পিলখানা ট্রাজেডি ও মেজর মোমিনুল ইসলাম

এরপর অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা আর বিসর্জনের পর ১৮৪৭ সালে স্বাধীন হয় পাক-ভারত উপ-মহাদেশে, যা ছিল নামেই মাত্র। বরং সেখানে আরো যোগ হয় বাংলা মায়ের খন্ড চিত্র। এক বাংলাকে করা হয় দুই ভাগে বিভক্ত। এযেন বাংলা মায়ের কোলকে কেটে দুই খন্ড করা। এক খন্ড দেওয়া হয় ভরতকে আর খন্ড দেয়া হয় পাকিস্তানকে, যা হচ্ছে পূর্ব বঙ্গ ও পশ্চিম বঙ্গ। পাক-ভারত উপ-মহাদেশ স্বাধীন হলেও স্বাধীনতার স্বাদ পায়নি। তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ বর্তমান বাংলাদেশ। শুরু হয় আন্দোলন, যার প্রথম দাবী ভাষাকে কেন্দ্র করে। সৃষ্টি হয় মহান একুশে ফেব্রুয়ারী। শহিদ হন ভাষা সৈনিক রফিক, শফিক, বরকতসহ বাংলা মায়ের অনেক সন্তানেরা। রচিত হয় সেই অপরাজিত অমর সঙ্গিত” আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র“য়ারী” সেই থেকে বাঙালী আর ফেব্র“য়ারী যেন এক সুত্রে গাথাঁ। যারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীন হয় দেশ, স্বাধীনতার স্বাদ পাই আমরা বাঙালীরা। বাংলার শুরু হয় ফেব্রুয়ারী মাস জুড়ে অমর একুশে বই মেলা। স্বরন করা হয় শহীদ ভাইদের। এরপর বাংলার স্রোত বইতে থাকে ফেব্র“য়ারীকে নিয়ে অনেক দ্রুত বেগে। মহান একুশে ফেব্র“য়ারী পায় অন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। বিশ্বব্যাপী একুশে পালনের প্রচারে নামে জাতিসংঘ। বিশ্ববাসী পালন করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এ অর্জনও ফেব্র“য়ারীতেই। এছারাও ফেব্র“য়ারী নিয়ে আসে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। বাংলা মায়ের ঋতু রাজ বসন্ত, বাংলা যেন সাজে অপরুপ সাজে। কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয় ভাই হারানোর শোকহত জাতিকে।

হায়রে বাঙালী ! অবুঝ বাঙালী-সেই ফেব্র“য়ারীতেই ঘটিয়ে দেয় বিরাট এক অঘটন। হার মানিয়ে দেয় বৃটিশ আর পাক হানাদারকেও। ২০০৯ সাল ২৫ ফেব্র“য়ারী, স্বাধীন বাংলায় ঘটে যায় এক মর্মান্তিক ঘটনা। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও ন্যাক্কারজনক ঘটনা। যা বাংলাদেশের স্বার্বভৌমত্বকে আর একবার প্রকল্পিত করেছিল। বির্বন মনে হচ্ছেলি বাংলার লাল সবুজের সেই চিরো চেনা পতাকাকে। যা ঘটিয়ে ছিলো কতিপয় বিপথগামী মানুষ রুপি নর পিচাশেরা। যারা করতে চেয়েছিলো সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ। যারা করেছিল নিজ বাহিনীকে কলংকিত আর কেড়ে নিয়েছিল নিজ বাহিনীর প্রধান মেজর সাকিল আহাম্মেদসহ বাংলাদেশের সশন্ত্র বাহিনীর ৫৭ অকুতভয়ী বীর সেনানীকে। যারা বাংলাদেশে রাইফেলস ব্যাটেলিয়ান (বি.ডি.এর) বর্তমান বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর তৎকালীন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ছারা আরো কেড়ে নিয়েছিল বাংলা মায়ের ১৭ সন্তাকে। অস্ত্রের ঝঞ্জাননী কাপিয়ে তুলে ছিল এই কোমলমতি বাংলা মাকে, বিশ্ব বাসীর কাছে করতে চেয়েছিল প্রশ্নাত্বক। কিন্তু বর্তমান সরকারের সরকার প্রধান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও অকুতভয়ী নেতৃত্বে সল্প সময়ের মধ্যেই নিয়ন্ত্রনে আসে। পিলখানার ট্রাজেডি এতোটাই ট্রাজেডি যা কেড়ে নিয়েছিল নববধূর হাতের মেহেদী, পড়নের বেনারশী, কেড়ে নিয়েছিল মাতৃগর্বে থাকা শিশুর পিতৃ স্নেহকে। কেড়ে নিয়েছিল সন্তান সম্ভবা মায়ের কাছ থেকে সন্তানের পিতাকে। হায়রে বাঙালী, হায়রে আমাদের বিচিত্র ফেব্র“য়ারী ! যে মাসেই আমরা আমাদের ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছি, সেই মাসেই দেশের মাটিতেই দেশের বীর সেনানিদের হত্যা করে দেশকে করেছিছ কলংঙ্কিত….! সেই দিনের ভয়াল পিলখানায় শহীদ হয়েছিলেন মোঃ শহীদ মেজর মোঃ মমিনুল ইসলাম। ব্রাক্ষ্মনবাড়িয়ার বানছা রামপুর গ্রামে ১৯৭৫ সালের ২ ফেব্র“য়ারী জন্মগ্রহন করেন মমিনুল। তার পিতা মহিজুল ইসলাম সরকার। ৮ ভাই বোনের মধ্যে তিনি হচ্ছেন পঞ্চম। দেশমাতৃকার টানে সেনাবাহীনির ডিএমএ’র ৩৪ নং কোচে যোগদান করেন মোমিন। পিলখানা ট্রাজেডিতে শহীদ হয়েছেন মেজর মমিনুল ইসলাম। তার স্ত্রী সানজানা সোনিয়া বৈশাখী টেলিভিশনের প্রাক্তন নিউজ প্রেজেন্টার। পিলখানা ট্রাজেডির সময় তিনি (সোনিয়া) ছিলেন অন্তঃস্বত্তা। আজ আমরা কথা বলবো শহীদ মোমিনুল ইসলামের সহধর্মীনি সানজানা সোনিয়া ও বৈশাখী টেলিভিশনের আরেকজন নিউজ প্রেজেন্টার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব লতিফুর মতিন মিঠুর সাথে।

প্রতিবেদকঃ সোনিয়া আপনার সন্তানের বয়স তো প্রায় দু’বছর। নিশ্চয়ই সে আদো আদো স্বরে কথা বলে। আর বলার ছলে সে তার বাবা সম্পর্কে কি জনতে চায় ?

সানজানা সোনিয়াঃ হ্যা সে আদো আদো স্বরে পা-পা মাম্মা বলে ডাকে। তবে সে তাঁর বাবার ছবি দেখে পা-পা- বালে ডাকে। তাকে কিন্তু কেই এটা শেখায়নি। কেন জানি সে ওই ছবি দেখে আর ডাক দিতে থাকে। সেই মুহুর্তে আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না…….।

প্রতিবেদকঃ এবার লতিফুল মতিন (মিঠু) বলুন, এক সময় আপনি ও সোনিয়া একই নিউজ রুমের একই চেয়ারে বসে খবর পরতেন। আমরা দেখেছি ঘটনার সেদিন আপনি এক নাগারে প্রতি ঘন্টার খবরসহ টানা ৪৮ ঘন্টা লাইফ করেছেন। এবার প্রশ্ন হলো-একদিকে এক সহকর্মীর বুক ভাঙ্গা আর্তনাত অন্যদিকে পেশাদারিত্ব এই দু’য়ের মধ্যে আপনাকে পরতে হয়েছিল। সেই সময় আপনার অনুভূতি সম্পর্কে যদি বলতেন।

লতিফুল মতিন মিঠুঃ এক কথায় বলতে গেলে, মা-মাতৃভূমি আর আমাদের চিরচেনা লাল-সবুজের পতাকাটা সেদিন আমার কাছে বিবর্ণ মনে হচ্ছিল। পিলখানার কতিপয় হিংস্র বিডিয়ারদের হত্যাযজ্ঞ। আমার ১৪ বছরের বেতার জীবন আর ৭ বছরের ইলেকট্রিনিক মিডিয়ায় কাজের অভিজ্ঞতার মধ্যে সেদিন ছিল আমার কাছে ব্যাতিক্রম একটিদিন। আমার এই জীবনে সেই দিনটির মত বেদনার সংবাদ কখনো পড়িনি (অশ্র“সজল চোখে)। সেদিন আমি আমার আবেগকে আর ধরে রাখকে পারিনি।

প্রতিবেদকঃ বর্তমানে সেই হত্যাযজ্ঞের বিচার হচ্ছে, রায় ও হচ্ছে। এই বিচার সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

লতিফুল মতিন মিঠুঃ এই বিচার ও রায় তো দেশের আইন অনুয়ায়ী হচ্ছে এবং তা পুরোপুরি আইনানুসারেই হচ্ছে। জাতি সেটা মেনেও নিচ্ছে বলে আমি মনে করি। তাই বিচারের রায় সম্পর্কে আমার মতামত ইতিবাচক। তবে রায় যতই কঠোর হোক না কেন, এ শ্যামল সবুজ আর সরল বাংলামায়ের আঁচলে যে কালিমার আচর কেটে গেছে তা কখনোই পূরন হরার নয়। রায় দিয়ে কি কখনো ক্ষতিপূরন হয় !

প্রতিবেদকঃ ফিরে আসছি সোনিয়ার কাছে, আপা আমরা শুনেছি আপনার সকল অনুপ্রেরনায় ছিল আপনাপর জীবনসঙ্গী শহীদ মেজর মোমিন। যদি তার সেই অনুপ্রোরনার দু’একটি কথা বলতেন।

সানজানা সোনিয়াঃ এ সম্পর্কে বলতে গেলে একটিু পিছনে ফিরে যেতে হবে, আর তা হচ্ছে আমাদের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে যখন বাচ্চা আসছিল না এবং দেশের স্বনামধন্য প্রথম শ্রেণীর একজন গাইনোলজিষ্ট অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা পর বলেছিলেন, আপনি ৯৯.৯৯% মা হতে পারবেন না। সে সময় আমি যখন হতাশ, তখন মোমিন আমাকে আশার আলো দেখিয়ে বলেছিলো, ডাক্তার নয় তুমি আল্লাহতায়ালার ওপর ভরসা রাখো। নামাজ পড়, রোজা রাখ নিশ্চয়ই মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের নিরাশ করবেন না। ঠিক তার সকল অনুপ্রেরণা আর মহান রাব্বুলআলামীনের অশেষ কৃপায় মাত্র ৪ মাসের মধ্যেই আমার গর্ভে সন্তান আসে। এর কিছুদিন পর আমার প্রথম সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। তখন মোমিন অন্যের মত না হয়ে বরং আমার দুর্বলতাকে সবল করতে সাহস জোগায় আর যার ফলশ্র“তিতে আমি পেয়েছি ওর উওরসূরীকে। শুধু এ ক্ষেত্রেই নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজের ক্ষেত্রে ওর অনুপ্রেরনা ছিল সর্বাজ্ঞে।

প্রতিবেদকঃ সোনিয়া, আপনি কি মনে করেন এ বিচারের শাস্তিই ঘাতকদের জন্য যথেষ্ট ?

সানজানা সোনিয়াঃ বিচারের রায় কি হচ্ছে না হচ্ছে সে সম্পর্কে আমি কোন খোঁজ খবর রাখিনা। আমি শুধু জানি বিচারের রায় যত কঠোরই হোক না কেন আমি আর কোনদিন ফিরে পাবনা আমার জিবন সাথী প্রিয় মানুষটিকে। আমার সন্তান কোনদিন দেখবেনা তার বাবাকে। পাবেনা তার বাবার স্নেহ। অনুধাবন করতে পারবেনা বাবার ভালোবাসা।

সাক্ষাতকারের একপর্যায়ে কথা যতো গভীর হতে লাগলো গেষ্টরুমের  বাতাসও ততো বেশি ভারি হয়ে যাচ্ছে। সোনিয়ার আর্তনাদ আর বেদনা যেন এই বসন্তের আকাশে নিয়ে এলো কাল বৈশাখীর ঝড়। হারিয়ে গেল বসন্তের আলো, বাতাস আর বাসন্তি রং, উভয় (সোনিয়া ও মিঠু) সহকর্মীর মুখে নেমে এলো অন্ধকার। করা গেলনা আর কোন প্রশ্ন। মনে হলো সময়ের সাথে সাথে আমরাও হয়তো একদিন ভুলে যাব এই শহীদের স্মৃতি। সময় একদিন বাধ্য করবে এসব শহীদদের কথা ভুলে যেতে।

-সুব্রত ঘোষ, তরুন লেখক, বাটাজোর, গৌরনদী, বরিশাল।