জীবন কেবল যৌবনে বিশ্বাসী

প্রকৃতপক্ষে জীবন এক রহস্যঘন অশ্রুজল অতিক্রমণ। সে ধীরে পার হয়, আস্তে কথা বলে এবং শেষ পর্যন্ত অশ্রুজল হয়ে পরিসমাপ্তি ঘটাতে চায়। জীবনের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। অর্জনের চেয়ে বর্জন তার কাছে দৃষ্টান্তমূলক।

সে চায় না কারও হৃদয়ভেদী ক্রন্দন উত্থিত হোক; কিন্তু মানুষের হৃদয় হলো কান্নারই একটি ঝঙ্কার। সে কাঁদে না তার অন্তরাত্মা প্রস্তুরিভূত একটি পদার্থে জমাট বেঁধে থাকে। এর জন্য মানুষের মর্মে রোদন একটি উপশম, আরোগ্য। আমরা হাসির চেয়ে কান্নার মধ্যেই মনুষ্যত্বের রূপ প্রতিফলিত হতে বেশি দেখতে পাই। তাছাড়া মানুষের আয়ু মানুষকে দুরূহ দুঃসাধ্য পথে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যেতে থাকে। হয় সে মৃত্যুতে গিয়ে পৌঁছে অথবা চির যৌবনের কাহিনী লেখার উপযুক্ত কবি হয়ে ওঠে।

সে স্বপ্ন সৃষ্টি করতে থাকে এবং এক সময় নিজের স্বপ্নের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। এহেন মানুষকে নিয়ে তবুও আমরা আশার কাহিনী রচনা করতে চাই। আশা মানেই ভরসাও বটে। মানুষ হয়ে জন্মালে তাকে মনুষ্যত্বের সবগুলো দিকদিগন্ত বিচরণ করে ধুলো পায়ে ক্লান্তি অবসন্ন হয়ে একদিন বিশ্রামের নিঃশ্বাস হৃদয়ে ঠাঁই করে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। আসলে জীবন হলো এক দীর্ঘ অফুরন্ত পথ। এই পথ পাড়ি দেয়া একমাত্র মানুষের পক্ষে সম্ভব হলেও মানুষ একাকী সেটা পারে না। সে দুঃখের ভাগিদার খুঁজতে থাকে। আর দুঃখে অংশ নিতে কেউ সহজে এগোয় না। নিজের দুঃখের বোঝা নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে হাঁটতে হয় বলেই আমরা এটাকে নাম দিয়েছি জীবন। জীবনের আরম্ভ আছে; কিন্তু শেষ কোথায় সেটা অজ্ঞাত থাকে। অজ্ঞাত না থাকলেও অপরিচ্ছন্ন, দৃষ্টিতে ধরা দেয় না এমন অবস্থায় সে রসক্ষরণ করে। আমরা বলি জীবন বইছে; কিন্তু জীবন বয় না, অতিবাহিত হয়। জীবন সয়। মানুষের জীবন সব সময় দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। এর জন্যই দেখা যায় সে কদাচ বিজয়ী হলেও তার চেহারায় লেগে থাকে পরাজয়ের অনুতাপ। সে তবু বইতে থাকে, সইতে থাকে; কিন্তু পরিসমাপ্তি চায় না। অথচ পরিসমাপ্তিই হলো শান্তি। কোথাও না কোথাও সমস্ত যাত্রারই একটা শেষ থাকে। জীবনেরও শেষ থাকবে এটাই নিয়ম; কিন্তু আক্ষেপের বিষয় জীবন কেবল যৌবনে বিশ্বাসী। সমাপ্তি চায় না। বিশ্রাম চায় না। বিষণ্নতা চায় না। অথচ তার জন্য এই সবগুলো স্টেশনই অপেক্ষা করে থাকে চলার আনন্দ। আর চলতে চলতে বলতে হয় কীভাবে এলাম, কোথায় এলাম, কার ঘরে যাব। তার মধ্যে বিরাজ করে চলার সুখ, বলার আনন্দ এবং একই সঙ্গে পরিসমাপ্তির আকুলতা।

শুধু একথা বললে তো চলে না, আমি এসেছি। আমি এসেছি বললেই প্রশ্ন উঠতে থাকে কোত্থেকে এল, কীভাবে এল, কার ঘরে যাবে। অথচ যৌবনের কোনো ঘরবাড়ি নেই। যেমন সে অবিশ্রাম তেমনি সে মৃত্যুতে আরাম। তার একটাই ভালো স্বভাব। যখন সে চলে তখন সে কথাও বলে। পেছনে ফিরে তাকায় এবং ভয় পায় না। শুধু চলে। অবশ্য তাকে কেউ গায়ের জোরে থামাতে পারে না। সে শুধু চায় পার হয়ে যেতে। এই পার হওয়ার মধ্যেই তার পরাক্রম প্রকাশিত হয় এবং দীর্ঘশ্বাস নিঃসৃত হয়ে যায়। চলার আনন্দে এবং বলার তৃষ্ণায় মাঝে-মধ্যে মনে হয় তার বুঝি বুক ফেটে যাবে। অথচ দুর্ঘটনা কিছু ঘটে না। আনন্দ, আশা, ভরসা সবকিছু একই স্রোতে ঘুরপাক খেয়ে তালগোল পাকিয়ে যায়। সবাই বলে, সামনের দিকে যেতে হবে; কিন্তু কেউ একথা ভাবে না যে সামনের দিকে যেতে হলে একটা পেছনের দিকও রেখে যেতে হয়, একটা অতীত। একটা স্মৃতি-বিস্মৃতি। একটা আলো-অন্ধকার। এর মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুরুর একটা শেষ এসে যায়। প্রত্যেক যাত্রীকেই মেনে নিতে হয় যে, আমি এসেছি; কিন্তু পথ অফুরন্ত। শেষ হয়নি। একটা পরিসমাপ্তি লাগাতে হলে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় জয়-পরাজয় তুচ্ছ হোক। কেবল আমার পৌঁছাটাই গ্রাহ্য হলে আমি অমরত্বের স্বাদ পাব। সব জিনিসই তো ফুরিয়ে যায়। সব আরম্ভেরই শেষ আছে; কিন্তু শেষের আর আরম্ভ নেই। আমি তো যেতেই চাই; কিন্তু যাওয়ার আর পথ কোথায়। এখানে হয় মৃত্যু নেমে আসুক, তা না হলে যৌবন জাজ্বল্যমান অট্টহাসি হেসে ওঠুক। আমার কথায় চারিদিকটা যেন আনন্দে কলরব করে ওঠল। খুশি ছড়িয়ে পড়ল চতুর্দিকে। এবার আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। হাঁটা তো নয় যেন দৌড়ে যাচ্ছি। কে আমার পশ্চাদ্ধাবন করল কিংবা কে আমাকে প্রত্যাখ্যান করল এসব আমার ভাবার বিষয় নয়। মনে হলো আমি গতি আমিই পরিণতি। মানুষ বলে সবকিছুরই নাকি একটা শেষ আছে। আমি তা অগ্রাহ্য করি। কেন শেষ থাকবে? কেন আরম্ভ থাকলেই শেষ থাকতে হবে?

 

 

Al.Mahmud's pictureআল মাহমুদ

সূত্র: প্রিয় ডট কম