লাশ হয়ে ফিরল টুম্পা!

Tumaনামে এক স্কুলছাত্রী। রাজধানীর সেগুনবাগিচার বাসা থেকে বের হওয়ার দুই দিন পর গত বুধবার নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মিলেছে তার ক্ষতবিক্ষত লাশ। পুলিশ ও স্বজনরা জানান, টুম্পা তোপখানা রোডের বেগম রহিমা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ছাত্রী ছিল। এ মৃত্যুর ঘটনায় টুম্পার কথিত প্রেমিক সাইদুর রহমান সাইদ ওরফে আকাশকে (১৮) পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। গত বছর মে মাসে টুম্পার বড় ভাই আল কাওসার চৌধুরী মাসুদ ওরফে বাবলা (২২) একইভাবে নিখোঁজ হওয়ার পর নরসিংদীর রায়পুরা থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। স্বজনদের আশঙ্কা, একই চক্র হত্যা করেছে ভাই-বোনকে। পরিবারের অভিযোগ, সেগুনবাগিচায় আট বখাটের একটি চক্র টুম্পাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল। এ নিয়ে একসময় বখাটেদের সঙ্গে মারামারিও হয়েছিল ভাই বাবলার। টুম্পার লাশ পাওয়ার পর তার বাবার দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত নুরুল হক নুরু (২২) নামে এক বখাটেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সেগুনবাগিচা হাইস্কুল থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।


শাহবাগ থানা পুলিশ জানায়, নিহত স্কুলছাত্রী টুম্পার বাসা সেগুনবাগিচার ৬/৪ হোল্ডিংয়ের অ্যাপার্টমেন্টের তৃতীয় তলায়। তার বাবা আমানত উল্লাহ চৌধুরী জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসায়ী। গত সোমবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সন্ধ্যায় বাসা থেকে কথিত প্রেমিক আকাশের সঙ্গে দেখা করতে বের হয় টুম্পা। এরপর দীর্ঘসময় পর্যন্ত টুম্পা বাসায় না ফেরায় ওই রাতেই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে টুম্পার পরিবার। এর ভিত্তিতে সাইদকে আটক করে পুলিশ। তবে সাইদ পুলিশকে জানায়, টুম্পা সন্ধ্যার পরপরই তার কাছ থেকে চলে গেছে। বুধবার সকালে সিদ্ধিরগঞ্জের সানারপাড়ে ডিএনডি বাঁধের পাশে ওয়াপদা খাল থেকে টুম্পার লাশ উদ্ধার করা হয়। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিয়ে আসা হয়। নিহতের বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে সাইদকে।


মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোক্তার হোসেন বলেন, ‘সিদ্ধিরগঞ্জে টুম্পার লাশ পাওয়া নিয়ে রহস্য দেখা দিয়েছে। লাশের কপাল, ঘাড় ও বিভিন্ন স্থানে জখমের চিহ্ন দেখা গেছে। ময়নাতদন্তে হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাবে। সাইদকে গতকাল ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হলে পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।’


টুম্পার মা খায়রুন্নাহার শিখা জানান, গত কোরবানির ঈদের দিন বড় ভাইয়ের স্ত্রী কাকলী ও মামাতো বোন পাপড়ির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বেড়াতে যায় টুম্পা। ওই দিন সাইদের সঙ্গে পরিচয় হয় টুম্পার। সাইদ নিজের ছদ্মনাম ‘আকাশ’ নিয়ে টুম্পার মোবাইল ফোনে কথা বলতে শুরু করে। বিষয়টি টের পেয়ে মা শিখা মেয়েকে শাসন করেন। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে বিকেলে তিনি টুম্পাকে এ নিয়ে বেশ বকাঝকা করেন। সন্ধ্যা ৬টার দিকে গোপনে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় টুম্পা। এরপর তার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও তা রিসিভ করা হয়নি। সন্ধ্যার পর টুম্পাকে শহীদ মিনার এলাকায় সাইদের সঙ্গে দেখতে পায় টুম্পার মামাতো ভাই বাঁধন। বিষয়টি পুলিশকে জানায় তার পরিবার। তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, মোবাইল ফোনের আকাশই হচ্ছে ওই সাইদ। সে শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র। সাইদের বাবা শহীদ মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে থাকে। সোমবার রাতে সাইদকে বাসায়ই পাওয়া যায়। আটক হওয়ার পর সাইদ জানায়, সে টুম্পাকে রিকশায় তুলে দিয়েছে। টুম্পা তুলি নামের এক বান্ধবীর বাসায় গেছে। তবে পরিবারের সদস্যরা জানান, তুলি নামের কোনো বান্ধবী টুম্পার নেই। পরিবারের আশঙ্কা, সাইদের কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর সাইদের যোগসাজশে বা আলাদা কোনো চক্রের ফাঁদে পড়ে টুম্পা।


ভাইয়ের পর বোনদায়ী কে : গতকাল টুম্পার বাসায় গিয়ে দেখা যায় সেখানে চলছে শোকের মাতম। স্বজনরা জানান, টুম্পার ভাই বাবলাও বোনের মতো রহস্যজনকভাবে খুন হন। গত বছর ২৬ মে নিখোঁজ হওয়ার পর ৩১ মে তাঁর লাশ পাওয়া যায় নরসিংদীর রায়পুরার কাকন নদীতে। এ ঘটনায় ১৭ জুন রায়পুরা থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় বাবলার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের আসামি করা হয়। তবে কিছু দিন পর ওই আসামিদের নাম প্রত্যাহার করে নেন বাবলার বাবা। মামলাটি এখনো তদন্তাধীন। স্বজনরা আরো জানান, স্কুলগামী টুম্পাকে উত্ত্যক্ত করত স্থানীয় নুরুল হক নুরু, নাঈম, রাকিব, হৃদয়, বাবু, রাজীব, বাবলু ও শাওন নামের আট বখাটে। এ কারণে নুরুকে মারধরও করেছিলেন টুম্পার ভাই বাবলা। একদিন ওই বখাটে চক্র একা পেয়ে বাবলাকেও মারধর করে। স্বজনদের আশঙ্কা, ওই বখাটে চক্র টুম্পা ও বাবলা হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে থাকতে পারে। সোমবার টুম্পা নিখোঁজ হওয়ার পর নুরু নিজেই টুম্পার মা-বাবাকে গিয়ে সাইদের সঙ্গে টুম্পার প্রেম চলছে বলে জানায়। তবে মঙ্গলবার থেকে গা-ঢাকা দিয়েছে সেগুনবাগিচা-তোপখানা রোডের ওই বখাটে চক্রটি। এসব বিষয় পুলিশকে জানানো হয়েছে। শাহবাগ থানার ওসি রেজাউল করিম বলেন, ‘সব ধরনের তথ্য ও আলামত নিয়েই তদন্ত এগোচ্ছে।’


পাশবিক নির্যাতনের আশঙ্কা : পুলিশ ও স্বজনরা জানান, টুম্পার লাশ উদ্ধারের সময় তার পরনে ছিল একটি লাল সালোয়ার। তবে ওড়না বা জুতা পাওয়া যায়নি। সালোয়ারটিও এক জায়গায় ছেঁড়া ছিল। মৃতদেহে জখমসহ বিভিন্ন আলামত দেখে ধারণা করা হচ্ছে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল টুম্পা।


নিরাপত্তা শঙ্কায় পরিবার : এক বছরের মধ্যে ছেলে ও মেয়ের রহস্যজনক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত টুম্পার বাবা-মা। একমাত্র জীবিত সন্তান দ্বীন মোহাম্মদ সামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা ভর করেছে তাঁদের মনে। সামী সেগুনবাগিচা উচ্চ বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। বাবা আমানতউল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘জানামতে আমার কোনো শত্রু নেই। মহল্লার ওই বখাটে ছেলেরা ছাড়া কারো সঙ্গে আমার পরিবারের বড় ধরনের কোনো বিরোধও নেই।’

সূত্রঃ কালেরকণ্ঠ