জার্মান সমাজে মুসলমানদের সম্পৃক্ততা

কিন্তু জার্মানির নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ঐতিহাসিক দিক দিয়ে জার্মানির সঙ্গে ইসলামের কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পাওয়া যাবে না৷

ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিতর্ক

Bildunterschrift: জার্মান মুসলিম ইমামদের প্রশিক্ষণএই দুই রাজনীতিবিদের বক্তব্য তীব্র এক বিতর্কের সৃষ্টি করেছে জার্মানিতে৷ কেউ পক্ষে, কেউ বা বিপক্ষে বলছেন৷ ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে একটা ভীতি এখানকার সমাজে বিরাজ করছে৷ বার্লিন ক্যাথিড্রালের উদ্যোগে  এক আলোচনা সিরিজের আয়োজন করা হয়েছে সম্প্রতি, যার শিরোনাম – ‘বিদেশিদের সমাজে সম্পৃক্ততায় প্রতিবন্ধক ধর্ম’৷ জার্মানিতে বসবাসকারী বিভিন্ন ধর্মের মানুষের একত্রে বসবাস ও এই সমাজে তাদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছে৷ বিশেষ করে জার্মান সমাজে ইসলাম ধর্মের ভূমিকাই আলোচনার মূল বিষয়৷ ধর্ম সম্পর্কে এখানকার মুসলিম তরুণ-তরুণীদের মনোভাবও উঠে এসেছে নানা জনের বক্তব্যে৷

সাড়া জাগিয়েছে তুর্কি এক তরুণীর আত্মজীবনী

তুর্কি বংশোদ্ভূত ১৯ বছরের তরুণী মেলবা আকবাস ‘যেমনটি আমি চাই’ নামের আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে মসজিদ ও মিনি স্কার্ট – এই দুই’এর মধ্যে তাঁর জীবনের টানাপোড়েনের কথা তুলে ধরেছেন৷ জার্মান সমাজের আধুনিক জীবনযাত্রা, মসজিদে যাওয়া, নারী পুরুষের বিবাহ বহির্ভূত মেলামেশা – এসব উঠে এসেছে তার বইতে৷ মেলবা আকবাস বলেন, ‘‘আমাদের ধর্ম ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী বিয়ের আগে কারো সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে পারবনা৷ এমনকি কোনো পুরুষের হাত ধরা বা তার সঙ্গে এক ঘরে অবস্থান করাও নিষেধ৷ আমি আল্লাহ’য় বিশ্বাস করি, আমাদের শেষ নবীর ওপরও আস্থা আছে আমার৷ কিন্তু এজন্য নামাজ পড়া, বা মসজিদে দৌড়ানোর প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা৷”

গোঁড়া ধার্মিক বাবার সঙ্গে ঝগড়া বিবাদ সত্ত্বেও উচ্চ মাধ্যমিক বা ‘আবিটুয়র’ পরীক্ষা পাশ করেন মেলবা৷ নিজেকে জার্মান সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে করেন এই তরুণী৷ তবে জার্মানিতে বসবাসকারী সব মুসলমানদের চিন্তাধারা যে একই রকম, তা বলা যায়না৷ বার্লিনের হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউরোপীয় মুসলিমদের আত্মপরিচিতি নিয়ে এক গবেষণা করছেন সমাজবিজ্ঞানী নাইকা ফ্রৌটান৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘এখানে মুসলমানদের মধ্যে নানামুখী স্রোতধারা রয়েছে৷ কেউ গোঁড়া ধার্মিক, কেউ ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে চান৷ কেউ বা সংস্কৃতিবান মুসলিম বলে পরিচিত হতে চান৷ অনেকে আবার মুসলিম পরিবার থেকে এলেও পরে ইসলাম ধর্ম থেকে দূরে সরে গেছেন৷ এক কথায় বলা যায় বৈচিত্র্যময়৷ অনেক তরুণ আবার নিজেদের ‘কুল মুসলিম’ বা ‘পপ মুসলিম’ বলেও অভিহিত করে৷”

ধর্ম সম্পর্কে অল্পবয়সীদের চিন্তাধারা

বিশেষ করে অল্পবয়সীদের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়, তারা একদিকে পশ্চিমের আধুনিক সমাজে অংশ নিতে চায়, অন্যদিকে নিজেদের মুসলিম বলে পরিচয় দিতেও পছন্দ করে৷ সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘ডি সাইট’এর সম্পাদক ইয়র্গ লাউ এ প্রসঙ্গে এক উদাহরণ টেনে বলেন, ‘‘আমার এক বন্ধু ডুইসবুর্গ শহরে ধর্মযাজক৷ এক বৃত্তি শিক্ষাকেন্দ্রে ধর্ম শিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি৷ খ্রীস্ট ধর্ম সম্পর্কে পড়ানোর কথা থাকলেও ওই প্রতিষ্ঠানে কোনো খ্রীস্টান না থাকায় মুসলমান ছাত্রদেরই ধর্ম শিক্ষার দায়িত্ব পান তিনি৷ এরপর তিনি নিজেই পড়াশোনা করে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার চেষ্টা করেন৷ তরুণদের সঙ্গে ইসলাম সম্পর্কে কথা বলে তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে নিজেদের ধর্ম সম্পর্কে তারা খুব কমই জানে৷”

নিজ ধর্ম সম্পর্কে বাবা মায়ের ধারণাও কম

অনেক বাবা-মা ইসলাম ধর্ম-কর্মের চর্চা করলেও ছেলেমেয়েদের ঠিক মত ধর্মের ব্যাখ্যা দিতে পারেননা৷ তাই তরুণ প্রজন্ম নিজেদের মত করে ইসলামকে গ্রহণ করে৷ যার সঙ্গে ইসলাম ধর্মের খুব কমই মিল থাকে৷ সমাজ বিজ্ঞানী নাইকা ফ্রৌটান এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘লক্ষ্য করা যায় অনেকে নিজেদের ঐতিহ্য ও উৎপত্তি খুঁজতে শুরু করে, যার সঙ্গে তাদের তেমন পরিচয় নেই৷ যেমন ইরান থেকে আসা মানুষদের কথাই ধরা যাক৷ অনেকই ৩০ বছর ধরে সেখানে যায়নি, কথাবার্তা বলেও জার্মান ভাষায়৷ কিন্তু চেহারা ও নামে ইরানি বলেই বোঝা যাবে তাদের৷ তাদের ধর্ম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলেও সঠিক উত্তর পাওয়া যাবেনা৷ কেননা সেখানকার দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে তাদের তেমন কোনো ধারণা নেই৷ এসব নিয়ে মাথা ঘামানোটা খুব সহজ নয়৷ তার চেয়ে গলায় সোনার মোটা চেন পরে ইরানি পপসংগীত শুনলে বা ইরানি ডিসকোথেকে গেলেই যদি নিজেকে ইরানি মনে করা যায়, তাহলে তো এটা খুব সহজ৷”

দিতে হবে ইসলাম সম্পর্কে সঠিক ধারণা

এখনকার মুসলিম তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশই জার্মানিতে জন্ম গ্রহণ করেছে বা বড় হয়ে উঠেছে৷ অভিবাসী বলতে এখন তাদের নয়, বরং তাদের মা-বাবা এবং দাদা-দাদিকে বোঝায়৷ এই তরুণরা নিজেদের বিদেশি মনে করতে চায়না, আবার নিজেদের মুসলমান পরিচিতিও বিসর্জন দিতে চায়না৷ এ প্রসঙ্গে সমাজবিজ্ঞানী ফ্রৌটান বলেন, ‘‘আমি রোজা রাখি, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভে বিশ্বাস করি৷ তাহলেই আমি মুসলমান হয়ে গেলাম, আর কিছু জানতে হবেনা, এই রকম মনোভাব অনেকের৷ তাদের কাছ থেকে ইসলাম সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যাবেনা৷ কেননা তাদের নিজেদেরই সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই এসম্পর্কে৷”

এ কারণে ইসলাম ধর্ম শিক্ষার জন্য জার্মানভাষী শিক্ষিত ইমাম ও শিক্ষক নিয়োগের কথা চিন্তা করা হচ্ছে, যারা ছাত্রছাত্রীদের ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে প্রকৃত শিক্ষা দিতে পারবেন৷ নয়তো ইসলাম সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা টিকে থাকবে অনেক তরুণের মনে, যা তাদের জঙ্গিবাদের দিকেও ঠেলে দিতে পারে৷

প্রতিবেদন: রায়হানা বেগম

dw-world.de