বিপদেই বন্ধুর পরিচয়

প্রকৃত মূল্য উপলবব্ধী করতে শিখায়, ভালো বন্ধুর গুরুত্ব এবং মূল্য সম্পর্কে সকলকে অবহিত করে। কিছু কিছু গল্প যুগ যুগ থেকে প্রচলিত আছে আর কিছু কিছু ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কল্পনার সংমীশ্রনে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি হয়। তবে সকল গল্পের বিষয়বস্তূ একই আ র তা হল মূল্যবোধের উজ্জীবন, মূল বক্তব্য হচ্ছে, ভাল Younusবন্ধু শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত বিশেষ ঊপহার! তাই সকলের উচিত খেয়াল রাখা যাতে করে ছোট খাট ভুল বুঝাবুঝি কিংবা বিরোধ কোনভাবেই বন্ধুত্বের সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি না করতে পারে।

অনেকের সাথে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক রক্ষা করে চলা খুব কঠিন ব্যাপার না হলেও সত্যিকারের ভালো বন্ধু পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। প্রশ্ন হচ্ছে সত্যিকারের ভালো বন্ধু কাকে বলা যায়? অনেকে মনে করেন, ভালো বন্ধু কখনো একে অপরকে ত্যাগ করে না এমনকি যদি দেখা যায় যে একজন ভুল পথে ধাবিত হচ্ছে, তাও না। একজন ভালো বন্ধু সর্বদাই অপর বন্ধুকে সঠিক পথে পরিচালনার প্রচেষ্টা এমনভাবে চালিয়ে যায় যাতে করে অন্য বন্ধুর অহংবোধ কিংবা আত্নসম্মানবোধে আঘাত না লাগে। তবে প্রকৃত বন্ধুরা অন্য বন্ধুর ভুল কিংবা ভ্রান্তি প্রদর্শনে আহত না হয়ে বরং তা সহজে গ্রহন করে নিজেকে সংশোধনের প্রয়াস গ্রহন করে। প্রকৃত বন্ধু অপর বন্ধুকে সংশোধনের মাধ্যমে উত্তম ব্যাক্তি সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

আর কিছু না হোক বাংলাদেশের ড: মোহাম্মদ ইউনূস যে একজন ভালো বন্ধু পরিবার সৃষ্টি করতে পেরেছেন তার জন্যে তাকে পুরস্কৃত করা উচিত, সম্মানিত করা উচিত। আর সেই ভালো বন্ধু হচ্ছে ক্লিনটন পরিবার। বিজাতী্য হওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন ড: ইউনূসের সাথে বন্ধুত্বের যে পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয়েছেন সেটা ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। যুগ যুগ থেকে স্মরনীয় হয়ে থাকবে এই বন্ধুত্বের ইতিহাস।নিজ দেশ এবং জাতির বর্তমান প্রতিনিধিত্বশীল সরকার নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্তির সম্মানকে ধূলায় লুন্ঠিত করার অপপ্রয়াস গ্রহন করলেও সেই সম্মানকে তুলে ধরার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এক বিজাতীয় বন্ধু পরিবার। যতটুকু জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটনই ছিলেন ড: ইউনুসের নোবেল পুরষ্কারের মূল প্রস্তাবক। তা ছাড়া বিল ক্লিনটন গ্রামীন ব্যাংকের এই ক্ষুদ্র ঋনের ধারনা বহন করে নিয়ে গিয়ে তার নিজস্ব অংগরাজ্যে বপন করেছিলেন। ইতিমধ্যে ড: ইউনূসের ক্ষুদ্র ঋনের ধারনা বিশ্বব্যাপি ব্যাপকতা লাভ করেছে এবং সেই সাথে তার সামাজিক ব্যাবসার ধারনাও উচ্চকিত হয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্রে এবং সমাজে। ইতিমধ্যে যখন বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইউনুস সাহেবকে রক্তচোষা আখ্যায়িত করে তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার ঘোষনা দেন তখন যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন টেলিফোনে শেখ হাসিনার সাথে আলাপ করেন। এই টেলিফোনে সংলাপের সংবাদ ১৫ই জানুয়ারী ২০১১ শেখ হাসিনার বার্তা সচিব আবুল কালামের বরাতে সকল পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। যদিও সেই আলোচনার বিষয়বস্তুতে ইউনুস প্রসংগ আলোচিত হয়েছিল কি না তা সংবাদ মাধ্যমে তখন প্রকাশিত হয় নি। কিন্তূ হিলারী-লিকস নামে ১৬ই জানুয়ারী ২০১১ বিভিন্ন মাধ্যমে সেই টেলিফোন সংলাপের বিস্তারিত তথ্য প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত টেলিফোণ সংলাপের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় বিদ্যমান, তথাপি এই সংলাপটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুণরায় বিবেচনার দাবী রাখে। সেই তথ্য সূত্র মতে হিলারী ক্লিনটন বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী বিচার সম্পর্কিত আইন সম্পর্কে তার নেতিবাচক অবস্থানের কথা প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশে বিচারব্যাবস্থায় সরকারের হস্তক্ষেপের ও সমালোচনা প্রকাশিত হয়। সেই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু ড: ইউনুস সংক্রান্ত ছিল বলেই সেই মাধ্যম দাবী করে। ইউনুস সম্পর্কিত ব্যাপারে হিলারী তার নিজের উদ্বেগ এবং প্রেসিডেন্ট ওবামার উদ্বেগের কথা ঐ টেলিফোন সংলাপে প্রকাশ করেন বলে দাবী করা হয়।

হিলারী-লীক হিসাবে প্রকাশিত টেলিফোনে আলোচনার প্রকাশিত বিষয়বস্তু সত্যি বলে মনে করা না হলেও, পরবর্তীতে যখন ইউনুস সাহেবকে গ্রামীন ব্যাংকের ব্যাবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে বয়স অতিক্রান্তের অজুহাতে অব্যাহতি দেওয়া হয় তখন হিলারী ক্লিনটন আর নিশ্চুপ থাকেন নি। প্রকাশ্যে তিনি তার উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে সংবাদ সম্মেলন করেও তা প্রকাশ করা হয়েছে এবং ইউনুস সাহেবকে টেলিফোন করেও তিনি তার অবস্থান সুস্পষ্ট করেছেন। ততপরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিন এবং মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্র মন্ত্রী রবার্ট ব্লেককে সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে প্রেরন করা হয়। রবার্ট ব্লেক বাংলাদেশ ত্যাগের প্রাক্কালে ইউনুস সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার এবং ইউনুস সাহেবের মধ্যে সমঝোতায় উপনীত হওয়ার বিষয়ে তার বিশ্বাসের প্রত্যয় ব্যাক্ত করেন এবং উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমে গ্রহনযোগ্য একটি সমাধানে উপনীত হওয়ার জন্য উতসাহিত করার কথা ব্যাক্ত করেন।

আমরা যদি ইউনুস সাহেবের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল আগ্রহের কারন হিসাবে শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত বন্ধুত্বের বন্ধনের কথা ভাবি তাহলে এটা ইউনুস সাহেবের জন্য অত্যন্ত গৌরবের যে তিনি এধরনের ভালো বন্ধু তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন। যে বন্ধুত্ব তার নিজের অবস্থান অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদকে ঝুকির মধ্যে নিয়েও বন্ধুত্বকে সম্মানিত করেছে। বাংলাদেশ সরকার এতটুকুর পরও ইউনুস সাহেবকে এখনও তার সম্মান ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ গ্রহন করে নি। এতে করে বন্ধুত্বের সম্মান উদ্দীপ্ত হয়েছে, গৌরবান্বীত হয়েছে বটে কিন্তূ বাংলাদেশ সরকারকে এখনো তার অবস্থান থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হয় নি।

বন্ধুত্বের মহিমা নিয়ে হিলারী ক্লিনটনকে পুরষ্কৃত করা গেলেও একটা ব্যাপারে কোনভাবেই তার গূণকীর্তন করা যাচ্ছে না, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তার সরাসরি হস্তক্ষেপ। আমার মনে প্রশ্ন এসেছে তাহলে কি আমরা আদৌ স্বাধীনতা ভোগ করি না? বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বারে বারে এব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপকে অত্যন্ত সহজভাবে গ্রহন করছেন এবং সম্ভবতঃ নতজানূ ও হয়েছেন। কেননা রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ আদালত সেই মামলার বিষয় শুনানীর দীর্ঘ তারীখ প্রদান করেছে এবং অর্থমন্ত্রী ড: আবুল মাল আব্দুল মুহিত ইতিমধ্যে প্রকাশ করেছেন যে সংলাপের জন্যে ইউনুস সাহেবকেই এগিয়ে আসতে হবে। সংলাপ হোক, গ্রহনযোগ্য সমাধান ও আসুক আমরা তাই কামনা করি। কিন্তু এই সংলাপ যদি যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারনে না হয়ে নিজ দেশের সুশীল সমাজ কিংবা ব্যাবসায়ি সম্প্রদায় কিংবা শিক্ষক সম্প্রদায় কিংবা রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের চাপের কারনে হত তাহলে আমরা আনন্দিত হতাম।

তবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র যে আন্তর্জাতিক পর্য্যায়ে সম্মান এবং স্বাধীনতা ভোগ করে না, তা অবশ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে প্রদত্ত তার সাম্প্রতিক ভাষনে অবলীলায় প্রকাশ করেছেন। একটি জাতীয় দৈনিকের বরাতে প্রকাশিত যে প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন তিনি এবং খালেদা জিয়া ২০০১ সালে নির্বাচনের প্রাক্কালে ততকালীন প্রধান উপদেষ্টা বিচারপতি লতিফুর রহমানের বাসভবনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিমি কার্টারের উপস্থিতিতে এক বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সেই বৈঠকে জিমি কার্টার ভারতে গ্যাস রফতানির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি চাইলে, শেখ হাসিনা তার সহকর্মী আব্দুল জলিলকে নিয়ে বের হয়ে আসেন। বেগম জিয়া সেখানে অবস্থান করেন এবং শেখ হাসিনা’র ধারনা খালেদা জিয়া তখন কার্টারের দাবী মেনে নিয়েই নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সরকার পরিচালনা করেন। শেখ হাসিনা এই সংবাদ পরিবেশন করে কয়েকটা বিষয় জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন, প্রথমতঃ যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন মাধ্যম প্রায়শঃই বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে থাকেন এবং বাংলাদেশের উভয় নেতৃই সেই হস্তক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে সভা-সমিতিতে অংশগ্রহন করে থাকেন। দ্বিতীয়তঃ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের উপরই বাংলাদেশে সরকার গঠন নির্ভর করে থাকে। বিতর্কের খাতিরে যদি ধরে নেওয়া যায় যে খালেদা জিয়া ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব মেনে নিয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছিলেন। তাহলে আমার প্রথম প্রশ্ন ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিকট কি মুচলেকা দিয়ে শেখ হাসিনা সরকার গঠনে সক্ষম হয়েছেন? দ্বিতীয় যে প্রশ্ন আমাকে বিচলিত করেছে তা হল, যদি যুক্তরাষ্ট্র আমাদের সরকার গঠনের নিয়ন্ত্রক হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশের এই কোটি কোটী ভোটাররা কি করে থাকে? যদি বাংলাদেশের ভোটাররা সত্যিকার অর্থে সরকার গঠনে কোন ভূমিকা আদৌ পালন না করেন, তাহলে এই খেলো নির্বাচন পদ্ধতির কি আদৌ কোন প্রয়োজন আছে? সবচেয়ে ভালো হয়, সংবিধান সংশোধন করে সরকার নির্বাচনের দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রের উপর ন্যাস্ত করে দিলেই ত ল্যাঠা চুকে যায়! বাংলাদেশের জনগনকে নিয়ে এই তামাশা করার আদৌ কি কোন প্রয়োজন আছে?

ডঃ ইউনুস সাহেবের বন্ধু ভাগ্য অনেক ভালো তা বোধ করি অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন, কিন্তূ এতে করে আমার নিজের বন্ধু ভাগ্য নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। আমার ধারনা মতে ইউনুস সাহেবের অপসারন ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আইনী সিদ্ধান্ত নয়। আইনী সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বাহন মাত্র। কিন্তূ আমার এক প্রিয়বন্ধু সেটা মানতে নারাজ, তিনি মনক্ষুন্ন হয়েই আমার বুদ্ধীমত্তা এবং যুক্তির ক্ষমতা নিয়ে সংশয়ান্বীত হয়ে পড়েছেন। আমার বুদ্ধীমত্তার অভাবের কথা সর্বজন বিদিত এবং আমি নিজেও সে ব্যাপারে সচেতন। তাই ভাবতে বসলাম তাহলে কি আমার প্রিয়বন্ধু এই সিদ্ধান্তকে আইনী বলেই মনে করছেন? কিন্তূ আমি ভাবলাম যদি ব্যাপারটাকে এইভাবে দেখা যায় যে যখন সরকার সদয় ছিলেন তখন ড: ইউনুসের বয়সোত্তীর্নের ব্যাপারটা আইনতঃ সিদ্ধ ছিল, কেননা তখন গ্রামীন ব্যাংকে সরকারের তরফ থেকে সবুজ সংকেত প্রদান করা হয়েছিল যে গ্রামীন ব্যাংক পরিচালনা বোর্ড নিজেদের সিদ্ধান্তে ব্যাংকের সংবিধানে বয়সের সীমানা নির্ধারন করে দিলে আইনসিদ্ধ হয়ে যাবে। সেমতেই গ্রামীন ব্যাংক পরিচালিত হয়ে আসছিল এবং এটা অবধারিত যে তখন যেহেতু সরকার সেই সিদ্ধান্তের পক্ষে ছিল তাই বাংলাদেশের আদালত ও তখন তার বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ন হতে ছিল অক্ষম। এখন যেহেতু বাংলাদেশের সরকার ইউনুস সাহেবকে অসম্মানিত করতে চান তাই আইন-আদালত সেইভাবেই পরিচালিত হচ্ছে এবং এখন সরকার চাইলে আইন-আদালতের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের ইঙ্গিতও সুস্পস্ট। তাহলে আমার বন্ধু কি মনে করছেন? তিনি সম্ভবতঃ ভাবছেন যে এটা শেখ হাসিনার ব্যাক্তিগত ইর্ষার বহিঃপ্রকাশ, অনেকেই তা মনে করেন এবং আমিও এই ঈর্ষার সম্পর্কে অবগত আছি, আমি মনে করি ঈর্ষা এবং জীঘাংসা উভয়েই এখানে কাজ করে থাকতে পারে। তবে ঈর্ষা মিশ্রিত জিঘাংসা যদিও এখানে কার্য্যকরী ভূমিকা পালন করেছে তথাপি এই জীঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক শক্তিকে বাহন করেই আইনী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন কি করেন নি?

সে যাই হোক, এদিকে বাংলাদেশের স্বনামধন্য সাহিত্যিক সাংবাদিক রাহাত খান সাহেব ইউনুস সাহেবকে নিয়ে একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ এবং একটি ব্লগ লিখেছেন। সেই লিখাগুলোতে অন্যান্য বিতর্কিত মতামতের সাথে তিনি লিখেছেন,

‘‘সমাজে সামান্য কিছু ক্ষেত্র ছাড়া যিনি গ্রামীণ ব্যাংকের উচ্চ হারের ক্ষুদ্রঋণে দারিদ্র্যমোচনে তেমন সফল হননি, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় গণহত্যাকারী পাকিস্তানের বিপক্ষে কোনো প্রতিবাদ জানাননি, আমেরিকায় নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে যিনি আত্মরক্ষায় সচেষ্ট ছিলেন, দেশের প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ের সময় যিনি সর্বদা তাঁর নেপথ্যচারিতা ও নিষ্ক্রিয়তা রক্ষা করেছেন নির্লিপ্তভাবে- সেই তিনি, ব্যবসা-বাণিজ্যের শিরোমণি ড. মুহাম্মদ ইউনূস পেলেন শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার। শান্তি পুরস্কারের প্রতি নোবেল কমিটির এই দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিহাস ছাড়া আর কী বলা যায়।’’

রাহাত খান সাহেব না জেনে এই লিখাটি লিখেছেন তা ভাবতে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। সকলের জ্ঞাতার্থে আমার প্রিয়বন্ধু প্রেরিত সূত্রে নিম্নে বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, প্রবাসি বাংলাদেশ সরকার, পরবর্তীতে  স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রীপরিষদ সচিব এবং বাংলাদেশের বর্তমান সংস্থাপন উপদেষ্টা জনাব এইচ টি ইমাম সাহেবের লিখিত পুস্তক ‘’বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১’’ নামক পুস্তকের ২১১ পৃষ্ঠা থেকে কিছু বক্তব্য নিম্নে উদ্ধৃত করলাম, সকলের জ্ঞাতার্থে;

‘’যুক্তরাষ্টে প্রবাসী বাঙ্গালীদের ইতিহাস অসম্পূর্ন থেকে যাবে যদি আরও কয়েকজন বাঙ্গালীর অবদানের কথা উল্লেখ না করি। তারা হলেন নিউ ইয়র্কের কাজী শামসুদ্দিন (ব্যাবসায়ী) এবং ড: ইউনুস (গ্রামীন ব্যাংক খ্যাত)। শামসুদ্দীন ছিলেন নিউ ইওর্কে পাকিস্তান লীগের সভাপতি। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে তিনি সেটাকে নামকরন করেন East Pakistan League. ১৯৭২ সালের জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারীতে তিনি এটাকে বাংলাদেশ লীগ (Bangladesh League) এ পরিনত করেন। তিনি ছিলেন রেস্টুরেন্টের মালিক। এটিই পরিনত হয় গোটা আমেরিকা থেকে আগত আন্দোলনে যোগদানকারী বাঙ্গালীদের মিলনক্ষেত্র বলা যায়- Rallying point। নিউ ইওর্কের ব্যাস্ত সভা-সমাবেশ, র‍্যালী, পথসভা, জনসভা ইত্যাদি উত্পত্তি হত এখান থেকে।

ইউনুস সাহেব টেনেসি স্টেটের ন্যাশভিলের কাছেই থাকতেন। ২৬শে মার্চ প্রথম পাকিস্তানী-আক্রমনের কথা শুনেই তিনি মনস্থির করে ফেলেন। ২৭ শে মার্চ আশে পাশে বাঙ্গালীদের (মোট ৬ জন) সমবেত করে কর্মপন্থা নির্ধারন করেন। বাংলাদেশের জন্য অর্থসংগ্রহ, স্থানীয় পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভিতে বিবৃতি, সাক্ষাতকার ইত্যাদির ব্যাবস্থা করে ঐ ৬ জন রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করেন টেনেসি-তে। পরবর্তীকালে ওয়াশীংটনে ক্যাপিটেল হিলের সামনে সমাবেশে, র‍্যালিতে যোগদান থেকে শুরু করে পরবর্তী নয় মাস ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যান স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য মুজিবনগর সরকারের ঘোষিত মুক্তিযুদ্ধে। কিছুদিন ড: ইউনুস Bangladesh Newsletter প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন।‘’

কি তথ্যের ভিত্তিতে রাহাত খান সাহেব উনার মন্তব্য করেছেন আমি জানি না। তবে আমি তাকে প্রশ্ন করতে চাই, তাহলে কি এইচ টি ইমাম সাহেব মিথ্যা তথ্য উপস্থাপন করেছেন? না কি তিনি বলবেন যে এইচ টি ইমাম সাহেব ও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না? রাহাত খান সাহেব যাই বলেন না কেন, ইতিহাস কিন্তূ রচিত হয় এভাবেই। আমরা যতই বলি ইতিহাস মিথ্যা কথা বলে না, কিন্তূ আসলে কি সেটা সঠিক? বাংলাদেশের ইতিহাস লিখার দায়িত্ব ঐতিহাসিকের উপর অর্পিত না হয়ে আজ সেই দায়িত্ব গ্রহন করেছেন রাজনীতিবিদ, সাহিত্যিক এবং বিচারক। সংবিধান রচনা কিংবা সংশোধনের দায়িত্ব সংসদের জন্য নির্ধারিত থাকলেও সেই দায়িত্ব বর্তমানে বিচারপতির নিকট ন্যাস্ত হয়েছে। তাই আমরা এখন আসলে কোন রাজত্বে বাস করছি তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে আজ সত্য-ভাষী-সাহসী মানুষের বড়ই অভাব আর যারা সত্য-ভাষী-সাহসী এবং প্রকাশীত তারা আজ হয় নির্য্যাতিত কিংবা কারাগারে! কিন্তূ এই মূহূর্তে ড: ইউনুস সাহেব সম্পর্কে সিদ্দান্তের জন্য সবাই কি তাকিয়ে আছেন শেখা হাসিনার মুখপানে? একটি গল্প বলেই আজকের রচনাটি সমাপ্ত করব আর তাহচ্ছে মোঘল সম্রাট মহামতি আকবরের নবরত্নের বিশিষ্ট রত্ন বীরবলের একটী গল্পঃ

ইরানের শাহানশাহ বীরবলের বিজ্ঞতা এবং বিচক্ষনতা সম্পর্কিত জনশ্রুতি শ্রবন করে বীরবলকে ইরান সফরে শাহানশাহের আতিথ্য গ্রহনের আমন্ত্রন জানান। যথাসময়ে বীরবল ইরান সফরে এলে তিনি শাহানশাহের দরবারে আগমন করে আশ্চর্য্য হয়ে দেখেন যে ছয়টি সিংহাসনে একে একে ছয়জন রাজা উপবিষ্ট আছেন। সবাই দেখতে ছিলেন একই রকম আর সবাই একই ধরনের রাজপোষাকে সজ্জিত ছিলেন। বীরবল আশ্চর্য্য হয়ে ভাবলেন, আসল রাজা কে?

মূহূর্তেই তিনি তার উত্তর খুজে পেয়ে প্রকৃত শাহানশাহের সম্মুখে গিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলেন। তখন শাহানশাহ আশচর্য্য হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেন যে, ’’আপনি কিভাবে আমাকে চিনতে পারলেন?’’ তখন বীরবল মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, ‘’নকল রাজারা আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলেন আর শুধুমাত্র আপনিই সরাসরি সামনের দিকে তাকাচ্ছিলেন। রাজকীয় পোশাক গায়ে পরিধান করলে কি হব মোসাহেব, মন্ত্রী এবং আমলারা সর্বদাই তাদের রাজার দিকে তাকিয়ে থাকেন সমর্থন এবং সিদ্ধান্তের আশায়।‘’

ইরানের শাহানশাহ তখন বীরবলকে জড়িয়ে ধরেন এবং পুরষ্কৃত করেন।।


jinnuraine's picture