ক্লাস থ্রির প্রবীণ ছাত্র!

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই প্রবীণ ছাত্রটি গত বছর স্কুলে বেশিদিন উপস্থিত থাকার কারণে পুরস্কৃতও হন।

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি, চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ স্কুলের মাঠে চলছে এসেমবি্ল। সেখানেই গাওয়া হচ্ছে বিবিসির জরিপে শ্রেষ্ঠ হওয়া আমাদের দেশের জাতীয় সংগীত। কিন্তু এ কি! ছোট ছোট ছেলেমেয়ের মধ্যে ওই প্রবীণ লোকটি কি করছেন? তিনিও ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে আপন মনে তালে তাল মিলিয়ে গেয়ে চলেছেন জাতীয় সংগীত। এভাবেই স্কুলে ছোট্ট ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে এক হয়ে স্কুলের সব নিয়ম মেনেই শুরু হয় অহির উদ্দিন মণ্ডলের প্রতিদিনের স্কুল। সকালে নামাজ পড়েই বই নিয়ে বসেন। তারপর স্কুলের পড়া হয়ে গেলে খাওয়া সেরে স্কুলের উদ্দেশে রওনা হন। বাড়ি থেকে স্কুলে যেতে সময় লাগে প্রায় ১৫ মিনিট। এই পথটুকু হেঁটেই যান সহপাঠীদের সঙ্গে অহির উদ্দিন মণ্ডল। প্রথম শ্রেণী থেকেই প্রথম বেঞ্চে বসা অহির উদ্দিন ক্লাসে বই রেখেই স্কুলের পিটির ঘণ্টা বাজতেই লাইনে দাঁড়িয়ে যান। তারপর পিটি সেরে ক্লাসে এসে একজন বাধ্য ছাত্রের মতো পড়া শুরু করেন। ক্লাসে স্যার এলে অহির উদ্দিন তার পড়া বুঝিয়ে দেন। বয়সে নাতি বয়সী অথবা ছেলে বয়সী শিক্ষিকা হলেও অহির উদ্দিন তাদের শ্রদ্ধা ও সম্মান করেন। পড়া না পড়লে শিক্ষিকরাও তাকে শাসন করতে ভোলেন না। কিন্তু এটিই সত্য, অহির উদ্দিন সব পড়া পড়েই স্কুলে আসেন। বেশিদিন উপস্থিত থাকার কারণে এবার তিনি পুরস্কৃতও হয়েছেন। আর এ লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চান তিনি মৃত্যু অবধি।

এক সময়ের দুর্দান্ত সেই দস্যি ছেলেটা, যে ঝোপঝাড় আর বনবাদাড় দাপিয়ে বেড়াত এককালের টগবগে অহির। কে জানত সেই অহির উদ্দিন শেষ বয়সে এসে হাতে তুলে নেবেন বই-স্লেট আর পা বাড়াবেন স্কুলের উদ্দেশে? বসবেন নাতি-নাতনির বয়সী ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সঙ্গে। আর এটাও কে জানত তার শেষ বয়সে সহপাঠী হবে তারাই। কেউ জানুক আর না জানুক বয়সের ভার কিন্তু দমাতে পারেনি অহির উদ্দিনের শিক্ষার অদম্য বাসনাকে। তাই ছোটবেলায় স্কুলে যেতে না পারলেও ৮৩ বছর বয়সে নানা চড়াই-উৎরাই আর ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে যুদ্ধ করে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ২০০৮ সালে ছোট চকচম্পক দাখিল মাদ্রাসায় প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন অহির উদ্দিন। এক বছর পর শুরু হয় বার্ষিক পরীক্ষা। জীবনের প্রথম পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অহির উদ্দিন ভালো ফলাফল করেন। তার জীবনপ্রদীপ দিন দিন ম্লান হয়ে এলেও পরীক্ষায় সফলতা অর্জনের স্বপ্ন তাকে তাড়া করে ফেরে প্রতিনিয়ত। আর তাই পরীক্ষাটাকে যুদ্ধ মনে করেন। নিজের মেধা আর পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সাফল্যের মুকুট ঠিকই ছিনিয়ে নেন অহির। দ্বিতীয় শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। যখন বয়সের কোঠা ৮৫; সেই হিসাবে অহির উদ্দিন এখন তৃতীয় শ্রেণীতে। নওগাঁর মান্দা উপজেলার ছোট চকচম্পক গ্রামে সেই প্রবীণ ছাত্র অহির উদ্দিন বসবাস করছেন দীর্ঘদিন ধরেই। বাবা শিয়ালা মণ্ডল আর মা তছিমন সুন্দরী। বাবা কৃষিকাজ করতেন। পরিবারের অভাব ছোটবেলা থেকেই ছিল। তাই সে সময় পড়াশোনা হয়নি। গায়ে এক রকম হাওয়া খেয়েই বেড়িয়েছেন। তাছাড়া গ্রামে সে সময় লেখাপড়া করার ভালো কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি স্কুলে ভর্তি হয়েছেন আর নিয়মিত লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন স্কুলের শিক্ষকসহ গ্রামের সব শ্রেণী-পেশার মানুষ।

সংগ্রহ: বাংলাদেশ প্রতিদিন