নিঃসঙ্গ শাহ মোয়াজ্জেম

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এখন বড্ড নিঃসঙ্গ। বই পড়ে, লেখালেখি করে সময় কাটে তার। গুলশানে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনে গাছগাছালি ঘেরা বাড়িটি তার প্রিয়তমা পত্নী সাজিয়েছিলেন। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনজীবনসঙ্গিনী স্মৃতিচিহ্ন রেখে চলে গেছেন পরপারে। গাছপালা ঘেরা বাড়িতে ভোরের পাখি ডাকে, ঝরাপাতার শব্দ হয়, শয্যায় বড্ড একা শাহ মোয়াজ্জেমের প্রিয়তমা সঙ্গিনীর কথা মনে পড়ে। গাড়ির চালক আছেন, কাজের লোকজন হুটহাট করে চলে যায়। বাবুর্চি আজ আছে তো কাল নেই। উচ্চশিক্ষিত ছেলে বিদেশে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বড় চাকরি নিয়ে সংসার সাজিয়েছেন। একমাত্র কন্যা সেনা কর্মকর্তা স্বামীর ঘরে। রাজনৈতিক কর্মী, শুভাকাক্সক্ষীরা সুনসান নীরবতা ভেঙে শাহ মোয়াজ্জেমের সঙ্গে দেখা করলে রাজনীতির গল্প ওঠে। নস্টালজিয়া তাড়া করে তাকে। ছাত্রনেতা থাকাকালে রাজবন্দীর জীবন নিয়ে লেখা ‘নিত্য কারাগারে’ ষাটের দশকেই প্রকাশ করে দশ হাজার টাকা পান। রাজনৈতিক কর্মী বন্ধুরা কেউ শার্ট, কেউ প্যান্ট, কেউ স্যুট উপহার হিসেবে নিয়ে আসেন, কখনো দলবেঁধে খাওয়া-দাওয়া আর হৈচৈ করে টাকাটা শেষ করেন তিনি।

কম্পিউটার ব্যবহার করতে জানেন না শাহ মোয়াজ্জেম। তবু তার লাইব্রেরি কক্ষে নতুন কম্পিউটার। প্রতি সপ্তাহে সন্ধ্যায় একজন অপারেটর আসেন। নাতির ছবি দেখেন। ই-মেইল বিনিময় হয়। বুকের দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঝেমধ্যে স্বজনদের বলেন, দেশে রাজনীতি থাকলে হয়তো তিনি সার্বক্ষণিক থাকতেন রাজনীতিতে। তার স্বভাবসুলভ কথাবার্তার ধরন এক সময়ে রাজনীতির মঞ্চ সরগরম করত। এখন তার সঙ্গে যারা আড্ডায় বসেন তারা বুঝতে পারেন বয়স বাড়লেও কথাবার্তায় পরিবর্তন আসেনি তার। হাতের কাছেই মুড়ির মোয়া আর বিস্কুটের কৌটা থাকে। অতিথিদের দেন স্নেহমাখা হাতে।

নিঃসঙ্গতা ঘোচাতে কখনো কখনো বলেন, এক বিঘার বাড়িটি বিক্রি করে সোনারগাঁ, শেরাটনে উঠে যাবেন। রসিকতা করে বলেন, তখন অতিথিরা এলে ভালো খাওয়াতে পারবেন। নিজের তো খাওয়া-দাওয়া বারণ তাছাড়া টাকা ওড়াবার জন্য যেসব বদাভ্যাস থাকা দরকার তার কোনটির প্রতিই তার মোহ নেই, আর বয়সও নেই। একজন তিনবার কথা দিয়ে তাকে প্রধানমন্ত্রী করেননি। আরেকজন আটবার কথা দিয়েও তাকে দলের প্রথম সারিতে আনেননি। দুঃখ করে কখনো কখনো বলেন, ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতিতে প্রথম সারিতে থাকলেও আজ কোন সারিতে আছেন নিজেই জানেন না। তার রাজনৈতিক জীবনীমূলক ও কারাজীবনসহ নানা স্মৃতিকথার বই পাঠক মনে সাড়া ফেলেছে। সর্বশেষ ৪ বছরের জেলজীবনে এত বেশি লিখেছেন যে, ক’খানা উপন্যাসও বেরিয়েছে তার। সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য, বঙ্গবন্ধুর নিবিড় স্নেহমমতা লাভ করা শাহ মোয়াজ্জেম একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের পার্লামেন্টের ভিতরে-বাইরে বক্তৃতা দিয়ে সবার নজর কাড়েন।

মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বারবার জেলে গেছেন। বঙ্গবন্ধু আর হারিয়ে যাওয়া নেতা-কর্মীর জন্য তার মনটা এখনো কাঁদে। মাঝেমধ্যে ৭৫ বছরে পা দিয়েও অশ্রুপাত করেন কত কথা, কত স্মৃতি মনে করে।

শাবান মাহমুদ: বাংলাদেশ প্রতিদিন