ব্রিটেনে বাঙালী কয়েক তরুণের কর্মকাণ্ডে শঙ্কা

ব্রিটেনের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর বোমা হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে সাতজনই ছিল বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত। ওই ঘটনার রেশ যেতে না যেতেই ফেব্রুয়ারিতে আবারও শিরোনাম হলো সেই ভয়ংকর পুরনো ঘটনাটি আরেক বাংলাদেশি রাজিবকে নিয়ে। আদালতে বাঙালি রাজিব করিমের মামলার রায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এখানকার বাঙালিদের নতুন প্রশ্নের মুখোমুখি। রাজিব করিম ২০০৬ সালে লন্ডনে এসেছিল পড়তে। নিঃসন্দেহে স্বীকার করতে হয়, মেধাবী ছাত্র রাজিব। ম্যানচেস্টার ইউমিস্টের মতো একটি খ্যাতিমান ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল সে। কিন্তু কেন এই মেধাবী ছাত্রটিকে নিয়ে সেই পুরনো প্রশ্ন? গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে রাজিব ব্রিটেনের বিভিন্ন মূল ধারার গণমাধ্যমে আসছে। ওই সময়ই সে গ্রেপ্তার হয়। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে কর্মরত ছিল রাজিব এবং মাত্র কয়েকদিনের এই চাকরিকালীনই সে পরিকল্পনা করেছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে নাশকতা চালানোর। তার ইচ্ছা ছিল ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের কোনো এক ফ্লাইট উড়িয়ে দেওয়ার। চারটি অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর অভিযোগ ছিল, সে যুক্তরাষ্ট্রগামী ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমান উড়িয়ে দেবে। এ অভিযোগগুলো শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয় এবং গত ১৮ এপ্রিল উলউইচ ক্রাইন কোর্টের রায়ে তার ৩০ বছরের জেলদণ্ড হয়েছে।

কেনই বা বাঙালি তরুণ, এমনকি তরুণীরা ক্রমেই ঝুঁকছে সন্ত্রাসী হামলার দিকে? কী এমন বিশ্বাস, যে বিশ্বাস থেকে এরা একটা অন্ধকার জগতের দিকে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছে। তারা মনে করছে, জিহাদই মুক্তির পথ। অথচ এ জিহাদ কোনো অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্য নিয়ে নয়, এমনকি নয় কোনো রাজনৈতিক মুক্তি। একটা অন্ধ প্রহেলিকাকে জড়িয়ে তারা যেন ক্রমেই অন্ধ হচ্ছে। একটা অবাস্তব আস্ফালনে তারা উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে ক্রমেই। ব্রিটেনের মতো দেশ, যেখানে কথা বলার রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। আর এই স্বাধীনতাকেই তারা নিতে চাইছে তাদের মতো করে। একটা পশ্চিমা দেশ, যেখানে মানুষ ছুটে চলে যন্ত্রের মতো। বেঁচে থাকা আর উন্নত জীবনের জন্য মানুষের নিত্যই ছুটে চলা এখানে। এই ছুটে চলার মধ্যে রাজিবদের মতো একটা শ্রেণী এখানে ডানা মেলতে চাইছে। বাংলাদেশের জামায়াতুল মুজাহিদীনের (জেএমবি) শিক্ষা নিয়ে এই রাজিবরা ব্রিটেনকে বানিয়ে দিতে চাইছে একটি মৌলবাদী রাষ্ট্র। রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন মানুষের চাওয়া-পাওয়া থাকতেই পারে। চরম প্রতিক্রিয়াশীল ব্রিটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) কিংবা ইংলিশ ডিফেন্স লীগ (ইডিএল) এখানে তাদের বার্তা পৌছাচ্ছে। জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মুখেও এরা ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টে জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু সব কিছু এখানে হয় সেই মুক্ত আর স্বাধীনতার কারণেই। ধর্ম প্রচার যদি কোথাও বাধাগ্রস্ত হয় কিংবা ধর্মীয় বিকাশ রুদ্ধ করতে প্রতিপক্ষ ক্রুসেড কিংবা ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করে, তবেই না জিহাদের প্রশ্ন আসতে পারে। রাজিব করিম নিজেই স্বীকার করেছে, এখানে আছে তথ্যপ্রবাহের অবাধ স্বাধীনতা। তথ্যপ্রবাহ কিংবা ধর্মসহ যেকোনো ব্যাপারেই যৌক্তিক স্বাধীনতা আছে বলেই এখানে গড়ে উঠছে নয়নাভিরাম মসজিদগুলো। তাই স্বাভাবিকভাবে আমাদের প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক, তথ্যপ্রবাহের মুক্ততার কারণে ধর্মের জন্য উন্মাদনা ছড়িয়ে দেওয়ার মাঝে কী রকমের জিহাদি মনোবৃত্তি কাজ করে? রাজিবদের কারণে কেনই বা নিরীহ বিমানযাত্রীরা তাদের টার্গেট হবে? তারা কি মনে করে, একটা বিমান উড়িয়ে দিলেই জিহাদের একটি অংশ তারা পূর্ণ করে ফেলবে? তারা কি মনে করে, লন্ডনের ট্রেন স্টেশন কিংবা বাসে বোমা ফাটিয়ে নতুন সেভেন সেভেনের জন্ম দিলেই বিপ্লব দোরগোড়ায় এসে যাবে? আমরা জানি, এতে করে কোনোই লাভ হয় না। শুধু সভ্যতার কলঙ্ক বিস্তৃত হয়।

গত বছরের শেষের দিকে আরেক তরুণী হয়েছে একইভাবে গণমাধ্যমে চাউর। মাত্র ২২ বছরের ওই তরুণীটিও অসাধারণ মেধাবী। লন্ডনের কিংস কলেজের গ্র্যাজুয়েশন শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিল সে। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছে ব্রিেেটনের মানুষ, ওই তরুণী তার এলাকার এমপি স্টিফেন টিমসের বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যে। ইরাক যুদ্ধ তাকে নাকি উদ্বুদ্ধ করেছে! ইরাক-আফগানিস্তানের শিশুহত্যার নির্মমতা তাকে ক্ষুব্ধ করেছে। তার বিশ্বাস, স্টিফেনের মতো মানুষ মদদ দিয়ে যান এসব হত্যাযজ্ঞে। কিন্তু সে দেখেনি কিভাবে অতীতে স্বেচ্ছাচারী শাসকরা যুগের পর যুগ শাসন চালিয়ে যায়, কিভাবে শ্রমিকরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে পায় অমানবিক আচরণ। মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রগুলোর অমানবিক আচরণের খবরগুলো কেন পায় না ওই তরুণ-তরুণীরা? তারা পবিত্র গ্রন্থের শান্তির বাণী দেখে না। তারা অনলাইন নেতা খোঁজে। তাই তো রাজিব যেমন সাক্ষাৎ পায় ইয়েমেনের আনোয়ার আওলকির মতো আল কায়েদার শীর্ষ তাত্তি্বকের, ঠিক তেমনি ব্রিটেনের ওই তরুণী রোশনারা চৌধুরীও আদালতেই বলেছে, কিভাবে আনোয়ার আওলকির বক্তৃতাগুলো তাকে ছুরি হাতে নিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ব্রিটেন যেন ক্রমেই হয়ে যাচ্ছে ওইসব তরুণ-তরুণীর স্বর্গরাজ্য। কি এক আগ্রাসী মনোভাব পোষণ করে তারা। ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থায় তাদের বসবাস; অথচ ব্রিটিশদের প্রতিষ্ঠিত সংস্কার-ইতিহাসকে এরা পায়ে ঠেলে! রণাঙ্গনে নিহত ব্রিটিশ সৈন্যদের স্মরণ করার প্রতীক, যা ব্রিটিশ জাতির সংগ্রামী ইতিহাসের স্মারক বলে মনে করে, সেই স্মারক পপিফুল প্রকাশ্যে পুড়িয়েছে এক বাংলাদেশি ব্রিটিশ যুবক! আদালত তাকেও জরিমানা করেছেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন এ নিয়ে। গত কয়েক বছর আগে দেখেছি ম্যানচেস্টারে ইউনিয়ন জ্যাক পুড়িয়েছে এই রাজিবদেরই একটা গ্রুপ। এগুলো পোড়াতে গিয়ে তারা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়েছে বিভিন্ন সময়। এসব করতে গিয়ে ওই তরুণ-তরুণীরা যতটুকু ক্ষতি না করছে তাদের, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ক্ষতি করে ফেলছে এখানে বেড়ে ওঠা অসংখ্য মুসলমান তরুণ-তরুণীর। কারণ রাজিব-রোশনারা চৌধুরীদের সংখ্যা এখানে কম হলেও আশঙ্কাজনকভাবে ক্রমেই বাড়ছে।

ধর্মীয় নীতিবোধের প্রচার চলতেই পারে। কিন্তু ব্রিটেনে যেভাবে বিশেষত বাঙালি ও পাকিস্তানি কমিউনিটিতে একটা অন্ধ-উগ্র গোষ্ঠী ক্রমেই বাড়ছে এটি উদ্বেগজনক। এর ছায়া পড়ছে নতুন প্রজন্মের একটা অংশে। এই প্রজন্ম শিক্ষিত। কিন্তু এরা কেন জানি একটা চক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এখানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বাড়ছে। কিন্তু বাড়ছে না ধর্মের যথাযথ ব্যাখ্যার ক্ষেত্র। ইচ্ছে করেই এই প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী জিইয়ে রাখছে এসব। এই গোষ্ঠীর প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে অসহায় থাকার কথা নয় ব্রিটেনের বাঙালি সমাজের। অথচ কমিউনিটির রাজনীতিতে এরা এখন বড় ফ্যাক্টর। কিন্তু বাংলা গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সেক্টরে বসে তারা যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে এবং এরই মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থের জাল বিস্তার করে ফেলেছে। এ যে কত বড় উদ্বেগের বিষয় তা কি ভেবে দেখেছে কেউ? রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে তথা ভোটের রাজনীতিতে এখন এদের ঠেলে দেওয়া ভার। অনেক প্রগতিশীল মানুষ এখানে আছেন। কিন্তু দেশীয় রাজনৈতিক সেন্টিমেন্ট কিংবা প্রগতিবাদীদের সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব-দুর্বলতা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওই সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করেই একটা অবস্থানে চলে যাচ্ছে এরা_এ বিষয়টি প্রগতিশীলরা বুঝতেই পারছেন না। বেরিয়ে আসার পথ খুঁজছে না কেউ। এ সুযোগেই রাজিবরা বেড়ে উঠছে, রোশনারা চৌধুরীরা জেলের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে করছে জীবন যাপন। আগামী প্রজন্মের নিরাপদ আর বৈষম্যহীন আবাস গড়ার প্রয়োজনেই তাই এই ভাবনাটা প্রয়োজন।