মিথ্যে মামলায় দীর্ঘ ১৭ বছর একজন মুক্তিযোদ্ধার কারাভোগের খবর প্রকাশের জন্য কতো সাংবাদিকদের কাছেই যে গিয়েছিলাম। কিন্তু কেউই এ সংবাদ প্রকাশ করতে সাহস পায়নি। আর কোন পত্রিকায় প্রকাশও করেনি। কিন্তু দেশের একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র দৈনিক জনকন্ঠ মুক্তিযোদ্ধার কারাভোগের সচিত্র প্রতিবেদনটি দুবার ফলাও করে প্রকাশ করেছে। জনকন্ঠে এ সংবাদ প্রকাশিত না হলে হয়তোবা কোনদিনই সত্যের জয় হতো না। আর দৃষ্টি আকর্ষনও হতোনা মহামান্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের উধর্বতন কর্মকর্তাদের। সে কারনেই আমি, আমার পরিবার দেশের অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারদের পক্ষ থেকে জনকন্ঠ পরিবারের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। একই সাথে আমি গর্ববোধ করছি মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর সৈনিকের স্ত্রী হিসেবে।
আবেগ আপ্লুত ও কান্নাজড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলেছেন, মিথ্যে মামলায় দীর্ঘ ১৭ বছর কারাভোগের পর ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় বরিশাল জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়া গৌরনদী উপজেলার বাসুদেবপাড়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ ইসাহাক আলী প্যাদার পেয়াদার (মৃধা) স্ত্রী রওশন আরা বেগম (৫৩)। ১৭ বছর কারাভোগের পর মুক্ত খোলা আকাশে বেড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী (৮৪) যেন এক প্রকার বাকরুদ্ধ হয়ে পরেছেন। তিনি স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ও নিকট আত্মীয়দের বুকে জড়িয়ে ধরে শুরু হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। দীর্ঘদিন স্বজনদের ছেড়ে কারাভোগের পর আজ তাদের কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়ার আনন্দেই বুঝি তার এমনটি হয়েছে। বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে বরিশাল কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী। জেলখানার গেটে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক বেরুনোর সাথে সাথেই তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন ইসাহাকের বড় পুত্র ইসমাইল হোসেন মৃধা (২৮), ছোট পুত্র মিজানুর রহমান মিজান (২২)সহ তাদের নিকট আত্মীয়রা। এসময় বরিশাল জেলগেট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক ও তার স্বজনদের কান্নাকাটিতে ওই এলাকার আকাশ বাতাস ভাড়ি হয়ে ওঠে। মাত্র ৬ বছর বয়সে আদরের ছোট ছেলে মিজান বাবার বুকে মাথা রেখে বাবার আদর নিয়েছিলো। তার পর আর তার ভাগ্যে জোটেনি বাবার আদর ও ভালবাসা নেয়ার। দুরভাগ্যক্রমে বাবার কারাভোগের পর মিজানের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি কারাগারে থাকায় সে সময় অর্থাভাবে উন্নত চিকিৎসা করানো সম্ভব হয়নি মিজানকে। সড়ক পথে ওইদিন রাতে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীকে নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা তাদের গ্রামের বাড়ি বাসুদেবপাড়ায় পৌঁছলে এলাকার হাজার-হাজার মানুষের ঢল নামে মিথ্যে মামলায় ১৭ বছর কারাভোগের পর মুক্তি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীকে একনজর দেখার জন্য। নিকট আত্মীয়-স্বজনরা এসে ইসাহাক আলীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন।
মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর ছোট পুত্র মিজানুর রহমান মিজান বলেন, ২২ মার্চ (মঙ্গলবার) সন্ধ্যা রাতে এক কারা কর্মকর্তার মোবাইল ফোনের খবরে আমি জানতে পারি আগামি ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় আমার পিতাকে মুক্তি দেয়া হবে। সে লক্ষ্যে ওইদিন (মঙ্গলবার) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয় থেকে বরিশাল ডিসি অফিসে একটি ফ্যাক্সবার্তা এসেছে। এ খবরের ভিত্তিতে আমি ওইরাতেই বরিশালে পৌঁছে কারা কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করি। পরবর্তীতে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।
উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) দৈনিক জনকন্ঠের দেশের খবর পাতায় “মিথ্যা অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক ১৫ বছর ধরে কারাগারে-মুক্তির দাবিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা” এবং ২০১০ সালের ৪ ডিসেম্বর দৈনিক জনকন্ঠের চতুরঙ্গ পাতায় “মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী ১৬ বছর কারাগারে” শিরোনামে দুটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রকাশিত সংবাদের সংবাদকর্মীর দুটি কথা- ২০০৯ সালের নবেম্বর মাসের শেষের দিকে জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জনতা ঐক্য পরিষদের গৌরনদী উপজেলা শাখার একটি সভায় বসে ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সৈয়দ মনিরুল ইসলাম বুলেট ছিন্টুর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিলো কারাঅভ্যন্তরে থাকা মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীর পুত্র মিজানুর রহমানের সাথে। বুলেট ছিন্টুর বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য। তার অনুপ্রেরনা ও নিজের আগ্রহে সংবাদ সংগ্রহে চারবার ছুটে গিয়েছিলাম গৌরনদীর প্রত্যন্ত এলাকা বাসুদেবপাড়া গ্রামে। আজ নিজেকে যেমন গর্বিত মনে করছি তেমনি জনকন্ঠ পরিবারসহ মুক্তিযোদ্ধা বুলেট ছিন্টুর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরন-১৯৮৮ সালের ৫ নবেম্বর বিকেল চারটার দিকে বাসুদেবপাড়া গ্রামের দুর্ধর্ষ সর্বহারা নেতা ও ডাকাত সর্দার শাহ আলম সরদারকে প্রকাশ্যে দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করে স্থানীয় আব্দুর রব বেপারী। শাহ আলম খুনের ঘটনাটি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে তৎকালীন সর্বহারা জিয়া গ্র“পের আঞ্চলিক নেতা ও প্রভাবশালী বিএনপি নেতা রেজাউল করিম আকন্দ নিহত শাহ আলমের ভাই আব্দুস সোবহান সরদারকে বাদি করে গৌরনদী থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করান। ওই মামলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও স্কুলশিক্ষক ইসাহাক আলী পেয়াদা (মৃধা)সহ ১১ জনকে আসামি করা হয়। শাহ আলম খুনের সময় মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী তার কর্মস্থল বাসুদেপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা সত্বেও মামলা থেকে রেহাই পাননি। ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী আদালতে হাজির হয়ে জামিনের আবেদন করেন। বিচারক তার আবেদন না মঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে অদৃশ্য কারনে ১৯৯৬ সালের ৩০ আগস্ট বরিশালের দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ মমিন উল্লাহ উল্লেখিত মামলার ১১ নাম্বার আসামি মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলীসহ ওই মামলার ৯ জন আসামিকে যাবজ্জীবন সাজা প্রদান করেন। পরবর্তীতে নিয়মতান্ত্রিকভাবে মুক্তিযোদ্ধার পরিবার হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্টের শরণাপন্ন হয়েও আইনজীবিদের চাহিদা মতো অর্থের যোগান দিতে না পারায় ব্যর্থ হন।
দৈনিক জনকন্ঠে দু’বার গৌরনদী ডট কমে একবার এ সংক্রান্ত সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর আগামি ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাধারন ক্ষমায় বাংলার অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ইসাহাক আলী পেয়াদা (মৃধাকে) মুক্তি দেয়া হয়।
কৃতজ্ঞতা: ফাহিম মুরশেদ
রিপোর্ট: খোকন আহম্মেদ হীরা