। ২০১১-১২ শিক্ষাবর্ষ থেকে ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, বায়োকেমিস্ট্রি এন্ড মলিকুলার বায়োলজি ও জিওগ্রাফি এন্ড এনভায়রনমেন্ট নামে নতুন এ তিনটি বিভাগে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়েছে।

পদার্থবিজ্ঞানী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক প্রফেসর ড. ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ছিলেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর। বর্তমানে ৮তম ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রফেসর ড. মো. সালেহ উদ্দিন। বর্তমান উপাচার্য মহোদয় যোগদানের পর একটি দিনও অনির্ধারিত ক্লাস কার্যক্রম বন্ধ হয়নি। ফলে সেশনজট শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। শিক্ষার্থীদের বিলম্বিত শিক্ষাজীবনের অভিশাপ থেকেও মুক্তি পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টিগ্রেটেড তথা সমন্বিত অনার্স কোর্স চালু হয় এবং সব বিভাগে সেমিস্টার ও গ্রেডিং পদ্ধতি প্রচলন হয় যা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালগুলোর মধ্যে প্রথম।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে উন্নতমানের গবেষণা হচ্ছে। দেশের নানা সমস্যা ও প্রয়োজনের সাথে সম্পৃক্ত এখানকার গবেষণা। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্স এবং সিভিল এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পরিবেশ, শিল্পের দূষিত বর্জ্য পানি বিশুদ্ধকরণ, বিল্ডিং স্যাটেরিয়াল ইত্যাদির উপর আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও নানা বিষয়ে সুনাম অর্জন করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভূক্ত বিভাগ নৃবিজ্ঞান, সমাজকর্ম, সমাজবিজ্ঞান সিলেট তথা বাংলাদেশের বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে গবেষণা করছে। যা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিই বহন করে।
বর্তমান যুগ তথ্যের যুগ। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিপ্লব এনেছে। কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে সমগ্র বিশ^ অবিশ্বাস্য গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের আইটি সুবিধার ক্ষেত্রে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম শ্রেষ্ঠ। বাংলাদেশে এ বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রথম কম্পিউটার নেটওয়াকিং হয়েছিল। ক্যাম্পাসের ভেতর কম্পিউটারগুলো ফাইবার অপটিক ক্যাবল এর মাধ্যমে সংয্ক্তু হয়েছে বহু আগে। যা বিটিটিবির ফাইবার অপটিক ব্যাকবোন এর মাধ্যমে সংযুক্ত। Sust  Gateবর্তমানে পুরো ক্যাম্পাসসহ আবাসিক হলগুলোতে ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক চালু রয়েছে। ওয়াইফাই হলো এক ধরনের তারবিহীন ইন্টারনেট সুবিধা। এ ব্যাপারে অগ্রগামী ভূমিকা রাখছেন খ্যাতনামা বিজ্ঞানী প্রফেসর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং তাঁর কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ। শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই ইন্টারনেট ব্যবহার করে তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা পাচ্ছে। যা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মডেল স্বরূপ। জানুয়ারি মাসে দেশি-বিদেশি শতাধিক গবেষকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনোভেশন এন্ড এডুকেশন শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। যার মাধ্যমে  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থার চিত্র সারাবিশ্বেই পৌঁছে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে প্রাপ্ত আইটি ভবনের ভিস্তিপ্রস্তর করা হয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করবে। আইটি জগতে এক ধাপ এগিয়ে থাকবে শাবিপ্রবি।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার বাস্তব প্রতিফলনই কামনা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুভাকাঙ্খীরা। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার প্ল্যানকে বাস্তবায়ন করতে পারলেই সেটা বাস্তবে রূপ নিবে। মাস্টার প্ল্যানের মধ্যে রয়েছে ২০১৫ সালের মধ্যে ৮টি আবাসিক হল প্রতিষ্ঠা করা। অথচ ২০১১ সালে এসেও তার অর্ধেকও করা সম্ভবপর হয়নি।

জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কয়েকটি বছর অধ্যয়ন করে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জন শেষে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিলাভ করে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘ ২১ বছরে দু’বার সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ডিগ্রির সার্টিফিকেট আনুষ্ঠানিকভাবে পেতে অপেক্ষা করতে হয় শিক্ষার্থীদের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তন হয়েছিল ২৯ এপ্রিল ১৯৯৮। তারপর দীর্ঘ নয় বছর পর ৬ ডিসেম্বর ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় সমাবর্তন।

বিশ্ববিদ্যালয়টি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি হলেও রয়েছে ইংরেজি, বাংলা বিভাগের মতো কলা অনুষদের বিষয়। বাংলা বিভাগ যা সবচেয়ে সামাজিক অনুষদের কনিষ্ঠ বিভাগ। বাংলাদেশে ভাষা পরিকল্পনা, সিলেটের লোকগীতি ও লোকনাট্যে লোকজীবন, ভাষা বিষয়ক বৈচিত্র্য, বাংলা উপন্যাসে সমাজ ও মানুষ, সিলেটের বাউল সঙ্গীতে হযরত শাহজালাল ও শ্রী চৈতন্যের প্রভাব, চা শ্রমিকদের প্রায় অবলুপ্ত কৃত্য নাট্য ও সংস্কৃতি, সাহিত্য ও জীবনদর্শন ইত্যাদি নানা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা কর্মকাণ্ড উৎসাহী ও কৌতূহলী শিক্ষকমণ্ডলী ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করেছেন। মরমী কবি হাছন রাজার ওপর উচ্চতর গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন বাংলা বিভাগের এক শিক্ষক।

দেশের প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম চালু হলো শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবরও একই পদ্ধতিতে ২০০১১-১২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা ৬ নভেম্বর ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়ার পর ১৮ জানুয়ারি ভর্তি কার্যক্রম শেষ করে। আর ২৫ জানুয়ারি শুরু হয় তাদের আনুষ্ঠানিক ক্লাস। ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন সেটা যে বাস্তবায়ন সম্ভব তা প্রমাণ করেছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়। এরই ধারাবাহিকতায় দেশের নানা পাবলিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ করে ভর্তি পরীক্ষার কার্যক্রম পরিচালনা করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শুধু লেখাপড়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখছে। ক্যাম্পাসে রয়েছে সঙ্গীত, আবৃত্তি, বিতর্ক, নাটক, ফটোগ্রাফি, স্বেচ্ছাসেবামূলক সংগঠন। এসবের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীরা সৃজনশীলতার সাথে প্রতিভা বিকশিত করছে। রয়েছে রোভার স্কাউট ও বিএনসিসির চোখে পড়ার মত বর্ণাঢ্য কার্যক্রম।

২০৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়েছিল কালের যাত্রায় আজ গৌরবের দুই দশক পূর্ণ করেছে। অগণিত শিক্ষার্থী, সবিদ্য শিক্ষক আর উৎসাহী অভিভাকদের মেলবন্ধনে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় আজ এক বিরাট মহীরূহ রূপে পরিগণিত হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা আর শিক্ষার্থীদের প্রাণ স্পন্দনে এই আঙিনা আজ মুখরিত। বর্ণিল সময়ের গতিধারায় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় অসামান্য অবদান রেখেছে, রাখছে এবং আগামীতেও রাখবে এটাই প্রত্যাশা। শুভ হোক আগামীর পথ চলা। শুভ জন্মদিন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়।

 


মুহাম্মাদ রিয়াজ উদ্দিন: সংবাদকর্মী, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ(৪র্থ বর্ষ ২য় সেমিস্টার), শাবিপ্রবি, সিলেট।